Monday, January 3, 2011

প্রসঙ্গ :মানসম্মত শস্যের উৎপাদন

প্রসঙ্গ :মানসম্মত শস্যের উৎপাদন

এম জি মহিউদ্দীন আহম্মদ

আমাদের দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। তাই প্রায় পাঁচ দশক থেকে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর বহুমাত্রিক তৎপরতা চলছে। ধারাবাহিক এ তৎপরতায় খাদ্য-শস্য উৎপাদন উলেস্নখযোগ্যভাবে বেড়েছে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষক তার শস্য রক্ষা করতে অব্যাহতভাবে কীটনাশক ব্যবহার করছে। শস্য রক্ষায় ঢালাওভাবে কৃষকদের কীটনাশক প্রয়োগে খাদ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। শস্যের সাথে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের অবস্থান খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও সৃষ্টি করছে।

তাছাড়া কীটনাশকের প্রত্যক্ষ প্রভাবে জলজ উদ্ভিদ বিলুপ্ত হচ্ছে এবং মাছের উৎপাদন কমছে। বৃষ্টির পানির সাথে কীটনাশক খাল-বিল নদী-নালায় যায় এবং মাছের ডিম ধ্বংসে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে। তাই আমাদের দেশের মুক্ত জলাশয়ের মাছের যোগান অব্যাহতভাবে কমছে। আর মাছ আমাদের খাদ্যে পুষ্টি যোগানে সে অতীত থেকেই ভূমিকা রেখে আসলেও কীটনাশকের প্রভাবে ব্যাপক নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। তাই আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিহীন এবং মানসম্পন্ন খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করতে কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া অপরিহার্য। খাদ্যমান নিশ্চিত করতে হলে কীটনাশক প্রয়োগে আমাদের অবশ্যই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।

ধান,গম এসব দানা জাতীয় খাদ্য-শস্যের চেয়ে শাক-সবজি ও ফল-মূলে কীটনাশকের প য়োগ আমাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকির কারণ। শাক-সবজি ও ফল-মূলে কীটনাশকের অবস্থান বেশী থেকে যায় বিধায় ঝুঁকির পরিমাণও বেশী।

উৎপাদন বাড়ানোর তৎপরতা অব্যাহতভাবে চালাতে হবে এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ না থাকলেও ঢালাওভাবে কীটনাশকের প্রয়োগ রোধ করতেই হবে। তাই মানসম্পন্ন খাদ্য-শস্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে আমাদের তৎপর হতেই হবে। খুশির বিষয় এ ক্ষেত্রে সীমিত পর্যায়ে তৎপরতা শুরু হয়েছে। প্রাকৃতিক উৎস হতে জৈব কীটনাশকের সন্ধানে কৃষকদের তৎপর হতে দেখা যায়। বিভিন্ন সময় আমাদের প্রচার মাধ্যমে জৈব কীটনাশক প্রয়োগে সাফল্য চিত্র প্রচারিত হতে দেখা যায়। গত ২০ শে জানুয়ারী ২০১১ তারিখ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রচারিত গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় লতিফের বালাইনাশক ওষুধ সাড়া ফেলেছে। শীর্ষক সংবাদ প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে। এ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের প্রতিভাবান কৃষক আবদুল লতিফ দেশীয় গাছপালা দিয়ে বালাইনাশক তৈরি করে এলাকায় সাড়া ফেলে দিয়েছে। দেশের প্রচলিত কীটনাশক ব্যবহার না করে এ এলাকার প্রায় ২৭ কৃষক ১ হাজার ৮শ বিঘা জমিতে আবদুল লতিফের তৈরি ভেষজ কীট ও বালাইনাশক ব্যবহার করে আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়ায় ক্রমেই অন্য কৃষকরা উক্ত বালাইনাশক ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। ভেষজ বালাইনাশকের এ সাফল্য কৃষকদের আকৃষ্ট করার খবরটি আমাদের নতুনপথের সন্ধান দিবে এটা আশা করা যায়। জানা যায় , উচ্চশিক্ষাবঞ্চিত হয়ে আবদুল লতিফ কৃষি কাজে জড়িত হয় এবং সাফল্য নিশ্চিত করতে তৎপরতা চালায়। জানা যায়, অবিবাহিত লতিফ দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন গাছপালা, লতাগুল্ম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উলেস্নখিত ভেষজ কীট ও বালাইনাশক আবিষ্কার করেন। লতিফ জানান, পরিমাণমত নিমপাতা, নিমগাছের অংশ, নিমের বীজ, তুলসি পাতা, মেহগনি গাছের বীজ, আতা গাছের পাতা মিশিয়ে পরিবেশবান্ধব ওষুধ তৈরি করা হয়েছে। এ কৃষকের আবিষ্কার এলাকার কৃষকদের ভেষজ কীট ও বালাইনাশকের সন্ধান দিয়ে মানসম্পন্ন শস্য উৎপাদনের পথ দেখিয়েছে। এ অভিজ্ঞতা দেশের কৃষকদের মাঝে পেঁৗছানো গেলে মানসম্পন্ন শস্য উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানোরও সম্ভব হতে পারে। আর এ কাজটি সহজ হতে পারে আমাদের কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে এ অভিজ্ঞতা পেঁৗছে দেয়া। এ প্রসঙ্গে উলেস্নখ্য, ইতিপূর্বেও এ ধরনের সংবাদ প্রতিবেদনে ভেষজ বালাইনাশকের প্রয়োগের সাফল্য চিত্র প্রচারিত হয়েছে। নিমের বীজ থেকে তেল তৈরি করে বালাইনাশক হিসেবে প্রয়োগেও সাফল্য এসেছে বলে জানা যায়। মেহগনি বীজ থেকে তেল তৈরি করে বালাইনাশক হিসেবে ব্যবহার করেও সাফল্যের কথা জানা গেছে। বিচ্ছিন্নভাবে এসব তৎপরতা চলতে থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে ভেষজ বালাইনাশক তৈরির কথা জানা যায়নি। কৃষকদের ভেষজ বালাইনাশকের কার্যকরী প্রয়োগ সম্বন্ধে অবগত করা হলে সাফল্য আসতে পারে সহজেই। পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে ভেষজ বালাইনাশক তৈরি করার উদ্যোগ নেয়াও দরকার। মানসম্পন্ন শস্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে ভেষজ বালাইনাশকই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

আমাদের দেশে কৃষিবিদ জনশক্তি বিকশিত হয়েছে। তাদের লেখা সংবাদ প্রতিবেদন থেকেও ভেষজ বালাইনাশকের কার্যকরী অবস্থার কথা জানা যায়। তাই বাণিজ্যিকভাবে ভেষজ বালাইনাশক উৎপাদনের জন্য উদ্যোগ নেয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে সরকারী উদ্যোগই সাফল্য নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে ধারাবাহিক তৎপরতায় সরকারই মুখ্য ভূমিকা রেখে আসছে। আর কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর সাফল্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বর্তমান সরকার কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বহুমাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। স্বাস্থ্যঝুঁকিমুক্ত মানসম্পন্ন খাদ্য-শস্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগের পরিবর্তে ভেষজ বালাইনাশক ব্যবহার ত্বরান্বিত করতে সরকারকে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্যোগী হওয়া দরকার।

এ ধরনের পদক্ষেপে সাফল্য অর্জনের জন্য কৃষকদের ভেষজ বালাইনাশকের সাথে পরিচিত করতে হবে এবং রাসায়নিক কীটনাশকের ক্ষতিকর দিকগুলো জানাতে হবে। উলেস্নখ্য, আমাদের দেশের কৃষকরা শস্য উৎপাদনে ভালো যে কোন পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃষকদের ভেষজ বালাইনাশকের সাথে পরিচিত করানোর পাশাপাশি দেশে ভেষজ উদ্ভিদ উৎপাদন তৎপরতাও ত্বরান্বিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তা হলে বাণিজ্যিকভাবে ভেষজ বালাইনাশক পর্যাপ্ত্ত পরিমাণে উৎপাদন করা সহজতর হতে পারে। তাছাড়া ভেষজ বালাইনাশক বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্যও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কৃষক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ভেষজ বালাইনাশক সরবরাহ কর প্রয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব হলেই কেবল মানসম্পন্ন খাদ্য-শস্যের জোগান বাড়ানো যেতে পারে। আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর জন্য মানসম্পন্ন খাদ্য-শস্যের যোগান পাবার বিকল্প নেই। তাই এ ক্ষেত্রে সাফল্য নিশ্চিত করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।

[লেখক : সাবেক ব্যাংকার ]

No comments:

Post a Comment