Wednesday, October 20, 2010

দেখেই মেশিন তৈরি করতে পারেন বগুড়ার আমির হোসেন

দেখেই মেশিন তৈরি করতে পারেন বগুড়ার আমির হোসেন

আসাদুজ্জামান ফিরোজ
একবার চোখে দেখেই তৈরি করেন মেশিন। তাই তার আবিষ্কারের ঝোলায় যোগ হয় নিত্যনতুন সব আইটেম। তিনি আমির হোসেন। তার বাবা বগুড়া শহরের ঠিকাদারপাড়া লেনের ধলু মেকার প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ গড়ে তোলেন ১৯৪০ সালের দিকে। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তত্কালীন বগুড়ার ডিসির নির্দেশে ধলু মেকার সতর্কতামূলক সাইরেন মেশিন তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এই ধলু মেকার নিজেই হস্তচালিত লেদ মেশিন তৈরি করে বগুড়াসহ উত্তরবঙ্গে আলোচনায় আসেন। তিনি ১৯৮৮ সালের ১৩ নভেম্বরে মারা যাওয়ার পর রহিম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের দায়িত্ব নেন ছেলে আমির হোসেন। বর্তমানে ওয়ার্কশপটি ওই এলাকায় রয়েছে। আমির হোসেনের হাতেখড়ি হয় তার বাবা ধলু মেকারের কাছে। ধলু মেকারের ৮ ছেলেমেয়ের মধ্যে আমির হোসেন চতুর্থ। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই শুরু হয় গবেষণা। প্রকৌশলী আমির হোসেন ২০০৩ সালে বুয়েট থেকে বিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি ও জিটিজেড থেকে কৃষি সামগ্রী উদ্ভাবনের ওপর প্রশিক্ষণ নেন। এ কাজে আমির হোসেনকে সাহায্য করেন তার দ্বিতীয় মেয়ে আসমা খানম আশা ও তৃতীয় মেয়ে তাহিয়া খানম।
আবিষ্কার : নিজের চোখে যা দেখেন অবিকল সেটিই তৈরি করার কারিগর আমির হোসেন ১৯৯১ সালে ইট ও পাথর ভাঙা মেশিন উদ্ভাবন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একের পর এক তৈরি করেছেন বিভিন্ন মেশিন।
অটোব্রিকস মেশিন : ২০০৩ সালে আমির হোসেন বানিয়েছেন অটোব্রিকস তৈরি মেশিন, যা চীনের তৈরি অটোব্রিকস মেশিনের চেয়ে একটু উন্নত। এই মেশিনটি পরবর্তী সময়ে চলতি বছরে আরও আধুনিক করা হয়েছে। আগে তৈরি করা মেশিনটি বিদ্যুত্ ও স্যালো মেশিন দিয়ে চলত। এবারেরটি বিদ্যুত্ ছাড়া। মেশিনটি তৈরি করা হয়েছে ২টি স্যালো মেশিন দিয়ে। জনবল লাগবে মাত্র ২০ জন। প্রতি ঘণ্টায় ইট তৈরি হবে ১৫০০ থেকে ২০০০টি। জ্বালানি তেল লাগবে ৩ লিটার। মেশিনটি ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে। ইটের গুণগতমান বিদেশি মেশিনের মতোই। দুই সাইজের মেশিনের মধ্যে একটি মুভিং সিস্টেম রয়েছে, যা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সহজে নেয়া যাবে। দাম ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা।
জ্বালানিবিহীন গাড়ি : জ্বালানিবিহীন গাড়ি তৈরি করে আলোচনায় চলে এসেছেন আমির হোসেন। এখন ছাড়পত্রের অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি। ২৫০ কেজি ওজনের এ গাড়ি পরিবেশ সহায়ক এবং দেশীয় যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি। ড্রাইভারসহ ৫ জন নিয়ে এ গাড়ি ঘণ্টায় ৭০/৮০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। গাড়ি চলার সময় ব্যাটারি রিচার্জ হয়ে যাবে। গাড়িতে ব্যবহার করা হয়েছে ১২ ভোল্টের ৫টি সেকেন্ডারি সেল। ৬০ ভোল্টের ডিসি মোটর এ গাড়ি চালাবে। তেল-মবিল লাগবে না। গাড়ির দাম মাত্র আড়াই লাখ টাকা। গাড়ির মডেল করা হয়েছে হিটলার ও রাণী এলিজাবেথের ব্যবহার করা দুটি গাড়ির মডেলের আদলে। এছাড়াও নিত্যনতুন গাড়ি তৈরির গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। গবেষণায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে ১২০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন জ্বালানিবিহীন গাড়ি।
ধান কাটা মেশিন : হালকা ও শস্তা ধান কাটার মেশিন তৈরি করেছেন প্রকৌশলী আমির হোসেন। ২ ঘণ্টায় এক বিঘা জমির ধান কাটা যাবে এ মেশিন দিয়ে। খরচ হবে ২ লিটার পেট্রোল। মেশিনটির ওজন ১০/১৫ কেজি। দাম ৮/১০ হাজার টাকা। যন্ত্রটির বৈশিষ্ট্য হলো—ধানের গাছ যে অবস্থায় থাক না কেন সে অবস্থায়ই কাটা যায়। এ মেশিন আরও শস্তা ও আধুনিক করার জন্য কৃষিমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের সহযোগিতা চেয়েছেন আমির হোসেন। বর্তমানে সোলার পাওয়ারের সাহায্যে মেশিন চালানোর জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
অটো জৈব ও মিশ্র সার : অটো জৈব ও মিশ্র সার মেশিন তৈরি করে সারা দেশে ব্যাপক আলোচনায় এসেছেন আমির হোসেন। মেশিনটি শ্রেণীভেদে দাম দেড় লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। মেশিনের প্রকারভেদে সার উত্পন্ন হয় ১০০ কেজি থেকে ১ টন পর্যন্ত। এরই মধ্যে এ জৈব ও মিশ্র সার তৈরির মেশিনটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলায় ব্যবহৃত হচ্ছে। সুফলও পাচ্ছেন সাধারণ কৃষকরাও।
ফিশ ফিড ও পোলট্রি ফিড : আধুনিক মানে তৈরি করেছেন ফিশ ফিড ও পোলট্রি ফিড। প্রকারভেদে এ মেশিনগুলোর মূল্য ২৫ হাজার টাকা থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে রয়েছে অটো মেশিন, যার সুফল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ফিশ ও পোলট্রি ফিড ব্যবসায়ীরা ভোগ করতে শুরু করেছে।
অন্যান্য : আমির হোসেন আরও আবিষ্কার করে এরই মধ্যে বাজারজাত করেছেন অনেক মেশিন। এর মধ্যে রয়েছে রেলগাড়ি, ইটভাঙা মেশিন, সেমাই তৈরি মেশিন, গো-খাদ্য অটো মেশিন, মিক্সচার মেশিন, ভুট্টা মাড়াই ও ভাঙা মেশিন শুঁটকি মাছ, ঝিনুক খৈল ক্রাশার মেশিন, সিলিকন ভাঙা অটো মেশিন, পল্গাস্টিক পাইপ তৈরি মেশিন। এছাড়াও রয়েছে আদা, রসুন, মরিচ ও সস তৈরি অটো ক্রাশার মেশিন। আম, আনারস, টমেটো, কমলালেবু ক্রাশার মেশিন, ড্রাম সিডার চাষ ছাড়াই বীজ বপন যন্ত্র, শস্য মাড়াই যন্ত্র।
আমির হোসেনের মতামত : এতকিছু করেছি সবই নিজ উদ্যোগে। এগুলো করতে গিয়ে কখনও গচ্ছিত টাকায়, কখনও স্ত্রীর গয়না বিক্রি, কখনও ঋণ করতে হয়েছে। কিন্তু সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা বা সহযোগিতা পাইনি। এমনকি ব্যাংকও এসব গবেষণা কাজে কোনো সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি। আমি মনে করি, যারা নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে চায় তাদের জন্য সুদবিহীন ঋণের ব্যবস্থা করা উচিত। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কলয়া খনিতে বিকল মেশিনগুলো খুব কম দামে মেরামত করা সম্ভব। অথচ তা না করে কোটি কোটি টাকা দামের মেশিনগুলো খোলা আকাশের নিচে ফেলে নষ্ট করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ারও দাবি জানান তিনি। যোগাযোগ : ০১৭১৫-৩১৯৯৩৭

No comments:

Post a Comment