Monday, September 26, 2011

বরফবাক্স : মাছ সংরক্ষণের সাশ্রয়ী কৌশল

বরফবাক্স : মাছ সংরক্ষণের সাশ্রয়ী কৌশল

লেখক: আব্দুসসালাম সাগর, বাকৃবি, ময়মনসিংহ |

Details

বাংলাদেশে মাছ ধরার পর থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণের প্রতিটি ধাপে মত্স্যজীবী, মাছ ব্যবসায়ী বা মাছ পরিবহনকারীদের অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণে বিপুল পরিমাণ মাছ পচে নষ্ট হয়ে যায়। মাছ ধরার পর থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত গুণাগুণ প্রায় ২৫ থেকে ২৮ শতাংশও টিকে থাকে না। মাছ পচনের এসব ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে মাছ সংরক্ষণ ও পরিবহনের জন্য বরফ বাক্সের ব্যাপক প্রচলনের ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। সমপ্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাত্স্যবিজ্ঞান অনুষদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিশিষ্ট মত্স্যবিজ্ঞানী ও বাকৃবির অধ্যাপক ড. এ.কে.এম. নওশাদ আলম এসব তথ্য দেন।

অধ্যাপক ড. নওশাদ আলম জানান, এফএও এর অর্থায়নে মত্স্য বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত ‘উপকূলীয় মত্স্যজীবীদের জীবিকার নিরাপত্তার জন্য ক্ষমতায়ন (ইসিএফসি)’ শীর্ষক এক প্রকল্পের গবেষণায় দেখা গেছে, মাছ ধরার পর পর মাছকে যথোপযুক্ত বরফ বাক্সে রেখে পরিমাণমত বরফ দিলে মাছের আহরণোত্তর ক্ষতি প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব। বর্তমান সময়ে সঠিকভাবে বরফ বাক্সে মাছ সংরক্ষণ ও পরিবহনের ফলে বছরে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে, যা আমাদের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখছে।

মত্স্যজীবী ও মাছ ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত করে মাছ পরিবহন ও সংরক্ষণের জন্য ড. নওশাদ আলম দেশীয় বস্তু দিয়ে তৈরি কয়েকটি আদর্শ ও ব্যয় সাশ্রয়ী বরফ বাক্স তৈরি করেছিলেন। বর্তমান সময়ে এসব বরফ বাক্স দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি হিসেবে বর্তমানে দেশে বছরে মাছ উত্পাদন প্রায় ২৮ লক্ষ মেট্রিক টন। যথাযথ পরিচর্যার অভাবে এর প্রায় চার ভাগের এক ভাগ অর্থাত্ প্রায় ৭ লক্ষ মেট্রিক টন মাছ খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায়।

ইসিএফসি এ প্রকল্পটি ২০০১ সাল থেকে শুরু হয়ে চলমান থাকে ৬ বছর। তবে মাছ পরিবহন ও অবিক্রিত মাছ বরফে সংরক্ষণ করে পরে বিক্রির জন্য বরফ বাক্সের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তে থাকে। কক্সবাজার থেকে শুরু হলেও এই সহজ ও টেকসই প্রযুক্তিটি চট্টগ্রাম, ঢাকা, যশোর, খুলনা, সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের প্রধান প্রধান মাছ উত্পাদন ও ব্যবসা অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ ২০১১ সালে এসে

দেখা যায় দেশের প্রায় সকল মত্স্য কেন্দ্র, আড়ত ও মাছ বাজারে বরফ বাক্সের ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে বলে দাবি করেন ড. নওশাদ আলম। ড. নওশাদ আলম সম্পাদিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দাউদকান্দি প্লাবনভূমি মত্স্য প্রকল্পের মাছ একটির উপর আর একটি বসানো পর পর ২টি বাঁশের ঝুড়িতে রেখে ট্রাকে পরিবহন করে চট্টগ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ২৭ ভাগ মাছ পচে নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে মাছ চাষিরা ৩০ শতাংশ মূল্য কম পেয়েছেন। অবিক্রিত মাছ সংরক্ষণের জন্য বরফ বাক্স অপেক্ষাকৃত ছোট বরফ বাক্স (৩০ x ২৪ x ১৮ ইঞ্চি) এবং ট্রাকে মাছ পরিবহনের জন্য কমিউনিটি বরফ বাক্সের (৬ x ৩ x ৩ ফুট) ব্যবহার করা হয় যেটি তুলনামূলকভাবে বড় আকারের। প্রয়োজনের তাগিদে মাছ পরিবহনকারীরা ডিজাইনে কিছুটা পরিবর্তন করে নিয়েছেন। বড় বাক্সে শীতকালে বরফসহ ২৫০ থেকে ২৮০ কেজি ও গ্রীষ্মকালে বরফসহ ২০০ থেকে ২২০ কেজি এবং ছোট বাক্সে শীতকালে বরফসহ ১২০ থেকে ১৫০ কেজি ও গ্রীষ্মকালে ৮০ থেকে ১২০ কেজি মাছ পরিবহন করা হয়।

মাছ সংরক্ষণ ও পরিবহনে ব্যবহূত এই বরফ বাক্সগুলো তৈরির জন্য দেশব্যাপী অসংখ্য ছোট-বড় উদ্যোক্তা ও নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এখন কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও সাতক্ষীরায় বাণিজ্যিকভাবে এই সকল বরফ বাক্স তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করার ফলে মাছের পচন অনেকাংশে কমে গিয়ে মাছের গুণাগুণ ঠিক থাকছে। বরফ বাক্সের ব্যবহার ও উন্নত পরিচর্যার ফলে মাছের আহরণোত্তর পচন ২৮ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে বলে অতি সমপ্রতি এফএও এর অর্থায়নে ড. নওশাদ আলমের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘বাংলাদেশে মাছ আহরণের পর তার গুণগত মান হ্রাস: খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণায় জানা গেছে। গত এক দশকে মাছের আহরণোত্তর ক্ষতি প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে আসাতে এখন বছরে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। সরকারি সহায়তা পেলে মাছ সংরক্ষণ ও পরিবহনের এই প্রযুক্তিটি দেশে ব্যাপকভাবে সমপ্রসারিত হয়ে মাছের পচন আরো কমে গিয়ে জনগণের আমিষের চাহিদা বহুলাংশে মেটাতে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

Source: Daily Ittefaq

No comments:

Post a Comment