Sunday, October 10, 2010

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজির আদ্যোপান্ত

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজির আদ্যোপান্ত

০০ গাজী আব্দুল হাদী 
বাংলাদেশে মেরিন টেকনোলজির উপরে শিক্ষার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। বর্তমান সময়ে এ শিক্ষার প্রচুর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও দেশে শুধুমাত্র দুইটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মেরিন একাডেমী, চট্টগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি। এ প্রতিষ্ঠান দুইটিতে মেরিন বিষয়ে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়া হয়। স্বাধীনতার পূর্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে নয় একর জমি নিয়ে মেরিন ডিজেল ট্রেনিং সেন্টারের যাত্রা শুরু। যা বর্তমানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি নামে পরিচিত।

দেশে ও আন্তর্জাতিক বাজারে জাহাজ শিল্পে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা থাকায় ১৯৭৯ সালে আধুনিক সিলেবাস ও কারিকুলামে চার বছর মেয়াদি ডিপেস্নামা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ও দুই বছর মেয়াদি সার্টিফিকেট ইন ট্রেডকোর্স চালু হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবন দুইটি, ছাত্রাবাস দুইটি, পর্যাপ্ত ওয়ার্কশপ মেকানিক্যাল, আইসি ডিজেল ইঞ্জিন ওয়ার্কশপ, মোল্ডলফট, ইলেকট্রিক্যাল, টারবাইন এন্ড ওয়েল্ডিং, শেফটি এন্ড ফায়ার এন্ড রেফ্রিজারেটর এন্ড এয়ারকন্ডিশনিং। এছাড়াও কম্পিউটার ল্যাব, সাইন্স ল্যাব, শীপবিল্ডিং ল্যাব, ড্রইং ল্যাব-৩টি, ক্ল্যাস রুম ১৪টিসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হলেও ভাইস প্রিন্সিপাল, সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর ১৩টি পদের মধ্যে ৮টি শূন্য। বাকি ৫ জনের একজন নিরুদ্দেশ, একজন জনশক্তি বু্যরোতে উপ-পরিচালক পদে দায়িত্বে আছেন এবং একজন এক বছর পর এলপিআরে যাবেন। ইন্সট্রাক্টর ২৭টি পদের ১৬টি শূন্য, ১১ জনের একজন বিদেশে, তিনজন জনশক্তি বু্যরোতে উপ-পরিচালিক পদে পদায়নের প্রক্রিয়া চলছে। ওয়ার্কশপ সুপারিনটেনডেন্ট ৩টির দুইটি শূন্য, বাকি একজন আছেন তারও জনশক্তি বু্যরোতে উপ-পরিচালক পদে পদায়নের প্রক্রিয়া চলছে। ক্রাফট ইন্সট্রাক্ট্রর ১৪টির মধ্যে তিনটি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। পদগুলো শূন্য থাকায় ও দক্ষ শিক্ষকের অভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠদানে অসুবিধা হচ্ছে।

ভর্তি প্রক্রিয়া: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজিতে এসএসসি বা সমমান পাসকৃত যে কোন বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী জুন-জুলাইতে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ছাত্র ভর্তির উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রতিটি কোর্সে সকাল-বিকাল দুই শিফটে ভর্তির সুযোগ রয়েছে। আবেদনপত্র বাছাই শেষে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্র ভর্তির তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। চার বছর মেয়াদি ডিপেস্নামা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, দুই বছর মেয়াদি সার্টিফিকেট ইন ট্রেড কোর্স ও স্বল্প মেয়াদিসহ মোট তিনটি কোর্স পরিচালিত হচ্ছে

কোর্সগুলো: চার বছর মেয়াদি ডিপেস্নামা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে দুইটি কোর্স রয়েছে। যেমন- মেরিন টেকনোলজি ও শীপবিল্ডিং টেকনোলজি। দুই বছর মেয়াদি সার্টিফিকেট ইন ট্রেড কোর্স চারটি। কোর্সগুলো হচ্ছে: মেরিন ডিজেল ইঞ্জিন আর্টিফিসার, শীপবিল্ডিং ওয়েল্ডিং, শীপ ফেব্রিকেশন (পেস্নটার), শীপবিল্ডিং এন্ড মেকানিক্যাল ড্রাফটিং। প্রতিটি কোর্সে বছরে ৪৮ জন ছাত্র-ছাত্রীর ভর্তির সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে শতকরা ১০% ভাগ ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত।

স্বল্পমেয়াদি কোর্সগুলো: কম্পিউটার অ্যাপিস্নকেশন ও নেটওয়ার্কিং এবং ট্রাবলশুটিং, সর্বনিম্ন এসএসসি পাস, ৬ মাস, আসন ৪০টি, অটো ক্যাড (থ্রি-ডি ও টু-ডি) কম্পিউটার জ্ঞানসম্পন্ন ও এসএসসি পাস, ৬ মাস ৪০টি। জি-৬ ওয়েল্ডিং ৩ মাস, আসন ৪০টি। টিগ, মিগ, এবং ম্যাগ ওয়েল্ডিং, দেড় মাস, আসন-২০টি। শর্টকোর্সগুলো কাগজপত্রে চালু থাকলেও শিক্ষক সংকটের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে।

ডিজেল ও মেরিন বিভাগ:আইসি ডিজেল ইঞ্জিন ওয়ার্কশপের ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর মোঃ আব্দুল মঈদ বলেন, ডিজেল ইঞ্জিন ওয়ার্কশপে ইন্সট্রাক্টরের একটি পদ ১৪ বছর ও অপর একটি গত ৬ বছর ধরে শূন্য রয়েছে। এ পদগুলো শূন্য থাকার কারণে ছাত্রদের পাঠদানে ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে। এছাড়া শূন্য পদগুলো পূরণের ক্ষেত্রে কারিগরি দক্ষ শিক্ষকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।

ডাইনিং: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজিতে দুইটি ছাত্রাবাস রয়েছে। ছাত্রাবাস দুইটিতে প্রায় তিন শতাধিক ছাত্র অবস্থান করছে। এরা ডাইনিংয়ে খেয়ে থাকে। ডাইনিংয়ে মোট ৬ জন কর্মচারী। দুইজন কুক। চার কর্মচারী ছাত্র ও প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় চলছে। ডাইনিংয়ের জন্য ছাত্রপ্রতি প্রতিদিন ৪৫ টাকা নেয়া হয়। সকালে ডাল, ভাজি, আলু ভর্তা বা খিচুরি। দুপুরে একদিন মাছ, একদিন মাংস খাওয়ানো হচ্ছে। ডাইনিংয়ের রান্নার ঘর ও পরিবেশনের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত হলেও ছাত্রদের অভিযোগ টাকার অনুপাতে খাবার ভাল হয় না।

ডাইনিং-এর ব্যাপারে হোস্টেল সুপার মোঃ শামসুল ইসলাম বলেন, ছাত্রদের তুলনায় ডাইনিং স্পেস অনেক ছোট। রান্নাঘরসহ ডাইনিং স্পেস সম্প্রসারণ অথবা উপরে বাড়ানো দরকার। এ ব্যাপারে ঊধর্্বতন মহলের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

ছাত্রাবাস: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজিতে মোট ১৫০০ ছাত্রছাত্রীর জন্য দুইটি ছাত্রাবাস রয়েছে। ছাত্রাবাস দুইটির একটিতে ১৯০ জন অপরটিতে মাত্র ৮০ জন ছাত্রের বসবাসের সুযোগ থাকলেও সেখানে সিটের অভাবে অতিরিক্ত ছাত্র বসবাস করছে। এ প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের পাশাপাশি বর্তমানে ছাত্রীরাও ভর্তি হচ্ছে। ছাত্রীদের জন্য কোন ছাত্রাবাস নেই। বর্তমানে ৬০-৬৫ জন ছাত্রী এখানে পড়াশুনা করছে। তাদের মধ্যে ৩০ জন ছাত্রীকে অফিসারদের জন্য নির্ধারিত কোয়ার্টারে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। কোন বাউন্ডারী ওয়াল নেই। বিল্ডিংটি জরাজীর্ণ। খুব দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। ছাত্রীদের জন্য কোন হোস্টেল সুপার নেই, নেই রান্নার কোন কর্মচারী।

ছাত্রাবাসের ব্যাপারে হোস্টেল সুপার শামসুল ইসলাম বলেন, এ প্রতিষ্ঠানে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-ছাত্রীর জন্য দুইটি ছাত্রাবাস। মাত্র ২৭০টি সিট রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে ছাত্ররা এখানে ভর্তি হয়। কিন্তু আমরা তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে পারছি না। ছাত্ররা বিভিন্ন মেসে অথবা বাসা বাড়িতে থেকে কষ্ট করে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। আরো দুইটি ছাত্রাবাস নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প জমা দেয়া আছে। ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত বিল্ডিংটির অবস্থা জরাজীর্ণ। এটার বাউন্ডারি ওয়াল দরকার। দরকার সংস্কারেরও। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি টিটিসিতে হোস্টেল সুপারের আবাসিক ব্যবস্থা থাকলেও এখানে হোস্টেল সুপার ও সহকারী সুপারের আবাসিক ব্যবস্থা নেই। এমনকি প্রশাসনিক ভবনে কোন অফিস নেই।

শরীর চর্চা কেন্দ্র: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজিতে একটি শরীরচর্চা কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে কোন ইন্সট্র-মেন্ট নেই। রুমটি দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ। ছাত্ররা জানান, ভর্তির সময় এ বাবদ আমাদের থেকে টাকা নিলেও এখানে শরীর চর্চার কোন সুযোগ নেই।

প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজিতে একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। একজন মেডিক্যাল অফিসার ও একজন কম্পাউন্ডার রয়েছেন। কিছু ওষুধপত্র থাকলেও প্রয়োজনের তুলনা কম। চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কোন বরাদ্দ নেই। বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ছাত্রদের সহযোগিতা ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাথর্ীদেরকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়।

বৃত্তি:চার ও দুই বছর মেয়াদি কোর্সের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রয়েছে বৃত্তির ব্যবস্থা। ছাত্রপ্রতি মাসে ২৫০ টাকা করে বৃত্তি দেয়া হয়। এছাড়া চার ও দুই বছর মেয়াদি ছাত্রদের কোর্স শেষে চাকরির ট্রেনিং পিরিয়ডে ছাত্রপ্রতি ছয় মাস ৫০০ টাকা করে দেয়া হয়।

ছাত্রদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা:বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজিতে চাকরি সহায়তা কেন্দ্র না থাকলেও তারা আইএলও এবং বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে পাসকৃত ছাত্রদের দেশে-বিদেশে চাকরির ব্যবস্থা করে থাকেন। দীর্ঘদিন আহমদ এন্ড কোং, মেরিন কন ও খান এন্ড ব্রাদার্স-এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে যেমন- সিঙ্গাপুর, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে পাসকৃত ছাত্ররা চাকরি নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া দেশীয় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন-শীপইয়ার্ড, ওয়েস্টার্ন মেরিন, আনন্দ বিল্ডার্স, হাইস্পিড, বসুন্ধরা হাইস্পিড ও শীপবিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিদু্যৎ পস্ন্যান্টে উচ্চ বেতনে চাকরির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

আহমদ এন্ড কোং-এর ট্রেনিং সেন্টারের ইন্সট্রাক্টর আবুল হোসেন বলেন, মেরিন থেকে পাসকৃত ছাত্রদের আন্তর্জাতিক বাজারে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। দেশেকে বেকারত্ব মুক্ত করতে নারায়ণগঞ্জ মেরিন ইনস্টিটিউটের ন্যায় একাধিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা দরকার বলে তিনি মনে করেন।০০ 
Source: Daily Ittefaq

No comments:

Post a Comment