Tuesday, January 1, 2013

জাপানে বাংলাদেশী ছাত্রের কৃতিত্ব: মাছের সেক্স পরিবর্তনের অজানা রহস্য উঘাটিত

জাপানে বাংলাদেশী ছাত্রের কৃতিত্ব:
মাছের সেক্স পরিবর্তনের অজানা রহস্য উঘাটিত
মশিউর রহমান : সমুদ্রে এমন কিছু মাছ বসবাস করে যারা জীবনের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে সেক্স পরিবর্তন করে পুরুষ মাছ স্ত্রীতে অথবা স্ত্রী মাছ পুরুষ মাছে রূপান্তরিত হয়। ঠিক কী কারণে এসব মাছ সেক্স পরিবর্তন করে তা এতদিন বিজ্ঞানীদের অজানা ছিল। সম্প্রতি জাপানের ওকিনাওয়ার রিউকিউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে গবেষণারত বাংলাদেশী ছাত্র ড. মোহাম্মদ আশরাফুল আলম এ অজানা রহস্য উঘাটন করতে সমর্থ হয়েছেন। উদ্ভাবনের স্বীকৃতি হিসেবে গত ১১ সেপ্টেম্বর তাকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান প্রেসিডেন্ট পদকে ভূষিত করা হয়।
ড. আলম জানান, সেক্স পরিবর্তনকারী মাছের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কোরাল রীফে (প্রবালের খাঁজ) বসবাসকারী গ্রুপার (Grouper) মাছ। এ গ্রুপার মাছ প্রথমে স্ত্রী হিসেবে জন্মগ্রহণ করে ও পরিপক্কতা লাভ করে এবং এক বা একাধিকবার প্রজননে অংশ নেয়। এসব স্ত্রী মাছ পরবর্তীতে সেক্স পরিবর্তন করে পুরুষ মাছে রূপান্তরিত হয় এবং সক্রিয় পুরুষ মাছ হিসেবে প্রজননে অংশগ্রহণ করে। গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান প্রেসিডেন্ট পদকে ভূষিত হন।
মজার ব্যাপার হলো এসব মাছ আর কখনই পূর্বের সেক্সে ফিরে আসে না। কিন্তু কিভাবে এই গ্রুপার (Grouper) মাছ সেক্স পরিবর্তন করে সক্রিয় পুরুষ মাছে রূপান্তরিত হয় তাই ছিল ডঃ মোহাম্মদ আশরাফুল আলমের গবেষণার বিষয়বস্তু। তিনি প্রথমবারের মতো তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, স্ত্রী মাছের গোনাডের (প্রজনন অঙ্গ) মধ্যে এক ধরনের বিশেষ কোষ আছে যারা পুরুষ হরমোন (এন্ড্রোজেন) তৈরি করে। সাধারণত এসব মাছ যখন তার মূল দৈর্ঘ্যের দুই-তৃতীয়াংশ বড় হয় তখনই এই বিশেষ কোষগুলো এন্ড্রোজেন তৈরি শুরু করে এবং স্ত্রী মাছ ধীরে ধীরে পুরুষ মাছে রূপান্তরিত হয়। আর এ অনবদ্য গবেষণার জন্য ড. আলম জাপান সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান প্রেসিডেন্ট পদকে ভূষিত হন।
তিনি আরও দেখিয়েছেন যে, এ পরিবর্তনের সময় স্ত্রী মাছের (ফিমেল স্পেসেফিক) জিনগুলো ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং তাদের প্রকাশ (expression) কমে যায়। অন্যদিকে এ সময় পুরুষ মাছের (মেইল স্পেসেফিক) জিনগুলো সক্রিয় হয় এবং এদের প্রকাশ (expression)-এর পরিমাণ বেড়ে যায়। আর এভাবেই স্ত্রী মাছটি পুরুষ মাছে রূপান্তরিত হয়। ড. আলমের এ গবেষণা সম্পর্কিত ১০টি নিবন্ধ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ড. আলমের জাপানের পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক মাশারু নাকামুরা জানান, এটি একটি অনবদ্য ও যুগান্তকারী উদ্ভাবন। এর ফলে কৌলিতত্ত্ব গবেষণায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা হলো।
ড. আলমের বাংলাদেশের এমএস তত্ত্বাবধায়ক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ সামছুল আলম বলেন, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা সুযোগ পেলে মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ড. আলম। তিনি কৌলিতত্ত্ব গবেষণায় পদক লাভ করে দেশের সুনাম বাড়িয়েছেন। ড. মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, বাংলাদেশের সমুদ্রে প্রবালের খাঁজে ভেটকি বা কোরাল মাছও ওইভাবে সেক্স পরিবর্তন করে। তিনি তার গবেষণালব্ধ জ্ঞান দেশ ও জাতির সেবায় কাজে লাগাতে চান।
মাছের সেক্স পরিবর্তনের সময় ব্রেন (মস্তিষ্ক) কি ভূমিকা পালন করে বর্তমানে এর ওপর তিনি তার গবেষণা কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। মাছের সেক্স পরিবর্তনের বর্তমান জ্ঞানের বাইরে কারো কোন প্রস্তাবনা থাকলে তার ল্যাবে উচ্চতর গবেষণার সুযোগ আছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
ড. মোহাম্মদ আশরাফুল আলম ১৯৭৭ সালে টাঙ্গাইল জেলার মগড়া ইউনিয়নের ভিতর শিমুল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। টাঙ্গাইলে পড়াশুনা শেষ করে ১৯৯৩-১৯৯৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি হন এবং ১৯৯৭ সালের (২০০০ সনে অনুষ্ঠিত) বিএসসি ফিসারিজ অনার্স চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ২০০২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্সে এ প্লাস (A+) প্রাপ্ত হন। ২০০২ সালে তিনি ডেনমার্কের Aarhus বিশ্ববিদ্যালয় হতে জেনেটিক্স ডাটা এনালাইসিস-এর সফটওয়ারের ওপর প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেন। অতঃপর ২০০৩ সালে জাপান সরকার প্রদত্ত মনোবুকাগাকুশো বৃত্তি নিয়ে জাপানের ওকিনাওয়ার রিউকিউ বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এস শুরু করেন এবং এ ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাছের সেক্স পরিবর্তনের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। পিএইচডিতে অনন্য গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান প্রেসিডেন্ট পদকে ভূষিত হন।

No comments:

Post a Comment