Thursday, July 1, 2010

প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে এগুচ্ছে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো

প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে এগুচ্ছে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো

০০ রেজা মাহমুদ

১৯৫০'র দশকের শেষদিকে জাপান নতুন প্রযুক্তি ও নতুন পণ্য উদ্ভাবনের মাধ্যমে শিল্প-বাণিজ্যের দিক দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল। ঠিক একইভাবে নতুন প্রযুক্তি ও পণ্য উদ্ভাবন করে উন্নত দেশগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এ মুহূর্তে বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্রাজিল, চীন, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও মেক্সিকো। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনীর এই চ্যালেঞ্জে নেতৃত্ব দিতে প্রতিবছর উদীয়মান দেশগুলোতে লাখ লাখ গ্রাজুয়েট প্রকৌশলী পাস করে বের হচ্ছে। জাতিসংঘ বিনিয়োগ প্রতিবেদন, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্য ও ইকোনোমিস্ট ম্যাগাজিনের সামপ্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ বিষয়টি।

১৯৫০'র দশকে নতুন সব পণ্য উদ্ভাবনের মধ্যদিয়ে শিল্প বাণিজ্যের অঙ্গনে আমেরিকা ও ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোরদার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশ জাপান। ১৯৮০'র দশকে আমেরিকার গাড়ি নির্মাতা শিল্পগোষ্ঠির নির্বাহী কর্মকর্তারা দেখতে পান যে তাদের সরিয়ে দিয়ে এ ক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে উঠে বসেছে জাপান। জাপানি গাড়ীগুলো একদিকে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ির চেয়ে স্বল্পমূল্যের, অন্যদিকে এগুলো ছিল অধিক টেকসই। তারা নতুন মডেলের গাড়ি অত্যন্ত দ্রুত তৈরী ও বাজারজাত করতে সক্ষমতা দেখায়। মার্কিন গাড়ী নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাহীরা এর কারণ অনুসন্ধান করতে জাপান সফরে আসেন। মার্কিনীরা ধারণা করেছিল জাপানি গাড়ী নির্মাতাদের এই সফলতার কারণ হয়তো সহায়ক শিল্পনীতি বা সরকারী ভতর্ুকি। কিন্তু তারা দেখতে পান নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনই জাপানিদের এগিয়ে নিচ্ছে সফলতার সঙ্গে। তারা জাপানের এ পদ্ধতির নাম দেন 'বিশেষভাবে ঝুঁকে পড়া' (লিন ম্যানুফ্যাকচারিং) পণ্য উৎপাদন পদ্ধতি।

এই মুহূর্তে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোও একইভাবে নিত্যনতুন প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য উদ্ভাবনের মাধ্যমে শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে উন্নত বিশ্বকে। আজ ইউরোপের ঘরে ঘরে তুরস্কের ইলেক্ট্রনিক্স ও ইলেক্ট্রিক পণ্যসামগ্রী অত্যন্ত জনপ্রিয়। শুধু তা-ই নয় তুরস্কের তৈরী ভারি ও উচ্চ প্রযুক্তির মেশিনারিজ রফতানিও ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সাথে চীন ও মালয়েশিয়ার শিল্পজাত পণ্য বিশ্বের পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্রই সমাদৃত হচ্ছে। বিপুল জনসংখ্যার চীন ও ভারতের অভ্যন্তরেই রয়েছে বিশাল ভোক্তা গোষ্ঠি। ব্রাজিল ও রাশিয়াও পিছিয়ে নেই। এ মুহূর্তে উদীয়মান অর্থনীতির এই দেশগুলো বাণিজ্যিক উদ্ভাবনের এক উষ্ণ ক্ষেত্র। ঠিক যেমনটি ঘটেছিল ১৯৫০'র দশকে জাপানের বেলায়।

চীন, তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার মত দেশগুলো নিত্যনতুন পণ্য ও সেবা নিয়ে হাজির হচ্ছে। আর এগুলো নাটকীয়ভাবে পশ্চিমা দেশের তুলনায় কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। এ দেশগুলো ৩০০০ ডলারে গাড়ি, ৩০০ ডলারে কম্পিউটার আর ৩০ ডলারে মোবাইল ফোন সরবরাহ করছে। এই মোবাইল ফোনগুলো প্রতি মিনিটে মাত্র ২ সেন্ট খরচে (সংশিস্নষ্ট) দেশব্যাপী সার্ভিস দিচ্ছে। এসব দেশ পণ্য তৈরি ও সরবরাহের নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করছে। এমনকি তারা সম্পূর্ণ নতুন মডেলের ব্যবসায় পদ্ধতি উদ্ভাবন ও অনুসরণ করছে। সাপস্নাই চেইন ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন করছে উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিগুলো।

যেসব দেশ এই সেদিনও স্বল্পমূল্যের পণ্য উৎপাদন করে আসছিল তারা কিভাবে নতুন মডেল উদ্ভাবনে এত সফল হল এ প্রশ্নেরও জবাব মিলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে অদম্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর প্রতিযোগী কোম্পানির ভীতি এ দু'য়ের মিশ্র তাড়নায় নয়া প্রযুক্তি ও পণ্য উদ্ভাবনে এগিয়ে যাচ্ছে এসব দেশের কোম্পানিগুলো।

জাতিসংঘ বিনিয়োগ প্রতিবেদনে দেখা গেছে বর্তমানে প্রায় ২১,৫০০ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি গড়ে উঠেছে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে। এর মধ্যে চীনের 'বিওয়াইডি' ব্যাটারি উৎপাদনে, ব্রাজিলের 'এমব্রায়ের' জেট বিমান নির্মাণে, তুরস্কের 'কেওসি' ভারি যন্ত্রপাতি তৈরিতে এবং মালয়েশিয়ার 'পেট্রোনাস' খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানে উন্নত বিশ্বের সমক্ষেত্রের মাল্টিন্যাশনালের সাথে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সামপ্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সংখ্যা সামপ্রতিক কয়েক বছরে অনেক বেড়ে গেছে। একই সময়ে উন্নত দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও এখন উদিয়মান এসব বাজারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছে। উদীয়মান দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মেধাসম্পন্ন জনশক্তি সহজপ্রাপ্ত হওয়ায় মুনাফা বেশি পাওয়ার আশায়ই এই বিনিয়োগ বৃদ্ধি। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আশা করছে আগামী কয়েক বছরে ৭০ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই আসবে উদীয়মান দেশগুলো থেকেই।

ফরচুন ৫০০ তালিকায় দেখা গেছে 'জেনারেল ইলেকট্রিকস', 'সিসকো', 'মাইক্রোসফট' প্রভৃতি কোম্পানি উদীয়মান দেশগুলোতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে। উন্নত ও উদীয়মান উভয়েরই বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অনুধাবন করছে যে এসব বাজারে উন্নতি করতে হলে তাদের কঠোর চেষ্টা করে যেতে হবে। কারণ উদীয়মান দেশগুলোর বড় শহরগুলোর বাইরে দূরবতর্ী এলাকায়ও বাস করে বহু ভোক্তা। এর অর্থ হচ্ছে পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ পদ্ধতির ক্ষেত্রে নতুন উদ্ভাবনের চিন্তা করতে হচ্ছে তাদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদীয়মান বিশ্বের বাজার হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। কারণ এসব জায়গায় সরবরাহ পদ্ধতি হতাশা সৃষ্টি করতে পারে, উপার্জন হতে পারে অভাবিতপূর্ব, দূষণ হতে পারে ফুসফুস দগ্ধকারী। সরকার কখনো সহায়ক কখনো হতাশাজনক নীতির অধিকারী হতে পারে এসব বাজারে। নকল প্রবণতা লাভ কমিয়ে দিতে পারে। দারিদ্র্যহতে পারে সর্বব্যাপী। মোটকথা উীয়মান বাজারে সাফল্যের দ্বীপ চারদিকে সমস্যার সাগরে ঘেরা থাকে; যা কখনো শক্তিশালী কোন কোম্পানিকেও অনেক সময় ব্যর্থ করে দিতে পারে। 'ইয়াহু!' এবং 'ই-বে' চীনে তাদের কার্যক্রম পুনর্বিন্যাস করতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে দেশটির মূল ভূখন্ড থেকে 'গুগল'কে হংকংয়ে সরে যেতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম গৃহস্থালি সামগ্রীর প্রস্তুতকারক 'বস্ন্যাক এন্ড ডেকর' চীন এবং ভারতে প্রায় অদৃশ্য অবস্থায় রয়েছে।

উদীয়মান দেশগুলোতে উলেস্নখিত সমস্যার সাথে সম্ভাবনাও রয়েছে অস্বাভাবিকভাবে বেশি। এখানে পণ্যের রয়েছে বিশাল বাজার। জনসংখ্যা রয়েছে উন্নত বিশ্বের চেয়ে অনেক বেশি আর তা বৃদ্ধিও পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ মধ্যম আয় শ্রেণীতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে। এসব দেশের অথনীতি দ্রুত প্রবৃদ্ধি লাভ করছে। কিছু কোম্পানি উন্নত দেশের মত আগের পদ্ধতি অনুসরণের ফলে ব্যয়াধিক্যের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। উদীয়মান দেশে মেধাবী জনশক্তি সহজলভ্য, সস্তা ও প্রচুর। প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক প্রযুক্তিবিদ বেরিয়ে আসছেন এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে।

উদীয়মান বাজারগুলোর চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনার এই মিশ্র অবস্থা গ্যাসভর্তি ককটেইলের মত এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কারণ এসব বাজারে একদিকে বিপুল সংখ্যক ভোক্তা হচ্ছে দরিদ্র অন্যদিকে কোম্পানিগুলোকে যেতে হচ্ছে বিপুল পণ্য সম্ভার নিয়ে। ব্যাপক নকলপ্রবণতার কারণে কোম্পানিগুলোকে তাদের পণ্যসামগ্রিতে নিত্যনতুন পরিবর্তন আনতে হচ্ছে।

সেই আশির দশকের জাপানের শিল্পোন্নত হয়ে ওঠার গল্পই আবার ফিরে এসেছে। 'টয়োটা' এবং 'হোন্ডা' এখনো টিকে আছে নব উদ্ভাবনী ও গুণগতমান ব্যবস্থাপনার সুবাদে। কারণ ভূমি এবং কাঁচামালের মূল্য এখন জাপানে অনেক বেড়ে গেছে। অন্যদিকে উদীয়মান অর্থনীতির কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এসব সমস্যা এখন সুবিধায় পরিণত হয়েছে। কারণ এসব দেশে ভূমি ও কাঁচামালের মূল্য এখনও কম। এ পর্যন্ত ব্যাপকভাবে ধারণা প্রচলিত ছিল যে বিশ্বায়ন পশ্চিমা বিশ্বের দ্বারা চালিত হয়ে বাকি বিশ্বের ওপর চেপে বসেছে। নিউইয়র্ক, লন্ডন ও প্যারিসের কাঁচঘেরা উঁচু দালানে বসে বস'রা বিশ্বায়ন নিয়ন্ত্রণ করবেন আর পশ্চিমা বিশ্বের ভোক্তারা প্রায় একচেটিয়াভাবে এর সুফল ভোগ করবেন। তবে এ ধারণা এখন আর খাটছে না। কারণ উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর ভোক্তারা পশ্চিমাদের তুলনায় দ্রুত ধনী হয়ে উঠছে।

উদ্ভাবনের পুরনো ধারণাও এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। পশ্চিমারা বিশ্বাস করত তারা গবেষণাগারে নতুন একটি ধারণা তৈরি করে তা উন্নয়নশীল বিশ্বে রফতানি করবে। কিন্তু এখন এ ধারণার অসারতা প্রমাণিত হয়েছে। এখন উদীয়মান বাজারের দেশগুলো টেলিকম থেকে কম্পিউটার পর্যন্ত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পাওয়ার হাউজে পরিণত হয়েছে।

উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো ক্রমবর্ধমানহারে নতুন প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য উদ্ভাবনে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এ ধারায় বদলে যাচ্ছে উদীয়মান শক্তির দেশগুলোর জীবনধারাও। ২০০৯ সালের পিউ গেস্নাবাল অ্যাটিচিউডস প্রজেক্টস এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে এসব দেশের ৮৫ থেকে ৯৪ শতাংশ পর্যন্ত নাগরিক তাদের জীবনযাপনের মান নিয়ে সন্তুষ্ট। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র হেনরি ফোর্ডের প্রডাকশন লাইন অনুসরণ করেছিল, জাপান লিন ম্যানুফ্যাকচারিং আর এখন উদীয়মান শক্তিগুলো তাদের স্বতন্ত্র ধারা অনুসরণ করছে। শুধু সস্তা শ্রম নয় বরং নব উদ্ভাবনই উদীয়মান শক্তিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
Source: Daily Ittefaq

No comments:

Post a Comment