Tuesday, October 19, 2010

বিদ্যুতের বিকল্প কী হতে পারে?

বিদ্যুতের বিকল্প কী হতে পারে?

দেশব্যাপী লোডশেডিংজনিত ভয়াবহ বিদ্যুতের ঘাটতি জনজীবন স্থবির করে তুলেছে। শিল্প-কলকারখানা মারাত্মক হুমকির মধ্যে। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে কিন্তু এই মুহূর্তে বিদ্যুতের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করতে পারছে না। অথচ উন্নত দেশে বিদ্যুতের রয়েছে নানা বিকল্প। যেখানে বিকল্প এসব পদ্ধতি ব্যবহার করে বিদ্যুত্ পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হচ্ছে। কন্তু কীি হতে পারে বিদ্যুতের বিকল্প? এ নিয়ে লিখেছেন— সাদ আব্দুল ওয়ালী
আমরা প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাই অথচ বিদ্যুতের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে পারছি না। দিন দিন বিদ্যুত্ সঙ্কট তীব্রতর হচ্ছে। বলতে গেলে, জনজীবন ক্রমে স্থবির হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক বিদ্যুত্ চাহিদার কাছাকাছিও আমরা যেতে পারছি না। অর্থাত্ যেমন বিদ্যুত্ উত্পাদনের কোনো লক্ষ্যমাত্রাও নেই, তেমনি নেই কোনো অগ্রগতি। সরকারেরও এ ব্যাপারে নেই কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা। বিদ্যুতের এই চরম সঙ্কটে দেশবাসী উত্কণ্ঠিত—কীভাবে মিলবে এর সুষ্ঠু সমাধান। তবে বিদ্যুতেরও রয়েছে বিকল্প। কিন্তু তা কী হতে পারে?
বিকল্প শক্তির উত্স বিদ্যুতের বিকল্প শক্তির উত্স খোঁজা হচ্ছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, সমগ্র বিশ্বে এ তত্পরতা বেড়ে চলেছে। তবে নবায়নযোগ্য শক্তিকে কাজে লাগানোর প্রয়াস অগ্রগণ্য। উন্নত দেশসহ উন্নয়নশীল দেশেও বিকল্প শক্তির প্রসারে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব বিকল্প শক্তি যেমন—সোলার প্ল্যান্ট, উইন্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট, পারমাণবিক শক্তি, ভূ-উত্তাপ শক্তি, সাগরের তাপশক্তির রূপান্তর উল্লেখযোগ্য। সৌর বিদ্যুত্-সোলার প্ল্যান্ট সোলার পাওয়ার একটি নবায়নযোগ্য উত্স। ফলে এখানে বিকল্প বিদ্যুত্ হিসেবে সোলার প্ল্যান্ট কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখতে পারবে। বাংলাদেশে বছরে গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ দিন সূর্যালোক থাকে। প্রতিদিন প্রায় পাঁচ কিলোওয়াট ঘণ্টা শক্তি এ দেশের প্রতি বর্গমিটার জমিতে আছড়ে পড়ছে। আর ভূপতিত এই সৌরশক্তিকে সঠিকভাবে বিদ্যুত্শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারলে বাংলাদেশের বিদ্যুত্ চাহিদার একটা বড় অংশ মিটিয়ে ফেলা সম্ভব। একটি সোলার প্ল্যান্টে প্রাথমিক বিনিয়োগ অনেক বেশি মনে হলেও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ন্যূনতম কিছু খরচ ছাড়া আর তেমন খরচ হয় না। এরজন্য মাসিক কোনো বিল দিতে হচ্ছে না। গরমকালে তিন মাসে বিদ্যুত্ ঘাটতি অন্যান্য সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। লক্ষ্য করার বিষয়, সৌর বিদ্যুতের পিক সময় হচ্ছে গরমকাল। অর্থাত্ গরমকালে সূর্যের বিকিরণ হয় সর্বোচ্চ। কাজেই আমাদের দেশে সৌরবিদ্যুেক যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব। এই সোলার প্ল্যান্টের সবচেয়ে বড় বাধা এর প্রাথমিক বিনিয়োগ। সে ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে একসঙ্গে অনেক প্ল্যান্ট স্থাপনে এবং স্থানীয় মার্কেটে এর আনুষঙ্গিক যন্ত্রগুলো তৈরির মাধ্যমে এ বিনিয়োগ কমে যেতে পারে অনেকাংশেই।
কারা ব্যবহার করছেন সৌরবিদ্যুত্ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সৌরবিদ্যুত্ নিয়ে তাদের গবেষণা ও প্রসার অব্যাহত রেখেছে। সাধারণত আমাদের দেশের যেসব এলাকায় অর্থাত্ প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে বিদ্যুত্ এখনও পৌঁছেনি, সেখানে সৌরশক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৪০ লাখের মতো মানুষ সৌরবিদ্যুত্ ব্যবহার করছে। এসব এলাকার সচ্ছল পরিবারের মানুষ এ প্রযুক্তির সুবিধা নিচ্ছে। ভারতে সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা হচ্ছে এবং সেখানে ভবিষ্যতের জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে বিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, রাজস্থানে এ সৌরবিদ্যুত্ খুবই সম্ভাবনাময়। নেপালেও সৌরবিদ্যুত্ উত্পাদিত হচ্ছে।
বায়ুশক্তিচালিত বিদ্যুত্-উইন্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট বাতাসের শক্তিকে একটি সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা সম্ভব। আর তা করা যায় উইন্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের দ্বারা। দেশের সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় ১০০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনে উইন্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট বা বায়ুশক্তিচালিত বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এটিও একটি নবায়নযোগ্য শক্তির উত্স। এটি বিদ্যুত্ উত্পাদনের সহায়ক হিসেবে কাজে লাগতে পারে। বায়ুশক্তিচালিত টারবাইন দ্বারা যথেষ্ট বিদ্যুত্ উত্পাদন করা সম্ভব। বিভিন্ন দেশে এ প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। বাংলাদেশে গত দুই বছর আগে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তা হচ্ছে পিডিবির ব্যবস্থাপনায় কুতুবদিয়ায় পাইলট প্রকল্পের অধীনে একটি উইন্ডমিল তৈরি করা হয়েছিল, যার উত্পাদন ক্ষমতা ছিল এক মেগাওয়াট। সমুদ্রের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে অফশোর উইন্ডমিল বানানো এবং রক্ষণাবেক্ষণ ভূমিতে বানানো উইন্ডমিলের চেয়ে ব্যয়বহুল হলেও এটি হবে জোরালো এবং সব সময় বাতাসের উত্স থাকায় উত্পাদন বেড়ে যাবে অনেকাংশে। তা ছাড়া এ ধরনের উইন্ডমিল আকারে বড় হবে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ডেনমার্ক, হল্যান্ড এ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে শক্তি ও বিদ্যুত্ উত্পাদনের দিক থেকে অনেক অগ্রসরমান। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো যেমন—নেপাল ও ভারতে এ ধরনের উইন্ডমিল স্থাপন করা হচ্ছে।
ভারত ও নেপালে বায়ুশক্তিচালিত বিদ্যুত্ ভারতে বায়ুশক্তি প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ২০১২ সাল নাগাদ ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। উজানা গেছে, নেপাল খুব শিগগিরই নবায়নযোগ্য শক্তির একটি উত্স হিসেবে বায়ুশক্তি ব্যবহার করতে যাচ্ছে। এ জন্য তারা একটি জাতীয় পলিসির খসড়াও চূড়ান্ত করেছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে বিদ্যুত্ উত্পাদনে বাণিজ্যিক টারবাইন স্থাপন করা। এতে একটি পাইলট স্কিমের আওতায় ৫০০ কিলোওয়াটের অধিক শক্তি জেনারেট করতে পারবে। সোলার প্ল্যান্ট অপেক্ষা এটি একটি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি। তা ছাড়া টারবাইন স্থাপনের জন্য স্থানীয় মার্কেট থেকে এর আনুষঙ্গিক যন্ত্রাদি পাওয়া যাবে। পারমাণবিক শক্তি পারমাণবিক শক্তি দ্বারা বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যেতে পারে। অবশ্য বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করছে। একটি ছোট আকারের পরমাণু কেন্দ্র থেকে অসম্ভব পরিমাণে শক্তি উত্পাদন করা সম্ভব। এ পারমাণবিক শক্তি বিদ্যুত্ উত্পাদনের একটি সহায়ক সমাধান হতে পারে। তবে এ ধরনের বিদ্যুত্ উত্পাদনে বড় বাধা হচ্ছে এর ক্ষতিকর বর্জ্য এবং ব্যয়বহুল উত্পাদন ব্যয়।
জিওথার্মাল বা ভূ-উত্তাপ শক্তি শীতপ্রধান দেশে এ ধরনের শক্তি কাজে লাগানোর প্রয়াস লক্ষণীয়। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাতে যে শক্তি পরিলক্ষিত হয় তার চেয়েও কয়েকগুণ শক্তি ভূপৃষ্ঠের নিচে সংরক্ষিত রয়েছে। এই ভূ-উত্তাপ ব্যবহার করে শীতপ্রধান দেশে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট উষ্ণ রাখাসহ বিদ্যুত্ উত্পাদনের কথা জোরেসোরে উচ্চারিত হচ্ছে। এ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সারা বিশ্বে উত্পাদিত প্রায় আট হাজার মেগাওয়াট জিওথার্মাল বা ভূ-উত্তাপ শক্তির মধ্যে আমেরিকাতে প্রায় দুই হাজার ৮শ মেগাওয়াট শক্তি উত্পাদিত হচ্ছে। এটি ব্যয়বহুল প্রজেক্ট।
সাগরের তাপশক্তির রূপান্তর সাগরের পানিতে ওপরে এক রূপ আর নিচের দিকের পানিতে আরেক রূপ। সূর্যের আলোয় ওপরের পানি ক্রমে উষ্ণ হয় এবং নিচের দিকের পানি থাকে শীতল। অল্প তাপে ফুটতে থাকে এমন তরল গ্যাস ব্যবহার করে সাগরের ওপরের দিকের পানি থেকে তাপ সংগ্রহ করে বিশেষ প্ল্যান্টের সহায়তায় টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যায়। আবার এ তরল গ্যাসকে সাগরের গভীরে পাঠিয়ে পানি শীতল করা সম্ভব। এর মাধ্যমে কয়েকগুণ বেশি বিদ্যুত্ উত্পাদন করা যেতে পারে।
করণীয় যা হতে পারে আমাদের দেশে সৌরবিদ্যুত্ প্রকল্প শুরু হয়েছিল প্রথমে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে। কিন্তু আজ আমাদের জাতীয় বিদ্যুত্ ব্যবস্থার যে অবনতি তাতে সৌরবিদ্যুতের সম্ভাবনাকে স্তিমিত রাখা মোটেও যুক্তিসঙ্গত হবে না। বরং এ প্রযুক্তিকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে সঠিক পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের। এর মাধ্যমে আমরা বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটাতে পারব নিঃসন্দেহে। শহরে বাড়ির ছাদে সৌরবিদ্যুত্ প্ল্যান্ট স্থাপন করা যেতে পারে। সমপ্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সৌরবিদ্যুত্ প্রকল্প চালু করা হয়েছে, যা একটি শুভ উদ্যোগ হিসেবে চিহিত। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যাতে এ প্রযুক্তি প্রসার লাভ করতে পারে সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বল্পসুদে ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিদ্যুতের বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত কমিটি বিকল্প শক্তি হিসেবে সৌর, বায়ু এবং পানি বিদ্যুত্ উত্পাদনের সুপারিশ করেছেন। দেশে উত্পাদিত বিদ্যুতের শতকরা ৮৬ ভাগ উত্পন্ন হয় গ্যাসচালিত বিদ্যুেকন্দ্র থেকে। আর বাকি বিদ্যুত্ উত্পন্ন হয় তরল জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে। সামান্য পরিমাণ বিদ্যুত্ উত্পন্ন হয় সৌরশক্তি থেকে। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। আরও অধিক পরিমাণে সৌরবিদ্যুত্ উত্পন্ন হওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া বায়ুশক্তি বিদ্যুত্ উত্পাদনের একটি নির্ভরযোগ্য উত্স হতে পারে। বর্তমান সরকার পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের কথা চিন্তাভাবনা করছে। এ শক্তির দ্বারা বিকল্প বিদ্যুত্ উত্পাদনের একটি পদক্ষেপ নিতে পারে এ সরকার। বিদ্যুতের বিকল্প নবায়নযোগ্য কী কী শক্তি কাজে আসতে পারে তা যাচাই-বাছাই ও পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে আমাদের সঠিক সিদ্ধান্তে আসা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় বিদ্যুত্ একটি অতীব চাহিদাসম্পন্ন উপকরণ। বিদ্যুত্ ব্যবস্থার সঠিক প্রাপ্তি সুনিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের জীবনযাত্রা, শিল্প, কলকারখানা, অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে যে অচল অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে তা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় থাকবে না। কাজেই আমাদের যেমন বিদ্যুত্ উত্পাদন বাড়াতে হবে, তেমনি প্রচলিত এই বিদ্যুত্ ব্যবস্থার বিকল্প কী হতে পারে সে ব্যাপারে ভেবে শিগগিরই একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
ইমেইল: walisearch@yahoo.com

No comments:

Post a Comment