Wednesday, December 1, 2010

বাংলাদেশে হীরার বাজার

বাংলাদেশে হীরার বাজার

একসময় রাজা-বাদশারা মুকুট ও সিংহাসনে যে হীরা ব্যবহার করতে এখন বেচাকেনা হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিল্পু মার্কেটে। রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডিসহ বিভাগীয় শহরগুলোর দোকানে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে হীরার অলংকার। দেশে যখন হীরার ব্যবহার শুরু হয় তখন কেবলমাত্র ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করত। এখন তা আর শুধু অভিজাত শ্রেণীর সম্পত্তি নয়। ক্ষেত্রবিশেষে এটি সাধারণ মানুষেরও নাগালে চলে এসেছে।

মূল্যবান পাথর হিসেবে সৃষ্টির আদি থেকেই সমাদৃত হয়ে আসছে হীরা। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে দামি পাথরগুলোর একটি। যাকে নিয়ে মানুষের কৌতুহল আর আগ্রহের শেষ নেই। তাই হীরার আদ্দৌপান্ত জানাতে আমাদের এই আয়োজন।
হীরার ইংরেজি শব্দ ডায়মন্ড গ্রীক আদামাস শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ খুব কঠিন জিনিস। কঠিন পদার্থ হওয়ার কারণে হীরার এই নামকরণ করা হয়েছে। ইস্পাতকেও ফুটো করতে পারে হীরা। সবচেয়ে কড়া এসিডে ডুবিয়ে রাখলেও হীরার কোনো ক্ষতি হয় না। তবে হীরা আগুনে পুড়ে যায়। কারণ এটি এক ধরণের কার্বন। কেলাসিত কার্বনই একসময় হীরায় রুপ নেয়। বর্ণহীন এ রত্নটি একটি মাত্র বিশুদ্ধ উপাদান কার্বন থেকে সৃষ্ট।
হীরক সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে মূল্যবান হিসেবে খনি থেকে উত্তোলন ও ব্যবহার করা শুরু হয়। হীরা ভারতবর্ষের মানুষের কাছে কমপক্ষে ৩ হাজার থেকে ৬ হাজার বছর ধরে পরিচিত। মানুষের জানা সকল প্রাকৃতিক পদার্থ থেকে হীরা অনেক বেশি শক্ত এবং এটি দ্বারা সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা পর্যন্ত কাজ করা যায়। মাটির প্রায় ১৪০ থেকে ১৯০ কি.মি. নিচে পৃথিবীর কেন্দ্র ও পৃথিবীর আবরণের মাঝে প্রচন্ড তাপ ও চাপের কারনে হীরা গঠিত হতে প্রায় ১ থেকে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি থেকে সাড়ে ৩০০ কোটি বছর পর্যন্ত সময় লাগে । যেখানে পৃথিবীর বয়স ধরা হয় সাড়ে ৪০০ কোটি বছর । সকল হীরাই পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে এমন নয়, পৃথিবীতে এমন অনেক হীরা পাওয়া গেছে যেগুলো পৃথিবীর বাইরে তৈরী। হীরাকে আদর্শ ধরে তৈরি করা মোহ্স স্কেল অফ মিনারেল হার্ডনেস অনুযায়ী হীরার কাঠিন্য ১০ এ ১০। পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ২৬ হাজার কেজি হীরা উত্তোলিত হয় যার মূল্য প্রায় ৯ মিলিয়ন ডলার।

সবচেয়ে মূল্যবান হীরা কোহিনূর

কোহিনূর বা আলোর পর্বত নামে খ্যাত হীরার ইতিহাস অতি দীর্ঘ এবং বর্ণাঢ্য। এর ইতিহাসের সূচনা ১৩০৪ সালে মালব রাজাদের হাতে, তারপর আসে মোগলদের হাতে । পরে বিভিন্ন হাত ঘুরে এখন স্থান পেয়েছে টাওয়ার অফ লন্ডনে। সম্রাট শাহজাহান নির্মিত ময়ুর সিংহাসনের একটা চোখ তৈরী করা হয় আকবর শাহ হীরা দিয়ে, আরেকটা কোহিনূর দিয়ে। পরে নাদির শাহ ভারতবর্ষ জয় করে কৌশলে তিনি মোগলদের কাছ থেকে কোহিনূর উদ্ধার করে নিয়ে যান ইরানে। কোহিনূর নামটিও নাদির শাহের দেয়া। নাদির শাহ নিহত হবার পর কোহিনূর আসে আফগানিস্তান সম্রাট হুমায়ুনের পুত্রের কাছে। আফগানিস্তান থেকে মহারাজা রণজিৎ সিং সেটি গ্রহণ করেন এবং শেষ পর্যন্ত রণজিৎ সিংএর পুত্র সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৮৫০ সালে তুলে দেন রাণী ভিক্টোরিয়ার হাতে। ১০৮.৯৩ ক্যারেট ওজনবিশিষ্ট কোহিনূর প্রথমে রাণী ভিক্টোরিয়া ব্যবহার করতেন তার হাতে। এরপর সেটি স্থান পায় বৃটিশ মুকুটে। এদিকে গত জুলাই এ তিন দিনের যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ভারত সফরে আসলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বৃটিশ এমপি কেইথ ভাজ কোহিনুর হীরা ভারতকে ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি উত্থাপন করেন। কিন্তুু বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কারভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন তা আর সম্ভব নয়।

রক্ত হীরক

আফ্রিকার হীরার প্রচুর খনি আছে। পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ হীরা এখানে উৎপাদিত হয়। এ সব হীরা থেকে প্রাপ্ত অর্থ যুদ্ধ্, হানাহানি, সন্ত্রাস ইত্যাদির অর্থায়নে ব্যবহূত হয়। এ জন্যে এরুপ হীরাকে রক্ত হীরক নামে অভিহিত করা হয়। এজন্য কনভার্টেড ডায়মন্ড, কনফ্লিক্ট ডায়মন্ড, হট ডায়মন্ড এবং ওয়ার ডায়মন্ড নামেও অভিহিত করা হয়।

অভিশপ্ত হিরা

হোপ ডায়মন্ড নীলচে রঙের কারণে-হোপ নামে পরিচিত। বাংলায় হীরাটির নাম 'আশা' হলেও এটি শেষ পর্যন্ত অনেকেরই হতাশা আর ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনশ্রুতি আছে, হীরাটি অভিশপ্ত।
এছাড়া হীরা নিয়ে প্রচলিত আছে বহু মিথ আর ভ্রান্ত ধারণা। রামের ইতিহাসবিদ পিস্ননি লেখেন এক হীরা উপত্যকার কথা, যেটি ভারতবর্ষে রয়েছে। মার্কোপোলোও এই উপত্যকার গল্প বর্ণনা করেন। হীরা নিয়ে এমন আরো বহু কাহিনীর প্রচলন রয়েছে।

রহস্যময় হীরা

পৃথিবীর রহস্যময় কয়েকটি হীরা হচ্ছে গ্রেট মোগল, গোল্ডেন জায়ান্ট, ব্রাগেনজা। গ্রেট মোগল ভারতের হীরক খনিতে পাওয়া যায় ১৬৫০ সালে। ৭৮৭ দশমিক৫০ ক্যারেটের এই অপূর্ব সুন্দর হীরাটিকে সম্রাট শাহজাহানের কাছে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়। ১৭৩৯ সালে নাদির শাহ দিলস্নী আক্রমণ করে অনেক ধন সম্পদ লুট করে নিয়ে যান। তখন গ্রেট মোগলও পারস্যের রাজভান্ডারে জমা হয়। এরপর থেকে এই হীরাটির আর কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি। গোল্ডেন জায়ান্ট বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম এক ধনকুবেরের কাছে রয়েছে। কিন্তুু ৮৯০ ক্যারেটের এই হীরাটির উৎপত্তি কোথায় তা আজও রহস্যে ঘেরা। ব্রাগেনজা ছিল ১৬৮০ ক্যারেটের হীরা। এই হীরাটি এখন কোথায় আছে তা আজও অজানা।
পৃথিবীর অন্যতম আরেকটি রহস্যময় সুন্দর হীরক হল 'দ্যা উইটেলসব্যাক গ্রাফ ডায়মন্ড'। যেটি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির স্মিথসোনিয়ান'স ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিষ্ট্রিতে এখন শোভা পাচ্ছে। মহামূল্যবান এই হীরক খন্ডটি বিক্রির উদ্দেশ্যেই এখানে রাখা হয়েছে।
এই হীরা শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিলো ১৯৫৮ সালে, ব্রাসেলসের ওয়ার্ল্ড এক্সিবিশনে। তারপরেই রহস্যজনকভাবেই উধাও হয়ে যায় এই হীরাটি। এরপর ২০০৮ সালের এক নিলামে লরেন্স গ্রাফ এটিকে কিনে নেবার পর আবারো আলোচনায় আসে হীরাটি।

নারীর সঙ্গী হীরা

পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পদার্থ হীরা একইসঙ্গে সবচেয়ে বেশি চাপ সহ্য করার ক্ষমতাও রাখে। সে হিসেবে সম্ভবত কোনো প্রিয়জন নন, অলংকার কিংবা আভরণ হিসেবে নারীর সবচেয়ে সঙ্গী এই হীরাই।

হীরা কিনতে ফোর সি (চার সি)

ডায়মন্ডের অলংকার কেনার প্রথমেই ধারণা নিতে হবে 'ফোর-সি' সম্পর্কে। ফোর সি হচ্ছে_ডায়মন্ড ক্যারেট ওয়েট, ডায়মন্ড ক্ল্যারিটি, ডায়মন্ড কালার এবং ডায়মন্ড কাট (শেইপ নয়)। ক্যারেট মানদন্ডে ডায়মন্ডের ওজন মাপাই ডায়মন্ড ক্যারেট। স্বর্ণের ক্ষেত্রে এটি হল বিশুদ্ধতার একক। আর রত্নপাথরের ক্ষেত্রে ক্যারেট হচ্ছে ভরের একক। এক্ষেত্রে ১ ক্যারেট সমান দশমিক ২ গ্রাম বা ২০০ মিলিগ্রাম। এক ক্যারেটকে ১০০ পয়েন্টে ভাগ করা হয়। এ হিসেবে ৭৫ পয়েন্ট হচ্ছে ০.৭৫ ক্যারেট। ডায়মন্ডের দাম নির্ধারণে ক্যারেট ওয়েট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তুু কোয়ালিটির ওপর নির্ভর করে দু'টি সমান ক্যারেটের ডায়মন্ডের দাম ভিন্ন হতেই পারে।
ভেতরের গঠন ও অবিশুদ্ধতার পরিমাপই ডায়মন্ডের ক্ল্যারিটি। গঠনগত দিক থেকে বাইরের বা ভেতরের কোন বাধা ডায়মন্ডের আলোক বর্ণালির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। একজন বিশেষজ্ঞই ডায়মন্ডের ক্ল্যারিটি বুঝতে পারেন। তবে ডায়মন্ডে সামান্য পরিমাণ অবিশুদ্ধতা থাকলেও তা হীরার ঘাতসহতায় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে না। হীরা কতটা পরিষ্কার তার ওপর নির্ভর করবে এটি কতটা সুন্দর ও আকর্ষণীয় দেখাবে। এ কারণে হীরার ক্ল্যারিটি নির্ণয়ে নানা ধরনের স্বীকৃত স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে। যেমন ক্ল্যারিটির দিক থেকে এফ এল, আই এফ ডায়মন্ড সবচেয়ে বেশি পরিস্কার। তবে কোন 'ফ্ল' নেই, এমন হীরা সত্যি বিরল। ওগুলো সবচেয়ে দামি। তবে ১১, ১২ ও ১৩ নম্বর হীরা কম পরিস্কার, দামও কম।
ডায়মন্ড কেনার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হচ্ছে কালার। কালার পরিমাপেরও একটা স্বীকৃত স্কেল রয়েছে। 'ডি' ও 'এফ' রেঞ্জের মধ্যে হীরা মূলত কালারলেস। 'জি' ও 'জে' প্রায় বর্ণহীন। 'কে' ও 'এন' হচ্ছে অস্বচ্ছ হলুদ। 'ও' এবং 'আর' হচ্ছে খুবই হালকা হলুদ। 'টি' ও 'জেড' হচ্ছে হালকা হলুদ। হীরা উজ্জ্বল হলুদ, গোলাপি ও নীলও হতে পারে। তবে অধিকাংশ হীরা অস্বচ্ছ হলুদ ও হালকা হলুদ হয়ে থাকে।
হীরার স্বীকৃত ফোর-সি'র মধ্যে কাটা সবচেয়ে বেশি জটিল। একটি হীরা যখন সমানুপাতে বা ভারসাম্য রেখে কাটা হয়, তখন এটার আলোক প্রতিফলন ক্ষমতা বাড়ে। তবে হীরা অগভীরভাবে কাটলে আলো পাশর্্ব দিয়ে প্রতিফলিত হয়ে হীরা ধূসর মনে হতে পারে। একটি আদর্শ হীরার বৈশিষ্ট্য, এটা যত ধরণের আলো ধারণ করতে পারবে তার সবটাই প্রতিফলন করবে।

কৃত্রিমভাবে হীরা তৈরি কি সম্ভব?

সবচেয়ে মূল্যবান পাথর হীরাকেও কৃত্রিমভাবে বানানো হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। আর তার মানও আসল হীরার চেয়ে খুব একটা মন্দ নয়। এগুলো প্রাকৃতিক হীরার মতোই উজ্জ্বল। কৃত্রিম উপায়ে হীরা উৎপাদন শুরু করে জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানি। সে ১৯৫৬ সালের কথা। ওই সময়ে তারা যে হীরা উৎপাদন করে তা ছিল ক্ষুদ্র আকারের রত্নপাথর। তবে আরও ১৫ বছর সাধনা করে এই কোম্পানি ১৯৭১ সালে উৎপাদন করে রত্ন-মানের এক ক্যারেটের হীরা। কৃত্রিম উপায়ে হীরা উৎপাদনের ইতিহাস এখান থেকেই শুরু।
অতি উচ্চ তাপ ও চাপের ক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠের নিচে অবস্থিত গ্রাফাইট থেকে প্রাকৃতিকভাবে হীরা তৈরি করা হয়। গ্রাফাইটের ওপর পর্যাপ্ত চাপ এবং বৈদ্যুতিক চুলিস্নতে ২৫০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ প্রয়োগ করা হয়। ঠান্ডা হওয়ার পর, এই গলিত বস্তুুতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃত্রিম হীরা থাকে, যা লোহা দ্বারা শক্তভাবে আবৃত থাকে। এসিড দ্বারা এই লোহা দ্রবীভূত করে হীরা মুক্ত করা হয়। প্রাকৃতিক হীরার তুলনায় কৃত্রিম হীরার আকার অপেক্ষাকৃত ছোট।

চুল ও দেহভস্ম দিয়ে হীরা তৈরী

মহারানী ভিক্টোরিয়ার সম থেকেই 'শোকের পাথর' হিসেবে হীরা পরিচিত। কারও হাতে একটি আংটি বা গলার হার স্মরণ করিয়ে দিতো হারানো স্বজনের কথা। কিন্তুু প্রযুক্তির উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়জনের ওই সব উপহার বহনের চেয়ে তাকে আরও কাছে রাখার উপায় উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীরা। আর তা হলো প্রিয়জনের চুল বা দেহভস্ম ব্যবহার করে হীরা উদ্ভাবন। এর ফলে যে হীরা উৎপাদন হয় তা ব্যবহার করলে যে কেউ হারানো স্বজনকে সব সময় নিজের সঙ্গে সঙ্গে রাখতে পারেন।
মানুষের চুল থেকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ল্যাবরেটরিতে বানানো হচ্ছে মহামূল্যবান হীরা। আর এই দামি শিল্পের পণ্য চুলের বিপুল যোগান এই বাংলাদেশ থেকেই। ঝিনাইদহে জেলায় গড়ে উঠেছে বিশাল বাজার ও প্রক্রিয়াকরণ কারখানা। লাখ লাখ টাকার চুল বেচাকেনার জন্য ক্রয় অফিস খুলে তা কিনে নিচ্ছেন বিদেশীরা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পনেরোটির বেশি জেলায় চুল বেচাকেনা হচ্ছে। হীরা তৈরির জন্য পশ্চিমা বিশ্বে অনেক কোম্পানি গড়ে উঠেছে। তারা এ ব্যবসা করে উপার্জন করছে কোটি কোটি ডলার।
গত বছর পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসন মারা যাওয়ার পর শিকাগোর একটি কোম্পানি এরকম এক ঘোষণা দেয়। শিকাগোর লাইফজেম নামের ওই সংস্থা ঘোষণা দেয়-১৯৮৪ সালে পেপসির বিজ্ঞাপন নির্মাণের সময় যখন পপ তারকা মাইকেল জ্যাকসনের চুলে আগুন ধরে যায়। তখন তারা সেই চুলের কিছু অংশ সংগ্রহ করে তা দিয়ে ১০টি হীরা বানিয়েছে। ২০০৭ সালে সংগীত স্রষ্টা বিঠোফেন-এর চুল থেকে উৎপাদন করেছেন তিনটি হীরা। মৃত মানুষের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনের ভিন্ন ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করতে সমপ্রতি সুইজারল্যান্ডের একটি কোম্পানি মৃত মানুষের ছাই দিয়ে হলুদ রঙের হীরা বানিয়েছে।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ ১০ হীরা

দ্যা কালিনান বিশ্বের সবচেয়ে বড় হীরা। ১৯০৫ সালে ফ্রেডারিক ওয়েলস স্যার থমাস কালিনান এর হীরক খনি থেকে এটি আবিস্কার করেন। স্যার থমাস কালিনানের নাম অনুসারেই এ হীরার নামকরণ করা হয়। অপরিশোধিত অবস্থায় এটির ওজন ছিল ৩ হাজার ১০৬ দশমিক ৭৫ ক্যারেট বা ৬২১ দশমিক ৩৫ গ্রাম। তারপর অপরিশোধিত হীরাকে ঘঁষে মেজে ৫৩০ দশমিক২০ ক্যারেট বা ১০৬ দশমিক ৪ গ্রামের দ্যা কালিনান আই-একা দ্যা স্টার অফ আফ্রিকা তৈরী করা হয়। বর্তমানে বৃটিশ রাণির মুকুটে কালিনান শোভা পাচ্ছে।
কালিনান ছাড়া বৃহৎ হীরাগুলো হলো: ব্রাগেনজা, এক্সেলসিওর, স্টার অফ সিয়েরা লিওন, গোল্ডেন জায়ান্ট, গ্রেট মোগল, ওয়ি রিভার, প্রেসিডেন্ট ভারগাস, জোংকার এবং রিজ। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দশটি হীরার তালিকায় নাম না থাকলেও কোহিনুর যথেষ্ট আলোচিত একটি হীরা।

সর্ববৃহৎ হীরার বাজার

বিশ্বের বৃহত্তম হীরার বাজার ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্ব্বাইয়ের বান্দ্রা-কুরলা কমপেস্নক্সে অবস্থিত। মার্কেটটির নাম 'ভারত ডায়মন্ড বোরস'। ২০ একর জমির ওপর নির্মিত নয়তলাবিশিষ্ট ৩০লাখ বর্গফুটের এই কমপেস্নক্সটিতে নয়টি টাওয়ার রয়েছে। এটি তৈরি করতে ভারতীয় মুদ্রায় এক হাজার ১০০ কোটি রুপি ব্যয় হয়েছে। এখানে হীরার আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম থেকে শুরু করে হীরার শেয়ারবাজার ও ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। এই বিশাল হীরক বাণিজ্যকেন্দ্র চালু হওয়ায় হীরক লেনদেনের ক্ষেত্রে বেলজিয়ামের আন্টওয়ের্প শহর ও ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিবকে পেছনে ফেলল।

হীরা পরিশোধণে শীর্ষে ভারত

হীরক খ কাটা, হিরার অলংকার তৈরী এবং পরিশোধণের বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশ ভারত। এ পরিচিতির সাথে ভারতে সর্ববৃহত বাজার থাকায় লেনদেনের ক্ষেত্রেও দেশটি অনেক এগিয়ে যাবে। ভারতের মোট হীরার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশই বিদেশের বাজারে রপ্তানি করা হয়। হীরা কাটা, পালিশ করা, হীরার অলংকার তৈরি ইত্যাদি মিলিয়ে এই শিল্কেপ্পর সঙ্গে বর্তমানে প্রায় আট লাখ ৫০ হাজার কর্মী জড়িত রয়েছেন। আর ভারতে হীরা রপ্তানির ব্যবসায় নিয়োজিত রয়েছে ৪০০টি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ভারত প্রতিবছর হীরার গয়না রপ্তানি করে প্রায় আড়াই হাজার কোটি ডলার আয় করছে।

দেশে হীরার চাহিদা বাড়ছে
দফায় দফায় স্বর্ণের দাম বাড়ার কারণে হীরার চাহিদা বাড়ছে। হাতের কাছে হীরার গহনা পাওয়ায় ক্রমেই বাড়ছে এর ব্যবহার। ফ্যাশনপ্রিয় ধনাঢ্য তরুণ-তরুণীদের এখন প্রথম পছন্দ হীরার গহনা। বাগদান অনুষ্ঠানে হীরার আংটি ব্যবহার এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ কারণে স্বর্ণের পরিবর্তে এখন অনেকেই ঝুঁকে পড়ছেন হীরার গহনার দিকে।
বর্তমানে দেশের প্রায় সব বড় স্বর্ণের দোকানেই হীরার গহনা পাওয়া যাচ্ছে। তবে ধানমন্ডির রাইফেলস স্কয়ারের কার্বন ক্রাফট, গুলশান-১ ও উত্তরায় রয়াল ডায়মন্ড এবং ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড এই ৪টি দোকানে শুধুমাত্র হীরার গহনা বিক্রি করে থাকে।

বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশী হীরার অলংকার
বাংলাদেশের তৈরি হীরার অলংকার এখন দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। তবে রপ্তানির পরিমাণ খুবই সামান্য। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৫০ কোটি টাকার মতো হীরার অলংকার রপ্তানি হচ্ছে। প্রতিযোগী অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশের তুলনায় গুণগত মান ও নকশা ভালো হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডা, জাপান, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন ধনী দেশের ক্রেতারা বাংলাদেশি অংলকারের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন।

জিএসপি'র রুলস অফ অরিজিনের শিথিল ও সরলীকরণের সুফল বাংলাদেশ পাবে

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং টিকে থাকার লক্ষ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নয়ন অংশীদার দেশগুলোর কাছ থেকে দ্বি-পাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক পর্যায়ে সহযোগিতার আশা করে। ইইউভূক্ত দেশগুলোর জিএসপি ( জেনারেলাইজড সিস্টেম অভ প্রিফারেন্সেস) উদ্যোগের রুলস অভ অরিজিনের শিথিল ও সরলীকরণের সুফল বাংলাদেশ পাবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন বাণিজ্য মন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান।
গেল সপ্তাহে ঢাকার একটি হোটেলে ইইউ আয়োজিত "ইইউ-বাংলাদেশ বাণিজ্য: সর্বাধুনিক সমপ্রসারণ এবং চ্যালেঞ্জসমূহ" শীর্ষক সেমিনারের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে তিনি এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। সেমিনারে ইইউ ডেলিগেশনের প্রথম সচিব এন্ড্রু বার্নার্ড এবং ট্রেড এডভাইজার জিলস্নুল হাই বক্তৃতা করেন।
ইইউ হচ্ছে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান গন্তব্যস্থল উলেস্নখ করে মন্ত্রী বলেন, ইইউ যেভাবে বিভিন্ন পলিসির মাধ্যমে সহযোগিতা করছে, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত ৪৯টি দেশের জন্য ইবিএ ( এভরিথিং বাট আর্মস) উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ ভাল সুফল পেয়েছে। এর সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে অনেকগুণ বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। তেমনি নতুন জিএসপি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দেশ ও নিজের জন্য সুফল লাভের লক্ষ্যে চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করতে সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
তিনি বলেন জলবায়ু সংক্রান্ত দুর্যোগের জন্য যেমনি বাংলাদেশ দায়ী নয় তেমনি বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার জন্যও বাংলাদেশ দায়ী নয়। অথচ এজন্য বাংলাদেশের মানুষকে কষ্ট পেতে হয়েছে। গত বছর বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ বাড়লেও বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানি করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পণ্যের মূল্য অনেক কম পেয়েছে। তাই পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন এবং নেগোশিয়েশনের সক্ষমতা বাড়িয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে।
মন্ত্রী বলেন, দেশের উন্নতির জন্য আমাদের প্রধান টেকনিক্যাল লক্ষ্য ছিল দেশের জন্য স্বাধীনতা অর্জন-তা অর্জিত হয়েছে। দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল কৌশলগত লক্ষ্য- অর্থনৈতিক মুক্তি। যা, অর্জনে সকলে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, বাঙালি অতীতে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জয়লাভ করেছে, আগামী দিনেও সকল ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের জনগণকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে।
উলেস্নখ্য যে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৮,২২০.৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য ইইউ'র দেশগুলোতে রপ্তানি করেছে। পক্ষান্তরে আমদানি করেছে ১৭৫৩.২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। ২০০৯ সালের এক হিসেব অনুযায়ী এ সময়ে সারাবিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান গন্তব্যস্থল ছিল ইইউ, যার পরিমাণ ৪,৯৮৬.৪ মিলিয়ন ইউরো। যা, বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৪৮.৩%। আমদানি পণ্যের পরিমাণ ছিল ১,২৯৪ মিলিয়ন ইউরো এবং বাংলাদেশের মোট আমদানির ৮.৫%। এসময়ে ইইউ'র ২৭টি দেশের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৬,২৮১.০ মিলিয়ন ইউরো। যা, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ২৪.৫%।

Source: Daily Ittefaq

No comments:

Post a Comment