Friday, December 3, 2010

মসলিনের ইতিকথা

মসলিনের ইতিকথা

সৈ য় দ লু ত্ ফু ল হ ক
খ্রিস্টপূর্ব ২০০ বছর আগে গ্রিকরা ভারতীয় কার্পাসের কথা বলেছে। স্ট্যাটিটিয়াস (Statitius) কার্পাস তুলাকে ‘কবোসম’ বলেছেন। জে ফর্বেস রয়েল (J Forbes Rayle, M.D, F.R.S) তাঁর গ্রন্থ 'The Early History of Cotton' গ্রন্থে লিখেছেন। গ্রিকরা ঢাকার মসলিনকে ‘গ্যাঞ্জোটিকা’ নামে উল্লেখ করেছেন। যেহেতু বস্তুটি গঙ্গা উপকূলে তৈরি হতো। বাংলাদেশী বস্ত্র শিল্পীর এই মসলিন শিল্প জগদ্বিখ্যাত। বিখ্যাত গ্রিক পর্যটক প্লিনি থেকে শুরু করে ডা. উরে (Dr. Ure) এবং টেইলর পর্যন্ত বিখ্যাত ব্যক্তিরা মসলিন সম্পর্কে বহু লেখায় ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
প্লিনির সময়ে মসলিনের নাম ছিল ‘কার্পাসিয়াম’, যদিও এই শব্দটি সংস্কৃত ভাষার কার্পাস শব্দের অপভ্রংশ। অতীতকালে ঢাকার আশপাশে ভাওয়াল রাজার অধীনে কাপাসিয়া প্রধান কেন্দ্র ছিল। ‘কার্পাসিয়াম’ শব্দ থেকে ‘কাপাসিয়া’ অঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছে। খ্রিস্ট ধর্মীয় গ্রন্থে (বাইবেল) এই মসলিনের উল্লেখ পাওয়া যায়। (ইজেফিল, ১৪শ অধ্যায় এবং ইলিয়ায় ১০, ১৩ ও তৃতীয় অধ্যায়ে) প্লিনি লিখেছেন, রোমে রাজপ্রাসাদের মেয়েরা মসলিন বস্ত্র পরিধান করিয়া স্বীয় নগ্ন অবয়ব সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করত। (A dress under whose slight veil our women continue to show their shapes to the public.)
ডাক্তার উরে বলেছেন, ‘রোমের স্বর্ণযুগে ঢাকার মসলিন রোমের রাজ মহিলাদের সবচেয়ে প্রিয় এবং বিলাস বসন হিসেবে আদৃত ছিল (cotton manufacturer of Great Britain by Dr. Ure) কবি ইয়েটস লিখেছেন, বঙ্গদেশের কার্পাস খ্রিস্টপূর্ব দুইশত বছর পূর্বে গ্রিক দেশে প্রচলিত ছিল।
জুভিনেলের পুস্তকেও মসলিনের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। প্লিনির লেখাতে পাওয়া যায়, বাংলাদেশের ঢাকা নগরী মসলিনের সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সুপ্রাচীন কাল থেকে ঢাকাই মসলিনের সুখ্যাতি প্রতিষ্ঠিত। চীন, তুরস্ক, সিরিয়া, আরব, ইথিওপিয়া, পারস্য ও স্পেনে এই মসলিনের বাণিজ্য প্রচলিত ছিল। সিল্ক রোড, নৌপথে, মধ্য এশিয়া থেকে ইউরোপ-অবধি এই মসলিনের বাণিজ্য প্রচলিত ছিল। বঙ্গদেশ থেকে আরব বণিকেরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মসলিন রফতানি করেছে। প্রবাদ আছে, তদানীন্তন স্পেনের রানী ইসাবেলার অত্যন্ত প্রিয় ছিল এই মসলিন। বঙ্গদেশের এই মসলিন যেত তাঁর কাছে। তা ছাড়া প্রভেন্স, ইতালি লেংগুইডকে ঢাকার মসলিন প্রেরিত হতো।
মিসরের রাজা এন্টোনিও (ক্লিওপেট্রার নন্দিতপ্রেমিক) তাঁর সৈন্যদের ‘কার্বাসাম’ বস্ত্র উপহার দিয়েছিলেন। ট্রেভারনিয়ার লিখেছেন, মুহাম্মদ আলী বেগ ভারত বর্ষ থেকে ফিরে রাজা চাসেফিকে মূল্যবান প্রস্তরখচিত ডিম্বাকৃতির একটি নারিকেল উপহার দেন। তার মধ্যে ৬০ হাত দীর্ঘ একটি মসলিন কাপড় ছিল। কাপড়টি এতই পাতলা ছিল যে, হাতে রাখলে কোনো কিছু আছে বলে মনে হতো না।
খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষভাগে ‘এরিয়ান’ ঢাকার মসলিনের উল্লেখ করেছেন (Periplus of the Erythrean sea) দুই চীনদেশীয় পর্যটক নবম শতাব্দীতে ভারতবর্ষের বিবরণীতে একটি পুস্তক লিখেছেন (Account of India and China by Two Mohammadan Travellers) নূরজাহানের মাতার এই উপহারে জাহাঙ্গীরের অহমিকায় ছেদ পড়ে যায়। প্রতিদানে জাহাঙ্গীর তাঁর শাশুড়িকে কিছু উপহার দেয়ার প্রস্তাব করেন। শাশুড়ি তেমনি এক পেয়ালা মসলিন দিলেই চলবে বলে জানিয়ে দেন। জাহাঙ্গীর মসলিন সংগ্রহের জন্য ২২০০ অশ্বারোহী সৈন্য বঙ্গদেশের উদ্দেশে প্রেরণ করেন। বঙ্গদেশের উদ্দেশে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে পথিমধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ সৈন্যের প্রাণহানি ঘটে। পানিতে ডুবে, ম্যালেরিয়া, দস্যুর আক্রমণ ইত্যাদি কারণে। কিন্তু ওইসব সৈন্যরা ছোট্ট একটি পেয়ালা পূর্ণ করার মতো মসলিন সংগ্রহ না করে দিল্লি দরবারে ফিরে যায়। এই সামান্য মসলিন দিল্লির সম্রাট শাশুড়িকে উপহার দিয়েছিলেন। শাশুড়ি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন; কিন্তু সম্রাট অপূর্ণ কাপটির বেদনা সারাজীবন বইতে হয়েছে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহানের কাছে মসলিন অত্যন্ত প্রিয় ছিল। মোগল সম্রাটরা মসলিনের প্রতি এত ঈর্ষান্বিত ছিলেন যে মসলিনের প্রচার ও বিদেশ পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নূরজাহানের সুরুচির কারণে ভারতের সব নগরীতে মসলিন একটি বিশেষ স্থান দখল করেছিল।
মসলিনের সুতা সাধারণত মেয়েরা তৈরি করত এবং এটি মেয়েদের কাজ হিসেবে গণ্য করা হতো। পুরুষরা সুতা কাটাকে অপমানজনক মনে করত। যেসব সৈন্য বা রাজা যুদ্ধে পরাজিত হতেন, তাদের অপমান করার জন্য সুতা কাটতে দেয়া হতো। বাংলার সুতো কাটার ওপর বৈষ্ণব সঙ্গীত প্রচলিত গানটি ছিল এরূপ—
“(সে হাটে) বিকায় নাতো অন্য সুতা
বিনা তাঁতি নন্দের সুত
সে হাটের প্রধান তাঁতি, প্রজাপতি পশুপতি,
আর যত আছে তাঁতি-তাদের শুধু যাতাযাতি\”
মসলিনে সূক্ষ্ম সুতা কাটার জন্য তরুণী মেয়েদের ব্যবহার করা হতো, কারণ তাদের দৃষ্টিশক্তি ও হাতের সাহায্যে সূক্ষ্মতা অনুভূত হতো। বয়স বাড়লে অনুভূতিগুলো নষ্ট হয়ে যায়। 'India of Ancient and Middle Age' গ্রন্থে মিসেস ম্যানিং লিখেছেন, ঘাসের ওপর বিছানো একখানি সুদীর্ঘ মসলিন একটি গাভী খেয়ে ফেলেছিল। যার জন্য গাভীর মালিক দণ্ডিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক কাফি খাঁ মোগল অন্তঃপুরে মসলিনের কদরের কথা লিখেছেন। বস্ত্র শিল্পের ইতিহাসে মসলিন সর্বশ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মাত্র একটি ঘর তাঁতি মসলিন বয়ন করতে পারত, তা পরবর্তী সময়ে বিলীন হয়ে যায়। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে একখানি মসলিন ৬০ পাউন্ডে বিক্রি হতো। তার দৈর্ঘ্য ছিল বিশ গজ, ওজন ছিল সাড়ে সাত আউন্স। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে একখানি মসলিন ৪০০ পাউন্ডে বিক্রি হতো। টপোগ্রাফি অব ঢাকায় ১৬০ হাত লম্বা একখানি মসলিনের ওজন ছিল চার তোলা। এই মসলিন সোনারগাঁয়ে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়েছিল।
ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও মেঘনার মিলনস্থলে ১৯৬০ বর্গমাইল জুড়ে পৃথিবীর সর্বোত্কৃষ্ট মসলিন তৈরি হতো। এর কেন্দ্রস্থল ছিল ‘কাপাসিয়া’। তাছাড়া ঢাকা, মুড়াপাড়া, সোনারগাঁ, ডেমরা, তিতবর্দী, বালিয়াপাড়া, নপাড়া, মৈকুলী, বাহারক, চরপাড়া, বালটেক, নবীগঞ্জ, সাহাপুর ও সামরাই প্রভৃতি স্থানে মসলিন উত্পন্ন হতো। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে মসলিনের অবনতির দিনেও ঢাকায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, সোনারগাঁয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ডেমরায় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, তিতবর্দীতে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মসলিন রফতানি বা বিক্রি হয়েছিল। ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে ২৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার বস্ত্র বিক্রি হয়েছিল। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে ৫০ লাখ টাকার মসলিন বিদেশে রফতানি হয়েছিল।
ইংরেজ শাসনামলে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাপড় প্রস্তুত করে ঢাকার মসলিনের সঙ্গে পাল্লা দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ওয়াটসন সাহেব লিখেছেন 'With all our machines and wonderful Intentions we have neither to been unable to produce a fabric which for fineness or utility can equal the woven air of Dacca.' আমাদের বস্ত্রের নানাবিধ অত্যাশ্চর্য উপায়গুলো থাকা সত্ত্বেও চারুশিল্প হিসেবে মসলিনের ঐন্দ্রজালিক সক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারিনি। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সরকার ঢাকার মসলিন উত্পাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করে এবং ব্রিটিশদের তৈরি কাপড় রফতানি শুরু করে। ফলে মসলিন উত্পাদন ক্রমে ক্রমে বিলোপ হতে থাকে। তাছাড়া মসলিন প্রস্তুতকারী তাঁতি ও সুতা তৈরির কারিগরদের ওপর নানা প্রকার নির্যাতন শুরু করা হয়। এমনকি মসলিন তৈরির সূক্ষ্ম কারিগরদের আঙুল কেটে দেয়া হয়।
বঙ্গদেশের গোটা প্রদেশে এই বস্ত্র তৈরি হতো। এর বাণিজ্যের প্রধান স্থান ছিল ঢাকা, সুবর্ণগ্রাম, ডেমরা, তিতবর্দী, জঙ্গলবাড়ি ও বাজিতপুর। প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর সুসভ্য দেশ থেকে এসব অঞ্চলে বণিকদের আগমন ঘটেছিল।
বর্তমান প্রজন্মের কাছে মসলিন একটি নাম এবং ইতিহাস বিশ্বখ্যাত এই মসলিন আমার ঐতিহ্যের সম্পদ। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এই মসলিন হয়তো আমরা আর তৈরি করতে পারব না। যদিও বর্তমানে কিছু মসলিন তৈরি হচ্ছে, যা আগেকার তুলনায় অত্যন্ত স্থূল। আসুন, সবাই মিলে গৌরবোজ্জ্বল মসলিনের গৌরব ফিরিয়ে আনি।
গ্রন্থসূত্র
১. চীনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
২. বৃহত্ বঙ্গ, ড. দীনেশচন্দ্র সেন
৩. প্রাচীন আরবের ইতিহাস ও বেদুঈন পোশাক, আরব সরকার প্রকাশিত

No comments:

Post a Comment