Monday, December 27, 2010

লোকায়ত কৌশলে উঁচু হয়েছে ৩২ বর্গকিলোমিটার জমি : বিপর্যয় ঠেকাতে জাগছে মানুষ

লোকায়ত কৌশলে উঁচু হয়েছে ৩২ বর্গকিলোমিটার জমি:

বিপর্যয় ঠেকাতে জাগছে মানুষ

ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের জেঠুয়া বিলসংলগ্ন বেড়িবাঁধ ছয় ফুট ভেঙে যায়। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়া জলোচ্ছ্বাসের পানিতে তলিয়ে যায় তিনটি গ্রামের প্রায় তিন শ ঘরবসতি। ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে কপোতাক্ষের জোয়ারের পানি ও তার সঙ্গে আসা পলিমাটি প্রবেশ করতে থাকে। বর্ষার সময় স্থানীয় লোকজন দেখতে পায়, পলি আসার পরিমাণ বেড়ে গেছে। পলি জমে জেঠুয়া বিলের পাশাপাশি কৃষ্ণকাঠি ও চরকানাইদিয়া বিলের বেশির ভাগ জমিও উঁচু হতে শুরু করেছে।
জালালাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সর্দার রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে স্থানীয় বেশ কয়েকজন তরুণ বেড়িবাঁধের আরও ১৯০ ফুট অংশ কেটে দেয়। বর্ষাজুড়ে অবাধ জোয়ার-ভাটা চলতে দেওয়ায় তিনটি বিলের প্রায় ৫০০ হেক্টর জমি কয়েক ফুট উঁচু হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানায়। ভাটার টানে পানি বের হওয়ার সময় কপোতাক্ষের বিলসংলগ্ন অংশ প্রাকৃতিকভাবেই খনন হয়ে যাচ্ছে বলে জানান স্থানীয় তরুণ লুত্ফর মোড়ল।
সম্প্রতি আইলা ও সিডরে বিধ্বস্ত খুলনা, সাতক্ষীরা জেলাসংলগ্ন কপোতাক্ষ, শিবসা ও আপার ভদ্রা নদীর এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বেড়িবাঁধের বাইরে বিপুল পরিমাণে পলি পড়ে আছে। খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ এবং সাতক্ষীরার আশাশুনি ও তালা উপজেলাসংলগ্ন নদীর মধ্যে কিছু দূর পরপর বিশাল চরের দেখা মিলেছে। স্থানীয় লোকজন জানায়, এ চরগুলো আইলার পর সৃষ্টি হয়েছে। নদীর গভীরতাও অনেক স্থানে কমেছে। ট্রলারে করে আশাশুনি থেকে কয়রা যাওয়ার পথে বেশ কিছু স্থানে বিশাল চরের দেখা মিলেছে।
পানি ও নদী-ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণায় নিযুক্ত সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) গবেষক মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আইলার আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় অনেক এলাকার পলি আসার পরিমাণ বেড়ে গেছে। জেঠুয়া বিল জোয়ার-ভাটায় উঁচু হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, এর আগের গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, এ বিলে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি করে জমি উঁচু করা সম্ভব। স্থানীয় জনগণের উদ্যোগ তা সত্য প্রমাণ করে দেখাল।
আইলা ও সিডরের কারণে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক বিলেই পলি আসার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে জমি উঁচু হচ্ছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকারের উচিত, উপকূলের কোন কোন এলাকায় অবাধ জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি করে জমি উঁচু করা সম্ভব, তা চিহ্নিত করা। যে এলাকার নদীর পানিতে পলির পরিমাণ বেশি, সেখানে অবাধ জোয়ার-ভাটা করা, আর যেখানে বেড়িবাঁধ প্রয়োজন, সেখানে তা নির্মাণ করা।
অবাধ জোয়ার-ভাটা নামের এই পদ্ধতি ব্যবহার করে গত ২০ বছরে যশোর ও সাতক্ষীরার তিনটি বিলের ৩১ দশমিক ৩৫ বর্গ কিলোমিটার জমি এক থেকে দুই ফুট উঁচু করেছে উপকূলবাসী। জেঠুয়া বিলের উঁচু হওয়া জমি হিসাব করলে তার পরিমাণ ৩২ বর্গ কিলোমিটার হবে বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) গবেষণা পরিচালক জহিরুল হক খান।
বুদ্ধিটা পুরোনো: জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি পরিকল্পিতভাবে ব্যবহারের জ্ঞান বা বুদ্ধির পুরোটাই দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলবাসীর। বাপ-দাদাদের কাছ থেকে শেখা। সমুদ্র থেকে নদী হয়ে উপকূলের দিকে আসা বিপুল পরিমাণ পলি পরিকল্পিতভাবে ব্যবহারের কৌশল এখানকার মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে। বিজ্ঞানীরাও দীর্ঘ গবেষণা শেষে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন।
উপকূলবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অবাধ জোয়ার-ভাটার পদ্ধতি খুব কঠিন কিছু নয়। কপোতাক্ষ, শিবসা, পশুর, মাথাভাঙ্গাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলো দিয়ে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পলি আসে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধে তা বাধা পেয়ে নদীর বুকে জমা হয়। স্থানীয় কিছু উদ্যোগী মানুষ পলি বেশি আসে, এমন কয়েকটি স্থান চিহ্নিত করে তা কেটে দেওয়ার পর দেখা গেল, জোয়ারের সঙ্গে আসা পলিগুলো বিলের ভেতর এসে পড়ছে। এতে জমি যেমন উঁচু হচ্ছে, তেমনি ভাটার পানির টানে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে নদী গভীর হচ্ছে।
নদী ও পলি ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণাকারী সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) সম্প্রতি এক গবেষণা করে দেখতে পেয়েছে, শুধু যশোর জেলার উপকূলীয় আটটি বিলে অবাধ জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে ৬৯ দশমিক ৭০ বর্গ কিলোমিটার জমি দুই মিটার উঁচু করা সম্ভব। খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, ভোলা, পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় অন্য জেলাগুলোতেও অবাধ জোয়ার-ভাটা করা সম্ভব কি না, তা খতিয়ে দেখছে তারা।
সরকারি সংস্থা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যশোর জেলার বিল খুকশিয়ায় অবাধ জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে গত তিন বছরে ৬৫০ হেক্টর জমি এক থেকে দেড় মিটার উঁচু করেছে। বিল ভায়েনা ও বিল ডাকাতিয়াসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলে অবাধ জোয়ার-ভাটা চালিয়ে প্রায় ৩১ দশমিক ৮২ কিলোমিটার ভূমি উঁচু করা হয়েছে।
অবাধ জোয়ার-ভাটার এই পদ্ধতি নদীর গভীরতা বাড়ানোর মাধ্যমে জলাবদ্ধতাও দূর করছে। গত তিন বছরে ভরাট হয়ে যাওয়া হরি নদীর প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকা পাঁচ থেকে ছয় মিটার গভীর হয়েছে। জলাবদ্ধতা দূর হয়েছে ২৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমির। বিল খুকশিয়াতেই উঁচু হওয়া জমিতে চাষ করে গত দুই বছরেই ১৫৩ কোটি টাকার অতিরিক্ত ফসল উত্পাদিত হয়েছে। গবেষণা সংস্থা আইডব্লিউএম ও সিইজিআইএসের সহযোগিতায় পানি উন্নয়ন বোর্ড এই তথ্য জানিয়েছে।
জলবায়ু অভিযোজনের নয়া কৌশল: জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার বেড়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ডুবে যাবে। জোয়ার-ভাটা চালিয়ে জমি এক মিটার উঁচু করলে এই ঝুঁকি মোকাবিলা করা যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জলাবদ্ধতাও দূর হবে। এ পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মহলেও সম্প্রতি আলোচিত হচ্ছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাতের মতে, টিআরএমের মাধ্যমে উপকূলে পরিকল্পিতভাবে পলি-ব্যবস্থাপনা সম্ভব। জমি উঁচু ও চাষযোগ্য করা, নদীর গভীরতা বাড়িয়ে জলাবদ্ধতা দূর করা, লবণাক্ততা কমানো ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে উপকূল রক্ষায় টিআরএম পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকর।
অবাধ জোয়ার-ভাটার কলাকৌশল: বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের হিসাবে প্রতিবছর বাংলাদেশ উপকূলে বঙ্গোপসাগরে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ঘনফুট পলি আসে। এর ৪০ ভাগ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল উপকূলে জড়ো হয়। ষাটের দশকের আগ পর্যন্ত পলি দিয়ে গঠিত একটি সক্রিয় বদ্বীপ ছিল এই অঞ্চল। ষাটের দশকের আগের সময়টাতে স্থানীয় মানুষ লবণপানি থেকে তাদের ফসলি জমি বাঁচাতে উপকূলীয় এলাকায় অষ্টমাসি বাঁধ (বছরে আট মাস স্থায়ী থাকত, আর বর্ষা মৌসুমে তা কেটে দেওয়া হতো) তৈরি করত।
ষাটের দশকে লবণপানি আটকে চাষাবাদের জমি বাড়াতে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও পোল্ডার তৈরি করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে বিপুল পরিমাণ উপকূলীয় জলাভূমি কৃষি জমির আওতায় এলেও তৈরি হয় ভিন্ন সমস্যা। বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর পলিগুলো ভূমিতে আসতে না পেরে নদীর বুকে এসে পড়তে থাকে। পলি পড়ে উঁচু হতে থাকে নদীর বুক। মরে যেতে থাকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশির ভাগ নদী। মূল ভূমির চেয়ে নদীর উচ্চতা বাড়ায় পানি আর বের হতে না পেরে তৈরি হতে থাকে জলাবদ্ধতা।
১৯৯০ সালে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বিল ডাকাতিয়াতে জলাবদ্ধতা তীব্রতা পায়। স্থানীয় জনগণ জলাবদ্ধতা দূর করতে পোল্ডার ও বাঁধ কেটে দেয়। শুরুতে জলাবদ্ধতার পরিমাণ বেড়ে গেলেও পরবর্তী সময়ে জলাবদ্ধতা কমে জমি উঁচু হতে থাকে। নদীর নাব্যতাও বেড়ে যায়। আশির দশকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জলাবদ্ধতার পরিমাণ বাড়তে থাকলে পাউবো নিত্যনতুন স্থাপনা তৈরি করে জলাবদ্ধতা দূর করার উদ্যোগ নেয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহায়তায় প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা-যশোর ড্রেনেজ রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট (কেজেডিআরপি) নামে একটি প্রকল্প নেয়। তৈরি হতে থাকে নিত্যনতুন স্থাপনা। এতে জলাবদ্ধতার পরিমাণ আরও বাড়ে।
এ সময় সিইজিআইএসের বিজ্ঞানীরা বিল ভায়নার জমি উঁচু হওয়ার ওপর একটি গবেষণা চালায়। টানা তিন বছর জোয়ার-ভাটার ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখতে পায়, কয়েক কোটি টাকা খরচ করে যে জলাবদ্ধতা দূর করতে কাজ করা হয়েছে, জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে তার চেয়ে সফলভাবে জলাবদ্ধতা দূর হয়েছে।
Source: Daily Prothom-alo : 08-07-2010

No comments:

Post a Comment