Saturday, December 25, 2010

দারিদ্র্য বিমোচনে পরমাণু কৃষি গবেষণা

দারিদ্র্য বিমোচনে পরমাণু কৃষি গবেষণা

ড. এম. রইসুল হায়দার
বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। একদিকে দেশের খাদ্য চাহিদা বাড়ছে অন্যদিকে প্রতি বছর আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। এ অবস্থায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির উপায় হচ্ছে দুটি : ১. একরপ্রতি ফলন বৃদ্ধি এবং ২. ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নত কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পরমাণু কৃষি গবেষণার প্রয়োজনীয়তা, সুবিধা, সীমাবদ্ধতা, গবেষণার সাফল্য এবং ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল বিষয়ে এ প্রবন্ধে আলোকপাত করা হলো- আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার তথ্যানুযায়ী পরমাণু শক্তি গাছের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনে কার্যকর উপকরণ। যেমন_ ফসলের ফলন, জীবনকাল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, গাছের ধরন বা উচ্চতা কমানো, গাছ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রকৃতি, হেলে পড়া রোধ, খরা ও লবণাক্ত সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি, রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী ক্ষমতা সৃষ্টি ইত্যাদি গুণাবলী উন্নয়নে পরমাণু শক্তির বিশেষ সফলতা পাওয়া যায়। এসব গুণাবলী উন্নয়ন করতে ৪-৫ বছর বছর সময় লাগে। অন্যান্য কৃষি গবেষণায় প্রধানত প্রজনন পদ্ধতিতে নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়। এ পদ্ধতিতে ফসলের জাত উদ্ভাবনে প্রায় ৮-১০ বছর সময় লাগে। এ পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত জাতে কিছু কিছু দোষ ত্রুটি থেকে যায়। যেমন_ আমাদের দেশে সর্বপ্রথম উন্নত জাতের বোরো ধান আইআর-৮ চাষ শুরু হয় ষাটের দশকে। এর মাধ্যমেই আমাদের দেশে সবুজ বিপ্লব শুরু হয়। কিন্তু এ জাতের জীবনকাল ১৭০-১৭৫ দিন হওয়ায় ত্রিফসলি জমিতে চাষ করা সমস্যা হয়। বিনা থেকে এভাবে পরমাণু শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ১৯৭৫ সনে ইরাটম-২৪ নামক একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়। এ জাতটি কিছু্টা খাট, জীবনকাল ১৪০-১৪৫ দিন। ফলন মাতৃজাতের (৬.০ টন/হেক্টর প্রতি) সমতুল্য। ফলে সারাদেশে চাষি কর্তৃক এ জাত গৃহীত হয়। এখনো প্রায় ৪% জমিতে এ জাতের চাষ হয়। একইভাবে মিউটেশন পদ্ধতিতে নাইজারশাইল থেকে বিনাশাইল, ব্রাসিকা নেপুস থেকে বিনা সরিষা-৩, ৪, ৫; চিনাবাদামের জাত ঢাকা-১ থেকে বিনা চিনাবাদাম-১, ২ ও ৩। বিদেশ থেকে সংগৃহীত একটি তিল জাত থেকে বিনাতিল-১, বিদেশ থেকে সংগৃহীত একটি মুগ জাত থেকে বিনামুগ-৫ জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জীবনকাল কমেছে এবং ফলনও ভালো হয়েছে। বিনা কর্তৃক উদ্ভাবিত উক্ত জাতগুলো ভালো গুণসম্পন্ন হওয়ায় চাষিদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পক্ষান্তরে বিনাধান-৪, বিনাধান-৫, বিনাধান-৬, বাহার (টমেটো) ইত্যাদি জাত মিউট্যান্ট জাতের সঙ্গে অন্য জাতের প্রজননের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে। এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত, মাঠ পর্যায়ে চাষাবাদ হয় এমন ভালো জাত সংগ্রহ করে তার দোষত্রুটি মিউটেন্ট পদ্ধতিতে তুলনামূলকভাবে সহজে সংশোধন করা যায়, যা কৃষি উৎপাদন ও দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। কৃষি উন্নয়ন, চাষিদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে পরমাণু কৃষি গবেষণা পদ্ধতির প্রয়োগ সহজেই কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বর্তমানে বাংলাদেশ স্বল্পকালীন ধানের জাত ব্রি ধান-২৮ এবং দীর্ঘ জীবনকালবিশিষ্ট জাত ব্রি ধান-২৯ মাঠ পর্যায়ে চাষ হচ্ছে। ব্রি ধান-২৮ এর হেলে পড়ার প্রবণতা আছে। মিউটেশন পদ্ধতিতে এ সমস্যা দূর করে এ জাতের ফলন শতকরা ১৫-২০ ভাগ সহজেই বাড়ানো সম্ভব। একইভাবে ব্রি ধান-২৯ এর ফলন ভালো এবং চাল চিকন, কিন্তু জীবনকাল বেশি হওয়ায় সব জায়গায় এটি চাষ করা যায় না। মিউটেশনের মাধ্যমে এ জাতের জীবনকাল কমানো সম্ভব, যাতে ফলনও ভালো হবে এবং ফসলের নিবিড়তাও বৃদ্ধি পাবে। বরেন্দ্র এলাকায় অন্যান্য জাতের তুলনায় স্বর্ণা জাতের ধান ভালো ফলন দেয়, ওইসব এলাকায় এ জাতের ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হয়। কিন্তু এ জাতের রোগের আক্রমণ বেশি বিধায় ফলন আশানুরূপ হয় না। মিউটেশনের মাধ্যমে এ জাতের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। ফসলের উন্নতজাত উদ্ভাবন ছাড়াও মৃত্তিকা পরীক্ষার মাধ্যমে নিখুঁতভাবে সার সুপারিশমালা, জীবাণু সার উদ্ভাবন এবং অন্যান্য কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পরমাণু শক্তির ব্যবহার খুবই কার্যকর ও সুবিধাজনক।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ।

No comments:

Post a Comment