Thursday, December 2, 2010

যাযাবর মৌচাষি

যাযাবর মৌচাষি

প্রাণিজগতে মৌমাছির অবস্থান কীটপতঙ্গ শ্রেণীতে। কীটপতঙ্গের মধ্যে মৌমাছির পরিচয় বাণিজ্যিক কীট হিসেবে। মৌমাছি সাধারণত কলোনিবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। একটি কলোনিতে তিন ধরনের মৌমাছি থাকে। প্রতি কলোনিতে ১টি মাত্র রাণী মৌমাছি একাধিক পুরুষ ও শ'শ' শ্রমিক মৌমাছি থাকে। শ্রমিক মৌমাছিগুলো সাধারণত বন্ধ্যা মৌমাছি। রাণী মৌমাছির কাজ হচ্ছে প্রতিটি মৌচাকের ছিদ্রে ডিম ছাড়া। পুরুষের কাজ হচ্ছে প্রজননে অংশগ্রহণ করা ও শ্রমিক মৌমাছির কাজ হচ্ছে কলোনি পাহাড়া দেয়া, ফুল থেকে পরাগরেণু এবং নেকটর মধু সংগ্রহ করা ও প্রয়োজনীয় সময়ের জন্য তা সংগ্রহ করে রাখা, বাচ্চা মৌমাছিদের পরিচর্ষা করা। আর শীতকালেই মৌমাছি দিয়ে সরিষা ক্ষেতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মধু সংগ্রহ করা যায়। মধু সাধারণত তৈরি হয় ফুলের পরাগরেণু ও ফুলের নেকটর থেকে। মৌমাছি মধু ও মোম দুটিই উৎপাদন করে থাকে এবং মধুর অনেক ঔষধি গুনাগুন রয়েছে, যা মানব দেহের রোগ প্রতিরোধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানের মত বাণিজ্যিকভাবে মৌমাছি পালন ও মধু সংগ্রহ হচ্ছে ধামরাই উপজেলার ভাড়ারিয়া ও ধামরাই সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন সরিষা ক্ষেত থেকে। গত এক মাস ধরে মধু সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক ব্যক্তি এনজিও ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলছে মধু সংগ্রহ। আবু তাহের তাদেরই একজন। ২০০০ সালে জাতীয় যুব উন্নয়ন ও ২০০২ সালে বিসিক থেকে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ৪ হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে চারটি বাক্সসহ মৌমাছি কেনেন। পরবতর্ী সময়ে মৌচাষ লাভজনক বলে এ পেশা ছেড়ে অন্য কোনো পেশায় যাওয়া হয়নি তার। বর্তমানে নিজের এলাকায়ই ৬০টি মৌবাক্স নিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন। ধামরাইয়ের সরিষা ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহের পর যাবেন গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও সুন্দরবনে। বছরে ছয় মাসই বিভিন্ন এলাকায় মধু সংগ্রহ করতে যাযাবরের মত ঘুরতে হয় তাকে। আর বাকি ছয় মাস ঘরে বসে মৌমাছিকে চিনিসহ বিভিন্ন খাদ্য দিতে হয়। আবু তাহের ধামরাইয়ের ইকুরিয়া ও ভাড়ারিয়ায় বাক্সের মধ্যে মৌমাছি পালন করে এখানে গড়ে তুলেছেন 'মৌমাছি কলোনি'। বর্তমানে এ মধু বোতলজাত করে 'বিসমিলস্নাহ খাঁটি মধু' নামে লেবেল লাগিয়ে বিক্রি করছেন স্থানীয় বাজারে। তার এ মৌ কলোনি দেখতে এবং প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মধু নিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসে ক্রেতারা। তিনি আরো জানান, গত বছর ৩৮টি মৌবাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করে তা প্রায় তিন লাখ টাকায় বিক্রি করেন। এ বছর সরিষার বাম্পার ফলন হওয়ায় তার খামারে ৬০টি বাক্স থেকে মধু বিক্রি হবে প্রায় ৭ লাখ টাকা। এতে তার খরচ হবে তিন লাখ টাকা। আর লাভ হবে ৪ লাখ টাকা। আবু তাহের মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহ করে আজ নিজের ভাগ্যের চাকা বদলে ফেলেছেন। তবে সরকারের সহযোগিতা পেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও মধু রফতানি করতে পারবেন বলে আশাবাদী তিনি। ধামরাইয়ের ইকুরিয়া গ্রামের আবু তাহেরই নন, পাশের ডেমরান গ্রামের আয়ুব আলী, রাজধানীর কোতোয়ালির বেলায়েত হোসেন, সাতক্ষীরার এবাদুলস্নাহ, আফজালের বাড়ি একেক জায়গায় হলেও এরা সবাই পেশায় মৌচাষি। আবার তাদের কেউ বলেন মৌপালক। দেশের অন্যান্য মৌচাষি বা মৌপালকের থেকে এদের জীবনের গল্পটা অন্য রকম। এরা মধু সংগ্রহের জন্য যাযাবরের মত ঘুরে বেড়ান এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। কখনো ধামরাই, কখনো ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, গাজিপুর, সিরাজগঞ্জ বা সুন্দরবন। যেখানেই মধু সেখানেই বাক্স পেটরা নিয়ে হাজির হন এই মৌপালকরা। আবু তাহেরের মত তারাও আজ মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহের পর তা বিক্রি করে এখন স্বাবলম্বী। ধামরাইয়ের আশুলিয়া গ্রামে এবার মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন ঢাকার কোতয়ালির বেলায়েত হোসেন। তিনি বলেন, ১৯৬০ সাল থেকে তার বাবা এ মৌমাছি পালন শুরু করেন। বাবা মারা যাবার পর ১৮ বছর ধরে এ পেশার সঙ্গে তিনি জড়িয়ে আছেন। প্রত্যেকেই মৌমাছি পালন ও মধু সংগ্রহের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বিসিক, যুব উন্নয়ন ও মধুপুরের মৌচাষ উন্নয়ন সংস্থার ভূমিকা এ ক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য। এরা যে বিপুল পরিমাণ মধু সংগ্রহ করে তা প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাত করে। দেশের বেশকিছু নামী প্রতিষ্ঠানও ইতিমধ্যেই এদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে মধু সংগগ্রহের জন্য। কলারোয়ার বিসিক সংস্থাটি এবার ৮০টন মধু সংগ্রহ করে তা বিভিন্ন স্থানে পাঠাবে। মৌচাষিরা মৌমাছির বংশ বৃদ্ধি ঘটিয়ে, সেই মৌমাছি বিক্রি করেও একটা বড় অংকের টাকা আয় করছেন। প্রতি বছরের মত এবারো ধামরাইয়ে সরিষার বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি বিভাগ। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা খায়রুল আলম প্রিন্স বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মৌচাষিরা প্রতি বছর ধামরাইয়ের সরিষা ক্ষেত থেকে শতশত মণ মধু সংগ্রহ করে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছেন। আর মৌমাছি দিয়ে সরিষা ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহ করলে সরিষার ফলনও ভাল হয়।
মোকলেছুর রহমান, ধামরাই, ঢাকা
Source: Daily Ittefaq

No comments:

Post a Comment