সম্ভাবনার আরেক দুয়ার ওষুধ শিল্প
আরএইচ কৌশিক
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করছে। দু'দশক আগেও এ দেশ ছিল বিদেশি ওষুধের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে মানুষের চাহিদার প্রায় সবটাই দেশে তৈরি ওষুধই মেটাচ্ছে। তাছাড়া উল্লেখযোগ্যভাবে বিদেশে বাংলাদেশি ওষুধ রফতানিও বাড়ছে। ওষুধ রফতানি তাই একটি চমকপ্রদ সাফল্যচিত্র। এ শিল্পের উৎপাদিত ওষুধ বিদেশে রপ্তানি করে প্রতি বছর দেশ আয় করছে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থানও হচ্ছে এ শিল্পের মাধ্যমে।
দেশে ওষুধ শিল্পের ২৫৭টি কোম্পানির নিবন্ধন আছে। এর মধ্যে বর্তমানে ১৯৪টি কোম্পানি ওষুধ উৎপাদন করছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ৫টি কোম্পানি ৪৫ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন করে। অন্যদিকে ১৫৪টি কোম্পানি মাত্র ৪ শতাংশ উৎপাদন করে। বর্তমানে বাংলাদেশ ৮০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে। এ খাতের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা মনে করেন সরকার কিছু নীতিগত সিদ্ধান- নিলে ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ অনেক বাড়ানো সম্ভব। ন্যাশনাল রেগুলেটরি অথরিটি এবং ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে উপযুক্ত লোকবল নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটিকে আরো গতিশীল এবং বিদেশে এ খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে আগামী ২০১৫ সাল নাগাদ বছরে ৫ বিলিয়ন ডলারের ওষুধ রফতানি করা সম্ভব হবে।
ওষুধ কোম্পানি উদ্যোক্তারা মনে করছেন, বাংলাদেশের ওষুধ রফতানির ক্ষেত্রে কিছু আইনি ও নীতিগত বাধা রয়েছে। এগুলো দূর করতে পারলে বিশ্ববাজারে ওষুধ রফতানির বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। সরকারি সহায়তা পেলে এ বাজার ২০ গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ওষুধ রফতানিতে সরকারি কোনো সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে স্বাস্থ্য রক্ষায় দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ২৫ শতাংশ ওষুধ বিদেশে রফতানি হচ্ছে।
২০০৯-১০ অর্থবছরে ওষুধ রফতানি পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৯ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০০৮-০৯ সালে ছিল ৪ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ডলারের সমান। চলতি অর্থবছরের (২০১০-১১) জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন- এ খাতে রফতানি হয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার ডলার। যা ওই সময়ের টার্গেটের চেয়ে দশমিক ৬৩ ভাগ বেশি। এজন্য সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ বছর ওষুধ রফতানির চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করা সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, স্বল্পোন্নত দেশের অন-ভর্ুক্ত বলে বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন- যে কোনো পেটেন্টপ্রাপ্ত ওষুধ জেনেরিক ফর্মে উৎপাদন করতে পারবে। ট্রিপস চুক্তির আওতায় কোনো কোম্পানি নতুন ওষুধ আবিষ্কার করে বাজারজাত করলে প্রোডাক্ট পেটেন্ট পাওয়ার যোগ্যতাবলে সে কোম্পানিকে সরকার তার দেশে ২০ বছরের জন্য একচেটিয়া ব্যবসা করতে দিতে বাধ্য। ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে দোহায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মন্ত্রিপর্যায়ের এক সম্মেলনে ট্রিপস চুক্তি এবং ওষুধের সহজলভ্যতার প্রশ্নে এক ঘোষণা দেয়া হয়। দোহা ঘোষণায় ৪৯টি স্বল্পোন্নত দেশকে ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন- পেটেন্টপ্রাপ্ত যে কোনো ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করার অধিকার দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ওষুধের মান অনেক বেড়েছে। অনেক কোম্পানিতে বিশ্বমানের ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। এ কারণে বিদেশে ওষুধের বাজার দ্রুত সম্প্র্রসারিত হচ্ছে। দেশের অন্যান্য পণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, সে তুলনায় ওষুধের দাম সেভাবে বাড়েনি। ভারতের চেয়ে আমাদের দেশে ওষুধের দাম এখনো অনেক কম। ভারতে একটি প্যারাসিটামলের দাম আমাদের চেয়ে দ্বিগুণ। ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতার কারণে ওষুধের মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। তাছাড়া কাঁচামালের দামও কমেছে। এ কারণে কম মূল্যে ক্রেতারা ওষুধ কিনতে পারছে।
সম্ভাবনার এ শিল্পের উদ্যোক্তারা বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ চেয়েছেন সরকারের কাছে। তারা বলছেন, তৈরি পোশাক খাতের মতো ওষুধ শিল্পের জন্যও ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা দেয়া হলে এ খাতের রপ্তানি অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু এ মুহূর্তে এ দাবি মানতে রাজি হননি অর্থমন্ত্রী। তবে তাদের দাবি-দাওয়া বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
রাজধানীর একটি হোটেলে 'রিজিওনাল ফোরাম ফর দ্য পলিসি মেকার অন দ্য ডেভেলপড কান্ট্রিজ অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন' শীর্ষক সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওষুধ শিল্পের জন্য স্বল্পনোন্নত দেশগুলোর জন্য নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আরো ১৫ বছর মেধাসম্পদ স্বত্ব ছাড় দিতে বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রোপাার্টি অর্গানাইজেশন (ডবিলউআইপিও) প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সে সময় তিনি বলেন, এসব উন্নতমানের ওষুধ স্বল্পোন্নত দেশগুলোসহ ৭০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
সম্প্রতি এক সেমিনারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বিদেশে ওষুধ শিল্পে শর্তসাপেক্ষে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করছে। তবে ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষেই এ বিষয়ে চূড়ান- সিদ্ধান- নেয়া হবে। ওষুধ রফতানি বাড়ানোর জন্য এ সুযোগ দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। দেশে ভেজাল ওষুধ উৎপাদন বন্ধে ওষুধ প্রশাসন এবং ন্যাশনাল রেগুলেটরি অথরিটিকে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
আগামী এক বছরের মধ্যে ওষুধ শিল্পের জন্য সরকার অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) শিল্পপার্ক স্থাপন করবে। ইতোমধ্যে ঢাকার অদূরে গজারিয়ায় এজন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এ পার্ক স্থাপন হলে আগামীতে ওষুধ রফতানি আরো বাড়বে।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, গত ২৫ বছরে ওষুধখাত অপার সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। দেশে যে উপযুক্ত সম্পদ রয়েছে সেগুলোকে কাজে লাগানো গেলে এ সেক্টর আরো অনেক এগিয়ে যাবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বলেছেন, ওষুধ শিল্পে বর্তমানে যেসব সমস্যা আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, সেগুলো অবশ্যই সমাধানযোগ্য এবং সরকার এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। তবে এসব সমস্যা সমাধানে ওষুধ শিল্প সমিতিকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারলে এ শিল্পের উন্নয়ন তরান্বিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশে এ শিল্পে বিনিয়োগ যে বাড়ছে তার প্রমাণ হলো, গত ৩ বছরে বাংলাদেশে ৫০টি নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি সূত্রেই এ তথ্য জানা গেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ এখন ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনেও হাত দিয়েছে। বর্তমানে ওষুধ শিল্পের ৭০ শতাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে। তাই মূল্যবান এ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে হলে প্রস-াবিত কাঁচামাল উৎপাদনের শিল্প পার্ক নির্মাণে হাত দিতে হবে।
রফতানিবান্ধব এ শিল্পের জন্য যে আইন ও সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন, তা নেই। যে কারণে ২০১৫ সালের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সিআইএস দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে বছরে ১০০ কোটি টাকারও বেশি ওষুধ রফতানি করা সম্ভব। ওই সব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িক যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেই এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বিকাশে সরকারের কোনো প্রত্যক্ষ সহায়তা ছিল না এবং বর্তমান অবস্থা একই রকম।
এসব সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু সমস্যাও রয়ে গেছে। সম্ভাবনাময় এ ওষুধ শিল্পের বাজার সমপ্রসারণ এবং এর বিভিন্ন সমস্যা দেখভাল করার জন্য যে দক্ষ ওষুধ প্রশাসন দরকার তা নেই আমাদের দেশে। জনবলের অভাবে ধুঁকছে ওষুধ প্রশাসন। স্বল্প সংখ্যক জনবল ও অদক্ষ ওষুধ প্রশাসন দিয়ে বিদেশের বাজার সমপ্রসারণের কাজ করা দুরূহ হবে। তাই বিদেশের বাজার সমপ্রসারণে ওষুধ প্রশাসনে আরো দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। এছাড়া ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে কঠোর থাকতে হবে। এ ধরনের ঘটনা ওষুধ শিল্পের ইমেজ ক্ষুন্ন করতে পারে। তাই ওষুধের মানের ব্যাপারে কোনো প্রকার আপস করা চলবে না। আমরা যদি মান নিয়ন্ত্রণে শিথিলতা প্রদর্শন করি, তাহলে চিংড়ি শিল্পের মতো একসময় ইউরোপের বাজারে এ শিল্পের ব্যাপারেও আপত্তি উঠতে পারে।
এদিকে ওষুধ ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে বিদেশ বিনিয়োগের জন্য লাইসেন্স প্রদানের আহ্বান জানিয়ে আসলেও সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া না যাচ্ছে না। এছাড়া বিদেশে ওষুধ রফতানির জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এছাড়া রফতানি বৃদ্ধি করতে হলে বিদেশে মার্কেটিং অফিস স্থাপন করতে হয়। এজন্য ফি দিতে হয়। কিন্তু ওই খরচের টাকা বাংলাদেশ থেকে বৈধপথে পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নীতিমালা থাকা উচিত বলে মনে করছেন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। তবে আশার আলো হচ্ছে ওষুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে চলেছে। সরকার ইতোমধ্যে কাঁচামাল উৎপাদনের শিল্প পার্ক স্থাপনের জন্য জায়গা দিয়েছে। ওই স্থানে ওষুধের কাঁচামাল তৈরি শিল্প পার্ক স্থাপনে উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসছে।
Source: Daily Ittefaq
দেশে ওষুধ শিল্পের ২৫৭টি কোম্পানির নিবন্ধন আছে। এর মধ্যে বর্তমানে ১৯৪টি কোম্পানি ওষুধ উৎপাদন করছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ৫টি কোম্পানি ৪৫ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন করে। অন্যদিকে ১৫৪টি কোম্পানি মাত্র ৪ শতাংশ উৎপাদন করে। বর্তমানে বাংলাদেশ ৮০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে। এ খাতের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা মনে করেন সরকার কিছু নীতিগত সিদ্ধান- নিলে ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ অনেক বাড়ানো সম্ভব। ন্যাশনাল রেগুলেটরি অথরিটি এবং ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে উপযুক্ত লোকবল নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটিকে আরো গতিশীল এবং বিদেশে এ খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে আগামী ২০১৫ সাল নাগাদ বছরে ৫ বিলিয়ন ডলারের ওষুধ রফতানি করা সম্ভব হবে।
ওষুধ কোম্পানি উদ্যোক্তারা মনে করছেন, বাংলাদেশের ওষুধ রফতানির ক্ষেত্রে কিছু আইনি ও নীতিগত বাধা রয়েছে। এগুলো দূর করতে পারলে বিশ্ববাজারে ওষুধ রফতানির বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। সরকারি সহায়তা পেলে এ বাজার ২০ গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ওষুধ রফতানিতে সরকারি কোনো সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে স্বাস্থ্য রক্ষায় দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ২৫ শতাংশ ওষুধ বিদেশে রফতানি হচ্ছে।
২০০৯-১০ অর্থবছরে ওষুধ রফতানি পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৯ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০০৮-০৯ সালে ছিল ৪ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ডলারের সমান। চলতি অর্থবছরের (২০১০-১১) জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন- এ খাতে রফতানি হয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার ডলার। যা ওই সময়ের টার্গেটের চেয়ে দশমিক ৬৩ ভাগ বেশি। এজন্য সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ বছর ওষুধ রফতানির চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করা সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, স্বল্পোন্নত দেশের অন-ভর্ুক্ত বলে বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন- যে কোনো পেটেন্টপ্রাপ্ত ওষুধ জেনেরিক ফর্মে উৎপাদন করতে পারবে। ট্রিপস চুক্তির আওতায় কোনো কোম্পানি নতুন ওষুধ আবিষ্কার করে বাজারজাত করলে প্রোডাক্ট পেটেন্ট পাওয়ার যোগ্যতাবলে সে কোম্পানিকে সরকার তার দেশে ২০ বছরের জন্য একচেটিয়া ব্যবসা করতে দিতে বাধ্য। ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে দোহায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মন্ত্রিপর্যায়ের এক সম্মেলনে ট্রিপস চুক্তি এবং ওষুধের সহজলভ্যতার প্রশ্নে এক ঘোষণা দেয়া হয়। দোহা ঘোষণায় ৪৯টি স্বল্পোন্নত দেশকে ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন- পেটেন্টপ্রাপ্ত যে কোনো ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করার অধিকার দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ওষুধের মান অনেক বেড়েছে। অনেক কোম্পানিতে বিশ্বমানের ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। এ কারণে বিদেশে ওষুধের বাজার দ্রুত সম্প্র্রসারিত হচ্ছে। দেশের অন্যান্য পণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, সে তুলনায় ওষুধের দাম সেভাবে বাড়েনি। ভারতের চেয়ে আমাদের দেশে ওষুধের দাম এখনো অনেক কম। ভারতে একটি প্যারাসিটামলের দাম আমাদের চেয়ে দ্বিগুণ। ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতার কারণে ওষুধের মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। তাছাড়া কাঁচামালের দামও কমেছে। এ কারণে কম মূল্যে ক্রেতারা ওষুধ কিনতে পারছে।
সম্ভাবনার এ শিল্পের উদ্যোক্তারা বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ চেয়েছেন সরকারের কাছে। তারা বলছেন, তৈরি পোশাক খাতের মতো ওষুধ শিল্পের জন্যও ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা দেয়া হলে এ খাতের রপ্তানি অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু এ মুহূর্তে এ দাবি মানতে রাজি হননি অর্থমন্ত্রী। তবে তাদের দাবি-দাওয়া বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
রাজধানীর একটি হোটেলে 'রিজিওনাল ফোরাম ফর দ্য পলিসি মেকার অন দ্য ডেভেলপড কান্ট্রিজ অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন' শীর্ষক সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওষুধ শিল্পের জন্য স্বল্পনোন্নত দেশগুলোর জন্য নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আরো ১৫ বছর মেধাসম্পদ স্বত্ব ছাড় দিতে বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রোপাার্টি অর্গানাইজেশন (ডবিলউআইপিও) প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সে সময় তিনি বলেন, এসব উন্নতমানের ওষুধ স্বল্পোন্নত দেশগুলোসহ ৭০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
সম্প্রতি এক সেমিনারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বিদেশে ওষুধ শিল্পে শর্তসাপেক্ষে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করছে। তবে ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষেই এ বিষয়ে চূড়ান- সিদ্ধান- নেয়া হবে। ওষুধ রফতানি বাড়ানোর জন্য এ সুযোগ দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। দেশে ভেজাল ওষুধ উৎপাদন বন্ধে ওষুধ প্রশাসন এবং ন্যাশনাল রেগুলেটরি অথরিটিকে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
আগামী এক বছরের মধ্যে ওষুধ শিল্পের জন্য সরকার অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) শিল্পপার্ক স্থাপন করবে। ইতোমধ্যে ঢাকার অদূরে গজারিয়ায় এজন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এ পার্ক স্থাপন হলে আগামীতে ওষুধ রফতানি আরো বাড়বে।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, গত ২৫ বছরে ওষুধখাত অপার সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। দেশে যে উপযুক্ত সম্পদ রয়েছে সেগুলোকে কাজে লাগানো গেলে এ সেক্টর আরো অনেক এগিয়ে যাবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বলেছেন, ওষুধ শিল্পে বর্তমানে যেসব সমস্যা আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, সেগুলো অবশ্যই সমাধানযোগ্য এবং সরকার এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। তবে এসব সমস্যা সমাধানে ওষুধ শিল্প সমিতিকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারলে এ শিল্পের উন্নয়ন তরান্বিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশে এ শিল্পে বিনিয়োগ যে বাড়ছে তার প্রমাণ হলো, গত ৩ বছরে বাংলাদেশে ৫০টি নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি সূত্রেই এ তথ্য জানা গেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ এখন ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনেও হাত দিয়েছে। বর্তমানে ওষুধ শিল্পের ৭০ শতাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে। তাই মূল্যবান এ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে হলে প্রস-াবিত কাঁচামাল উৎপাদনের শিল্প পার্ক নির্মাণে হাত দিতে হবে।
রফতানিবান্ধব এ শিল্পের জন্য যে আইন ও সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন, তা নেই। যে কারণে ২০১৫ সালের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সিআইএস দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে বছরে ১০০ কোটি টাকারও বেশি ওষুধ রফতানি করা সম্ভব। ওই সব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িক যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেই এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বিকাশে সরকারের কোনো প্রত্যক্ষ সহায়তা ছিল না এবং বর্তমান অবস্থা একই রকম।
এসব সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু সমস্যাও রয়ে গেছে। সম্ভাবনাময় এ ওষুধ শিল্পের বাজার সমপ্রসারণ এবং এর বিভিন্ন সমস্যা দেখভাল করার জন্য যে দক্ষ ওষুধ প্রশাসন দরকার তা নেই আমাদের দেশে। জনবলের অভাবে ধুঁকছে ওষুধ প্রশাসন। স্বল্প সংখ্যক জনবল ও অদক্ষ ওষুধ প্রশাসন দিয়ে বিদেশের বাজার সমপ্রসারণের কাজ করা দুরূহ হবে। তাই বিদেশের বাজার সমপ্রসারণে ওষুধ প্রশাসনে আরো দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। এছাড়া ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে কঠোর থাকতে হবে। এ ধরনের ঘটনা ওষুধ শিল্পের ইমেজ ক্ষুন্ন করতে পারে। তাই ওষুধের মানের ব্যাপারে কোনো প্রকার আপস করা চলবে না। আমরা যদি মান নিয়ন্ত্রণে শিথিলতা প্রদর্শন করি, তাহলে চিংড়ি শিল্পের মতো একসময় ইউরোপের বাজারে এ শিল্পের ব্যাপারেও আপত্তি উঠতে পারে।
এদিকে ওষুধ ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে বিদেশ বিনিয়োগের জন্য লাইসেন্স প্রদানের আহ্বান জানিয়ে আসলেও সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া না যাচ্ছে না। এছাড়া বিদেশে ওষুধ রফতানির জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এছাড়া রফতানি বৃদ্ধি করতে হলে বিদেশে মার্কেটিং অফিস স্থাপন করতে হয়। এজন্য ফি দিতে হয়। কিন্তু ওই খরচের টাকা বাংলাদেশ থেকে বৈধপথে পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নীতিমালা থাকা উচিত বলে মনে করছেন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। তবে আশার আলো হচ্ছে ওষুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে চলেছে। সরকার ইতোমধ্যে কাঁচামাল উৎপাদনের শিল্প পার্ক স্থাপনের জন্য জায়গা দিয়েছে। ওই স্থানে ওষুধের কাঁচামাল তৈরি শিল্প পার্ক স্থাপনে উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসছে।
Source: Daily Ittefaq
No comments:
Post a Comment