Monday, December 27, 2010

লোকায়ত কৌশলে উঁচু হয়েছে ৩২ বর্গকিলোমিটার জমি : বিপর্যয় ঠেকাতে জাগছে মানুষ

লোকায়ত কৌশলে উঁচু হয়েছে ৩২ বর্গকিলোমিটার জমি:

বিপর্যয় ঠেকাতে জাগছে মানুষ

ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের জেঠুয়া বিলসংলগ্ন বেড়িবাঁধ ছয় ফুট ভেঙে যায়। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়া জলোচ্ছ্বাসের পানিতে তলিয়ে যায় তিনটি গ্রামের প্রায় তিন শ ঘরবসতি। ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে কপোতাক্ষের জোয়ারের পানি ও তার সঙ্গে আসা পলিমাটি প্রবেশ করতে থাকে। বর্ষার সময় স্থানীয় লোকজন দেখতে পায়, পলি আসার পরিমাণ বেড়ে গেছে। পলি জমে জেঠুয়া বিলের পাশাপাশি কৃষ্ণকাঠি ও চরকানাইদিয়া বিলের বেশির ভাগ জমিও উঁচু হতে শুরু করেছে।
জালালাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সর্দার রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে স্থানীয় বেশ কয়েকজন তরুণ বেড়িবাঁধের আরও ১৯০ ফুট অংশ কেটে দেয়। বর্ষাজুড়ে অবাধ জোয়ার-ভাটা চলতে দেওয়ায় তিনটি বিলের প্রায় ৫০০ হেক্টর জমি কয়েক ফুট উঁচু হয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানায়। ভাটার টানে পানি বের হওয়ার সময় কপোতাক্ষের বিলসংলগ্ন অংশ প্রাকৃতিকভাবেই খনন হয়ে যাচ্ছে বলে জানান স্থানীয় তরুণ লুত্ফর মোড়ল।
সম্প্রতি আইলা ও সিডরে বিধ্বস্ত খুলনা, সাতক্ষীরা জেলাসংলগ্ন কপোতাক্ষ, শিবসা ও আপার ভদ্রা নদীর এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বেড়িবাঁধের বাইরে বিপুল পরিমাণে পলি পড়ে আছে। খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ এবং সাতক্ষীরার আশাশুনি ও তালা উপজেলাসংলগ্ন নদীর মধ্যে কিছু দূর পরপর বিশাল চরের দেখা মিলেছে। স্থানীয় লোকজন জানায়, এ চরগুলো আইলার পর সৃষ্টি হয়েছে। নদীর গভীরতাও অনেক স্থানে কমেছে। ট্রলারে করে আশাশুনি থেকে কয়রা যাওয়ার পথে বেশ কিছু স্থানে বিশাল চরের দেখা মিলেছে।
পানি ও নদী-ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণায় নিযুক্ত সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) গবেষক মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আইলার আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় অনেক এলাকার পলি আসার পরিমাণ বেড়ে গেছে। জেঠুয়া বিল জোয়ার-ভাটায় উঁচু হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, এর আগের গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, এ বিলে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি করে জমি উঁচু করা সম্ভব। স্থানীয় জনগণের উদ্যোগ তা সত্য প্রমাণ করে দেখাল।
আইলা ও সিডরের কারণে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক বিলেই পলি আসার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে জমি উঁচু হচ্ছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকারের উচিত, উপকূলের কোন কোন এলাকায় অবাধ জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি করে জমি উঁচু করা সম্ভব, তা চিহ্নিত করা। যে এলাকার নদীর পানিতে পলির পরিমাণ বেশি, সেখানে অবাধ জোয়ার-ভাটা করা, আর যেখানে বেড়িবাঁধ প্রয়োজন, সেখানে তা নির্মাণ করা।
অবাধ জোয়ার-ভাটা নামের এই পদ্ধতি ব্যবহার করে গত ২০ বছরে যশোর ও সাতক্ষীরার তিনটি বিলের ৩১ দশমিক ৩৫ বর্গ কিলোমিটার জমি এক থেকে দুই ফুট উঁচু করেছে উপকূলবাসী। জেঠুয়া বিলের উঁচু হওয়া জমি হিসাব করলে তার পরিমাণ ৩২ বর্গ কিলোমিটার হবে বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) গবেষণা পরিচালক জহিরুল হক খান।
বুদ্ধিটা পুরোনো: জোয়ারের সঙ্গে আসা পলি পরিকল্পিতভাবে ব্যবহারের জ্ঞান বা বুদ্ধির পুরোটাই দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলবাসীর। বাপ-দাদাদের কাছ থেকে শেখা। সমুদ্র থেকে নদী হয়ে উপকূলের দিকে আসা বিপুল পরিমাণ পলি পরিকল্পিতভাবে ব্যবহারের কৌশল এখানকার মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে। বিজ্ঞানীরাও দীর্ঘ গবেষণা শেষে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন।
উপকূলবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অবাধ জোয়ার-ভাটার পদ্ধতি খুব কঠিন কিছু নয়। কপোতাক্ষ, শিবসা, পশুর, মাথাভাঙ্গাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলো দিয়ে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পলি আসে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধে তা বাধা পেয়ে নদীর বুকে জমা হয়। স্থানীয় কিছু উদ্যোগী মানুষ পলি বেশি আসে, এমন কয়েকটি স্থান চিহ্নিত করে তা কেটে দেওয়ার পর দেখা গেল, জোয়ারের সঙ্গে আসা পলিগুলো বিলের ভেতর এসে পড়ছে। এতে জমি যেমন উঁচু হচ্ছে, তেমনি ভাটার পানির টানে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে নদী গভীর হচ্ছে।
নদী ও পলি ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণাকারী সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) সম্প্রতি এক গবেষণা করে দেখতে পেয়েছে, শুধু যশোর জেলার উপকূলীয় আটটি বিলে অবাধ জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে ৬৯ দশমিক ৭০ বর্গ কিলোমিটার জমি দুই মিটার উঁচু করা সম্ভব। খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, ভোলা, পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় অন্য জেলাগুলোতেও অবাধ জোয়ার-ভাটা করা সম্ভব কি না, তা খতিয়ে দেখছে তারা।
সরকারি সংস্থা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যশোর জেলার বিল খুকশিয়ায় অবাধ জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে গত তিন বছরে ৬৫০ হেক্টর জমি এক থেকে দেড় মিটার উঁচু করেছে। বিল ভায়েনা ও বিল ডাকাতিয়াসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলে অবাধ জোয়ার-ভাটা চালিয়ে প্রায় ৩১ দশমিক ৮২ কিলোমিটার ভূমি উঁচু করা হয়েছে।
অবাধ জোয়ার-ভাটার এই পদ্ধতি নদীর গভীরতা বাড়ানোর মাধ্যমে জলাবদ্ধতাও দূর করছে। গত তিন বছরে ভরাট হয়ে যাওয়া হরি নদীর প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকা পাঁচ থেকে ছয় মিটার গভীর হয়েছে। জলাবদ্ধতা দূর হয়েছে ২৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমির। বিল খুকশিয়াতেই উঁচু হওয়া জমিতে চাষ করে গত দুই বছরেই ১৫৩ কোটি টাকার অতিরিক্ত ফসল উত্পাদিত হয়েছে। গবেষণা সংস্থা আইডব্লিউএম ও সিইজিআইএসের সহযোগিতায় পানি উন্নয়ন বোর্ড এই তথ্য জানিয়েছে।
জলবায়ু অভিযোজনের নয়া কৌশল: জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্যানেলের (আইপিসিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার বেড়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ডুবে যাবে। জোয়ার-ভাটা চালিয়ে জমি এক মিটার উঁচু করলে এই ঝুঁকি মোকাবিলা করা যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জলাবদ্ধতাও দূর হবে। এ পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মহলেও সম্প্রতি আলোচিত হচ্ছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাতের মতে, টিআরএমের মাধ্যমে উপকূলে পরিকল্পিতভাবে পলি-ব্যবস্থাপনা সম্ভব। জমি উঁচু ও চাষযোগ্য করা, নদীর গভীরতা বাড়িয়ে জলাবদ্ধতা দূর করা, লবণাক্ততা কমানো ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে উপকূল রক্ষায় টিআরএম পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকর।
অবাধ জোয়ার-ভাটার কলাকৌশল: বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের হিসাবে প্রতিবছর বাংলাদেশ উপকূলে বঙ্গোপসাগরে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ঘনফুট পলি আসে। এর ৪০ ভাগ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল উপকূলে জড়ো হয়। ষাটের দশকের আগ পর্যন্ত পলি দিয়ে গঠিত একটি সক্রিয় বদ্বীপ ছিল এই অঞ্চল। ষাটের দশকের আগের সময়টাতে স্থানীয় মানুষ লবণপানি থেকে তাদের ফসলি জমি বাঁচাতে উপকূলীয় এলাকায় অষ্টমাসি বাঁধ (বছরে আট মাস স্থায়ী থাকত, আর বর্ষা মৌসুমে তা কেটে দেওয়া হতো) তৈরি করত।
ষাটের দশকে লবণপানি আটকে চাষাবাদের জমি বাড়াতে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও পোল্ডার তৈরি করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে বিপুল পরিমাণ উপকূলীয় জলাভূমি কৃষি জমির আওতায় এলেও তৈরি হয় ভিন্ন সমস্যা। বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর পলিগুলো ভূমিতে আসতে না পেরে নদীর বুকে এসে পড়তে থাকে। পলি পড়ে উঁচু হতে থাকে নদীর বুক। মরে যেতে থাকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশির ভাগ নদী। মূল ভূমির চেয়ে নদীর উচ্চতা বাড়ায় পানি আর বের হতে না পেরে তৈরি হতে থাকে জলাবদ্ধতা।
১৯৯০ সালে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বিল ডাকাতিয়াতে জলাবদ্ধতা তীব্রতা পায়। স্থানীয় জনগণ জলাবদ্ধতা দূর করতে পোল্ডার ও বাঁধ কেটে দেয়। শুরুতে জলাবদ্ধতার পরিমাণ বেড়ে গেলেও পরবর্তী সময়ে জলাবদ্ধতা কমে জমি উঁচু হতে থাকে। নদীর নাব্যতাও বেড়ে যায়। আশির দশকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জলাবদ্ধতার পরিমাণ বাড়তে থাকলে পাউবো নিত্যনতুন স্থাপনা তৈরি করে জলাবদ্ধতা দূর করার উদ্যোগ নেয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহায়তায় প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা-যশোর ড্রেনেজ রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট (কেজেডিআরপি) নামে একটি প্রকল্প নেয়। তৈরি হতে থাকে নিত্যনতুন স্থাপনা। এতে জলাবদ্ধতার পরিমাণ আরও বাড়ে।
এ সময় সিইজিআইএসের বিজ্ঞানীরা বিল ভায়নার জমি উঁচু হওয়ার ওপর একটি গবেষণা চালায়। টানা তিন বছর জোয়ার-ভাটার ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখতে পায়, কয়েক কোটি টাকা খরচ করে যে জলাবদ্ধতা দূর করতে কাজ করা হয়েছে, জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে তার চেয়ে সফলভাবে জলাবদ্ধতা দূর হয়েছে।
Source: Daily Prothom-alo : 08-07-2010

Sunday, December 26, 2010

উদ্ভাবন: পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুত্

উদ্ভাবন: পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুত্

শুভংকর কর্মকার | তারিখ: ২৩-০৮-২০১০


পাথরকুচি পাতা থেকে তৈরি দ্রবণই বিদ্যুত্ তৈরির মূল উপাদান। বিদ্যুত্ দিয়ে এনার্জি বাল্ব জ্বালাচ্ছেন উদ্ভাবক মো. কামরুল আলম খান ছবি: মনিরুল আলম * ভাঙাচোরা একটি চেয়ারের ওপর একটি ছোট বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। লক্ষ করলে মনে হবে, পাখায় বিদ্যুত্সংযোগ নেই। আছে শুধু একটি প্লাস্টিকের মগের মধ্যে সবুজ রঙের তরল পদার্থ। সেই তরলের মধ্যে দুটি ধাতব পাত ডোবানো। পৃথক তার সেই পাত দুটিকে যুক্ত করেছে পাখার সঙ্গে। এতেই পাখা ঘুরছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একটি পরীক্ষাগারের সামনে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সপ্তাহখানেক ধরে এই পাখাটি অবিরাম ঘুরছে। মগের ওই তরল পদার্থ আসলে পাথরকুচি পাতার রস। ওই রসই বিদ্যুতের মূল উৎস। নতুন এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. কামরুল আলম খান। তিনি বললেন, পাথরকুচির পাতা থেকে উত্পাদিত বিদ্যুত্ দিয়ে বাতি জ্বালানো, পাখা ঘোরানো এমনকি টেলিভিশন চালানোও সম্ভব। এতে খরচও অনেক কম। শুরুর গল্প: কামরুল আলম বলেন, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা, বিদ্যুত্ সমস্যা—এসব নিয়ে ভাববার সময় মনে হয়েছে উদ্ভাবন ছাড়া সংকট মোকাবিলা সম্ভব হবে না। নবায়নযোগ্য শক্তির কথাও ভেবেছেন তিনি। এসব ভাবতে ভাবতেই পাথরকুচি নিয়ে কাজ শুরু করেন। ২০০৮ সালের শুরুর দিকের কথা। এক ছাত্রকে দিয়ে মুন্সিগঞ্জ থেকে এক কেজি পাথরকুচি পাতা নিয়ে আসেন তিনি। তারপর শুরু হয় গবেষণা। কয়েক মাসের মধ্যেই আশানুরূপ ফল পেলেন তিনি। প্রথমে ১২ ভোল্টের ক্ষুদ্র আকৃতির বাতি জ্বালিয়ে তিনি আশার আলো দেখতে পান। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে শিল্প মন্ত্রণালয়ে এই উদ্ভাবনের মেধাস্বত্ব নিবন্ধন (প্যাটেন্ট) করেন তিনি। এরপর গত দেড় বছরের গবেষণার পর বৈদ্যুতিক বাতি, পাখা, সাদাকালো টেলিভিশন চালাচ্ছেন তিনি। গবেষণার টেবিলে পাথরকুচি: বাংলাদেশে পাথরকুচি পাতা নামে পরিচিত হলেও (বৈজ্ঞানিক নাম Bryophillum বা ব্রায়োফাইলাম) বিভিন্ন দেশে এটি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। ভেষজগুণের কারণে অনেকে পাথরকুচিকে ‘মিরাকল লিফ’ বলেন। পেটের ব্যথা কমাতে দেশের অনেক অঞ্চলে এই পাতার ব্যবহার আছে। পাথরকুচির পাতায় কী আছে, যা বিদ্যুত্ উৎপাদন করে? এমন প্রশ্নের উত্তরে কামরুল আলম বলেন, পদার্থের মধ্যে এসিডিক (অম্লীয়) হাইড্রোজেন আয়ন ও ক্ষারীয় হাইড্রোক্সিল আয়ন থাকে। এসিডিক (অম্লীয়) হাইড্রোজেন আয়ন বেশি পরিমাণে থাকলে সেই পদার্থ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। তিনি বলেন, পাথরকুচি পাতায় হাইড্রোজেন আয়নের পরিমাণ প্রায় ৭৮ শতাংশ, যা বিদ্যুত্ উৎপাদনে খুবই সহায়ক। কামরুল আলম আরও কয়েকটি গাছের পাতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি দেখেছেন তেঁতুল, লেবু, আলু, আম, কাঁঠাল, টমেটো, বটের পাতায় ক্ষারীয় আয়নের পরিমাণ বেশি বলে বিদ্যুত্ উত্পাদন সম্ভব নয়। যেভাবে বিদ্যুত্ উৎপাদিত হয়: পাথরকুচি পাতা দিয়ে ব্লেন্ডার মেশিনের মাধ্যমে শরবতের মতো দ্রবণ তৈরি করা হয়। দ্রবণে পাথরকুচি পাতা ও পানির অনুপাত হতে হবে ৮:১। ওই দ্রবণ প্লাস্টিকের পাত্রে রাখা হয়। এরপর একটি তামা ও একটি দস্তার পাত দ্রবণে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। দ্রবণের সংস্পর্শে আসামাত্রই রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে তামার পাতে ধনাত্মক ও দস্তার পাতে ঋণাত্মক বিভবের (পটেনশিয়াল) সৃষ্টি হয়। বিপরীতমুখী এই বিভবের দ্বারাই দুই পাতের মধ্যে বিভব পার্থক্য হয়। এতেই বিদ্যুত্প্রবাহ সৃষ্টি হয়। বেশি বিদ্যুত্ পেতে হলে একাধিক তামা ও দস্তার পাত ঘন করে সমান্তরালভাবে বসাতে হবে। পাথরকুচি পাতা চাষ: পাথরকুচি পাতার চাষ বেশ সহজ। পাথরকুচির শুধু পাতা মাটিতে ফেলে রাখলেই সেখান থেকে গাছ জন্মায়। পতিত জমি, বাড়ির ছাদে, উঠানে, টবে, যেকোনো জায়গায় এই পাতার চাষ সম্ভব। কামরুল আলম বলেন, দেশের পতিত জমিতে সহজেই প্রচুর পাথরকুচি পাতার চাষ সম্ভব। আর চাষের এক মাসের মধ্যেই পাতা কাজে লাগানো যায়। তিনি বলেন, বিদ্যুত্ তৈরি করতে এক মাসের মধ্যে নতুন করে পাথরকুচির দ্রবণের প্রয়োজন পড়ে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ আলোকিত করতে পরিকল্পনা করেছেন কামরুল আলম। এর জন্য ৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুত্ দরকার হবে। আর ওই পরিমাণ বিদ্যুত্ উৎপাদন করতে লাগবে প্রায় ৪০০ কেজি পাতা। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা মুঠোফোনে তাঁকে বলেছেন, তাঁরা পাতা সরবরাহ করবেন। খরচ হবে কম: কামরুল আলম বলেন, পাথরকুচি পাতা দিয়ে বিদ্যুত্ উৎপাদনে খরচ হবে কম। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ পড়বে এক টাকার কম। এটা সৌরবিদ্যুত্ উৎপাদন খরচের তিন ভাগের এক ভাগ। তিনি দাবি করেন, ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে অবকাঠামো খাতে ব্যয় হবে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি: এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বহনযোগ্য বৈদ্যুতিক পাখা তৈরি করেছেন কামরুল আলম। ১২ ভোল্টের এই বৈদ্যুতিক পাখা টানা এক মাস হাওয়া দিতে পারে। এক মাস পর শুধু দ্রবণ পাল্টে দিলেই পাখা আবার ঘুরবে। কামরুল আলম বলেন, দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুত্সংযোগের আওতায় এলেও লোডশেডিংয়ে তারা বিপর্যস্ত। তিনি বলেন, পল্লি অঞ্চলে তাঁর প্রযুক্তি সহজেই ব্যবহার করা সম্ভব হবে। প্রতিটি পরিবার নিজেদের প্রয়োজনের বিদ্যুত্ নিজেরা উৎপাদন করতে পারবে। বিদ্যুত্ উৎপাদনের পর দ্রবণের বর্জ্য অন্য কাজেও ব্যবহার করা যাবে। পাথরকুচির বর্জ্য কোনো পাত্রে বদ্ধ অবস্থায় রাখলে তা থেকে মিথেন গ্যাস পাওয়া যায়। এই গ্যাস দিয়ে রান্না করা সম্ভব। গ্যাস উৎপাদনের পর বর্জ্য আবার জৈব সার হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। চাই আরও গবেষণা: কামরুল আলম খান নিজের অর্থে এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে সহায়তা নিয়ে এ পর্যন্ত গবেষণা চালিয়ে এসেছেন। কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী গবেষণার জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারছেন না। পাথরকুচির দ্রবণ রাখার জন্য তাঁর দরকার বড় বড় পাত্র। বর্তমানে তিনি ব্যাটারির খোলস ব্যবহার করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বিশ্বব্যাংক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে ‘হেকেপ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প আছে। এই প্রকল্প গবেষণায় সহায়তা দেয়। কামরুল আলম পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপন ও গবেষণার জন্য সেখানে এক কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। কামরুল আলম বলেন, পাথরকুচি পাতা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুত্ ব্যবহারের জন্য আরও একটি গবেষণা চলছে। তিনি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মেসবাহউদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধানে গবেষণাটি চলছে। কামরুল আলম খান বলেন, ‘প্রথমে আমি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ও পরবর্তী সময়ে পুরো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে এই বিদ্যুত্ দিয়ে আলোকিত করতে চাই।’ এ ক্ষেত্রে সফল হলে তিনি দ্বীপাঞ্চলের মানুষের কাছে বিদ্যুত্ পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেবেন। এ জন্য ‘পাথরকুচি পাতাপল্লি’ স্থাপন করার পরিকল্পনা তাঁর আছে। তিনি বলেন, এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।
Source: Daily Prothom-alo : 2010 August 23

পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুত্ : কানাইঘাটের ৫৭টি পরিবার আলোকিত

কানাইঘাট (সিলেট) প্রতিনিধি

সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের ইসলামাবাদ গ্রামে ৫৭টি ঘরে গতকাল প্রাথমিকভাবে পাথরকুচি পাতা থেকে আবিষ্কৃত বিদ্যুত্ সংযোগ দেয়া হয়েছে। এ উপলক্ষে বিকাল ২টায় স্থানীয় ইসলামাবাদ মসজিদ প্রাঙ্গণে গোলাম কিবরিয়ার সভাপতিত্বে ও সমাজসেবী কামাল আহমদের পরিচালনায় এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কামরুল আলম খান। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কানাইঘাট-জকিগঞ্জ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী, কানাইঘাট উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আশিক উদ্দিন চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মতিউল ইসলাম চৌধুরী, গাছবাড়ি কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা আবদুর রহিম, ভাইস চেয়ারম্যান বদরুজ জামান ইকবাল, কানাইঘাট মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ সিরাজুল ইসলাম, আলম অটো লাইট প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান ফয়েজ আহমদ, এমডি মুফিজুল ইসলাম, বানীগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদ আহমদ, রাজাগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন প্রমুখ। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন ইকরা বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক মওদুদ আহমদ। প্রধান অতিথি তার বক্তব্যে বলেন, পাথরকুচি পাতা থেকে আবিষ্কৃত বিদ্যুত্ দিয়ে এসি, ডিসি চলবে। গ্রাম-গঞ্জের যেখানে বিদ্যুতের আলো এখনও পৌঁছেনি, সেখানে আলম অটো লাইট লিমিটেডের মাধ্যমে স্বল্পখরচে সহজেই আমরা বিদ্যুত্ সংযোগ ও বিতরণ শুরু করেছি। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য স্থানেও এ প্রযুক্তির বিদ্যুত্ সুবিধা পৌঁছে দেয়া হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ফরিদ চৌধুরী পবিত্র কোরআনের সূরা ইয়াসিনের ৮৩নং আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ হতে অগ্নি উত্পাদন করেন এবং তোমরা তা দ্বারা অগ্নি প্রজ্বলিত কর।’ ব্যাপক গবেষণার পর পাথরকুচি পাতা থেকে আবিষ্কৃত সিপিএস বিদ্যুত্ আলম অটো লাইট লিমিটেডের মাধ্যমে টাঙ্গাইল, চাঁদপুর, গাজীপুর ও সিলেট জেলাসহ আরও বিভিন্ন স্থানে চালু করার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এ লক্ষ্যে তিনি সবার সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন। আলম অটো লাইট প্রাইভেট লিমিটেডের সহযোগিতায় বাংলাদেশকে বিদ্যুতায়িত করে বহির্বিশ্বেও পাথরকুচি পাতা থেকে আবিষ্কৃত বিদ্যুত্ রফতানি করা যাবে বলে সভায় জানানো হয়।
Source: Daily Amardesh: 26th December

Saturday, December 25, 2010

সম্ভাবনার আরেক দুয়ার ওষুধ শিল্প

সম্ভাবনার আরেক দুয়ার ওষুধ শিল্প

আরএইচ কৌশিক

বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করছে। দু'দশক আগেও এ দেশ ছিল বিদেশি ওষুধের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে মানুষের চাহিদার প্রায় সবটাই দেশে তৈরি ওষুধই মেটাচ্ছে। তাছাড়া উল্লেখযোগ্যভাবে বিদেশে বাংলাদেশি ওষুধ রফতানিও বাড়ছে। ওষুধ রফতানি তাই একটি চমকপ্রদ সাফল্যচিত্র। এ শিল্পের উৎপাদিত ওষুধ বিদেশে রপ্তানি করে প্রতি বছর দেশ আয় করছে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থানও হচ্ছে এ শিল্পের মাধ্যমে।

দেশে ওষুধ শিল্পের ২৫৭টি কোম্পানির নিবন্ধন আছে। এর মধ্যে বর্তমানে ১৯৪টি কোম্পানি ওষুধ উৎপাদন করছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ৫টি কোম্পানি ৪৫ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন করে। অন্যদিকে ১৫৪টি কোম্পানি মাত্র ৪ শতাংশ উৎপাদন করে। বর্তমানে বাংলাদেশ ৮০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে। এ খাতের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা মনে করেন সরকার কিছু নীতিগত সিদ্ধান- নিলে ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ অনেক বাড়ানো সম্ভব। ন্যাশনাল রেগুলেটরি অথরিটি এবং ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে উপযুক্ত লোকবল নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটিকে আরো গতিশীল এবং বিদেশে এ খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে আগামী ২০১৫ সাল নাগাদ বছরে ৫ বিলিয়ন ডলারের ওষুধ রফতানি করা সম্ভব হবে।

ওষুধ কোম্পানি উদ্যোক্তারা মনে করছেন, বাংলাদেশের ওষুধ রফতানির ক্ষেত্রে কিছু আইনি ও নীতিগত বাধা রয়েছে। এগুলো দূর করতে পারলে বিশ্ববাজারে ওষুধ রফতানির বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে। সরকারি সহায়তা পেলে এ বাজার ২০ গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ওষুধ রফতানিতে সরকারি কোনো সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে স্বাস্থ্য রক্ষায় দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ২৫ শতাংশ ওষুধ বিদেশে রফতানি হচ্ছে।

২০০৯-১০ অর্থবছরে ওষুধ রফতানি পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৯ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০০৮-০৯ সালে ছিল ৪ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ডলারের সমান। চলতি অর্থবছরের (২০১০-১১) জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন- এ খাতে রফতানি হয়েছে ১ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার ডলার। যা ওই সময়ের টার্গেটের চেয়ে দশমিক ৬৩ ভাগ বেশি। এজন্য সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ বছর ওষুধ রফতানির চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করা সম্ভব হবে।

উল্লেখ্য, স্বল্পোন্নত দেশের অন-ভর্ুক্ত বলে বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন- যে কোনো পেটেন্টপ্রাপ্ত ওষুধ জেনেরিক ফর্মে উৎপাদন করতে পারবে। ট্রিপস চুক্তির আওতায় কোনো কোম্পানি নতুন ওষুধ আবিষ্কার করে বাজারজাত করলে প্রোডাক্ট পেটেন্ট পাওয়ার যোগ্যতাবলে সে কোম্পানিকে সরকার তার দেশে ২০ বছরের জন্য একচেটিয়া ব্যবসা করতে দিতে বাধ্য। ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে দোহায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মন্ত্রিপর্যায়ের এক সম্মেলনে ট্রিপস চুক্তি এবং ওষুধের সহজলভ্যতার প্রশ্নে এক ঘোষণা দেয়া হয়। দোহা ঘোষণায় ৪৯টি স্বল্পোন্নত দেশকে ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন- পেটেন্টপ্রাপ্ত যে কোনো ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করার অধিকার দেয়া হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের ওষুধের মান অনেক বেড়েছে। অনেক কোম্পানিতে বিশ্বমানের ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। এ কারণে বিদেশে ওষুধের বাজার দ্রুত সম্প্র্রসারিত হচ্ছে। দেশের অন্যান্য পণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, সে তুলনায় ওষুধের দাম সেভাবে বাড়েনি। ভারতের চেয়ে আমাদের দেশে ওষুধের দাম এখনো অনেক কম। ভারতে একটি প্যারাসিটামলের দাম আমাদের চেয়ে দ্বিগুণ। ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতার কারণে ওষুধের মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। তাছাড়া কাঁচামালের দামও কমেছে। এ কারণে কম মূল্যে ক্রেতারা ওষুধ কিনতে পারছে।

সম্ভাবনার এ শিল্পের উদ্যোক্তারা বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ চেয়েছেন সরকারের কাছে। তারা বলছেন, তৈরি পোশাক খাতের মতো ওষুধ শিল্পের জন্যও ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা দেয়া হলে এ খাতের রপ্তানি অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু এ মুহূর্তে এ দাবি মানতে রাজি হননি অর্থমন্ত্রী। তবে তাদের দাবি-দাওয়া বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

রাজধানীর একটি হোটেলে 'রিজিওনাল ফোরাম ফর দ্য পলিসি মেকার অন দ্য ডেভেলপড কান্ট্রিজ অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন' শীর্ষক সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওষুধ শিল্পের জন্য স্বল্পনোন্নত দেশগুলোর জন্য নির্ধারিত সময়ের চেয়ে আরো ১৫ বছর মেধাসম্পদ স্বত্ব ছাড় দিতে বিশ্ব মেধাসম্পদ সংস্থার ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রোপাার্টি অর্গানাইজেশন (ডবিলউআইপিও) প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সে সময় তিনি বলেন, এসব উন্নতমানের ওষুধ স্বল্পোন্নত দেশগুলোসহ ৭০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে।

সম্প্রতি এক সেমিনারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বিদেশে ওষুধ শিল্পে শর্তসাপেক্ষে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ার বিষয়টি সরকার বিবেচনা করছে। তবে ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষেই এ বিষয়ে চূড়ান- সিদ্ধান- নেয়া হবে। ওষুধ রফতানি বাড়ানোর জন্য এ সুযোগ দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। দেশে ভেজাল ওষুধ উৎপাদন বন্ধে ওষুধ প্রশাসন এবং ন্যাশনাল রেগুলেটরি অথরিটিকে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

আগামী এক বছরের মধ্যে ওষুধ শিল্পের জন্য সরকার অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) শিল্পপার্ক স্থাপন করবে। ইতোমধ্যে ঢাকার অদূরে গজারিয়ায় এজন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এ পার্ক স্থাপন হলে আগামীতে ওষুধ রফতানি আরো বাড়বে।

প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, গত ২৫ বছরে ওষুধখাত অপার সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। দেশে যে উপযুক্ত সম্পদ রয়েছে সেগুলোকে কাজে লাগানো গেলে এ সেক্টর আরো অনেক এগিয়ে যাবে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বলেছেন, ওষুধ শিল্পে বর্তমানে যেসব সমস্যা আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, সেগুলো অবশ্যই সমাধানযোগ্য এবং সরকার এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। তবে এসব সমস্যা সমাধানে ওষুধ শিল্প সমিতিকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারলে এ শিল্পের উন্নয়ন তরান্বিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

বাংলাদেশে এ শিল্পে বিনিয়োগ যে বাড়ছে তার প্রমাণ হলো, গত ৩ বছরে বাংলাদেশে ৫০টি নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি সূত্রেই এ তথ্য জানা গেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ এখন ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদনেও হাত দিয়েছে। বর্তমানে ওষুধ শিল্পের ৭০ শতাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে। তাই মূল্যবান এ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে হলে প্রস-াবিত কাঁচামাল উৎপাদনের শিল্প পার্ক নির্মাণে হাত দিতে হবে।

রফতানিবান্ধব এ শিল্পের জন্য যে আইন ও সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন, তা নেই। যে কারণে ২০১৫ সালের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সিআইএস দেশগুলোতে বাংলাদেশ থেকে বছরে ১০০ কোটি টাকারও বেশি ওষুধ রফতানি করা সম্ভব। ওই সব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িক যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেই এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের বিকাশে সরকারের কোনো প্রত্যক্ষ সহায়তা ছিল না এবং বর্তমান অবস্থা একই রকম।

এসব সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু সমস্যাও রয়ে গেছে। সম্ভাবনাময় এ ওষুধ শিল্পের বাজার সমপ্রসারণ এবং এর বিভিন্ন সমস্যা দেখভাল করার জন্য যে দক্ষ ওষুধ প্রশাসন দরকার তা নেই আমাদের দেশে। জনবলের অভাবে ধুঁকছে ওষুধ প্রশাসন। স্বল্প সংখ্যক জনবল ও অদক্ষ ওষুধ প্রশাসন দিয়ে বিদেশের বাজার সমপ্রসারণের কাজ করা দুরূহ হবে। তাই বিদেশের বাজার সমপ্রসারণে ওষুধ প্রশাসনে আরো দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। এছাড়া ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে কঠোর থাকতে হবে। এ ধরনের ঘটনা ওষুধ শিল্পের ইমেজ ক্ষুন্ন করতে পারে। তাই ওষুধের মানের ব্যাপারে কোনো প্রকার আপস করা চলবে না। আমরা যদি মান নিয়ন্ত্রণে শিথিলতা প্রদর্শন করি, তাহলে চিংড়ি শিল্পের মতো একসময় ইউরোপের বাজারে এ শিল্পের ব্যাপারেও আপত্তি উঠতে পারে।

এদিকে ওষুধ ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে বিদেশ বিনিয়োগের জন্য লাইসেন্স প্রদানের আহ্বান জানিয়ে আসলেও সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া না যাচ্ছে না। এছাড়া বিদেশে ওষুধ রফতানির জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এছাড়া রফতানি বৃদ্ধি করতে হলে বিদেশে মার্কেটিং অফিস স্থাপন করতে হয়। এজন্য ফি দিতে হয়। কিন্তু ওই খরচের টাকা বাংলাদেশ থেকে বৈধপথে পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নীতিমালা থাকা উচিত বলে মনে করছেন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা। তবে আশার আলো হচ্ছে ওষুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে চলেছে। সরকার ইতোমধ্যে কাঁচামাল উৎপাদনের শিল্প পার্ক স্থাপনের জন্য জায়গা দিয়েছে। ওই স্থানে ওষুধের কাঁচামাল তৈরি শিল্প পার্ক স্থাপনে উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসছে।
Source: Daily Ittefaq

আমাদের শুভ রায়ের কীর্তি

আমাদের শুভ রায়ের কীর্তি

নাসির উদ্দিন হায়দার |

গবেষণাগারে শুভ রায়
কৃত্রিম কিডনি তৈরি করে বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছেন বাঙালি বিজ্ঞানী শুভ রায়। এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে অসামান্য কীর্তি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। শুভ রায়ের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামে। শুভ রায় এবং তার গবেষণা দলের উদ্ভাবিত কিডনি ইতিমধ্যে প্রাণীর দেহে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মানবদেহে পরীক্ষা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। বিস্তারিত এই প্রতিবেদনে...


৪১ বছর আগের সেই দিনটির কথা বলতে গিয়ে অশীতিপর লীলাবতীর ঠোঁটে ফুটে ওঠে এক বিন্দু হাসির রেখা, বলতে থাকেন তিনি, ‘তখন রমজান মাস। সন্ধ্যায় আমার মেয়ের কোল আলো করে এল সেই রাজপুত্তুর, আর তখনই চারদিকে রব উঠল, ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। যে আয়াটি এক সপ্তাহ ধরে আমার মেয়ের সেবা করছিলেন, তিনি নবজাতককে কোলে নিয়ে বললেন, “আইজ ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। আপনের নাতির চেহারা তো চাঁদের লাহান। আমার মনে অয়, এই ছেলে একদিন আপনাগো মুখ উজ্জ্বল করব। ওর নাম রাখেন চান”।’
লীলাবতী টানা অনেক কথা বলে যেন একটু হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। একটু দম নিয়ে বললেন, ‘আজ আমার মনে হয়, হাসপাতালের সেই আয়ার কথা আজ সত্যি হয়েছে, আমার নাতি শুভ রায় আজ শুধু আমাদের মুখ আলো করেনি, দেশকেও গৌরবের আসনে বসিয়েছে।’

কী করেছেন লীলাবতীর নাতি শুভ রায়?

শুভ বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম কিডনি তৈরি করেছেন। এই কিডনি তৈরি চিকিৎসাবিজ্ঞানে অসামান্য কীর্তি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। শুভ রায় মাইক্রো ইলেকট্রো মেকানিক্যাল সিস্টেম টেকনোলজি ডেভেলপিং স্পেশালিস্ট। এর আগে ম্যাসাচুসেটসের ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির টপ হানড্রেড ইনোভেটর ২০০৩ অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার স্কুল অব ফার্মাসি অ্যান্ড মেডিসিনের বায়ো-ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড থেরাপিউটিক সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শুভ রায় ১০ বছর আগে ৪০ জন সহকর্মী নিয়ে কৃত্রিম কিডনি তৈরির কাজ শুরু করেন। গত তিনটি বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে এ কাজে সময় ব্যয় করেছেন তিনি এবং তাঁর গবেষক দল। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই দলটি ঘোষণা দেয়, তারা কৃত্রিম কিডনি তৈরি করে তা প্রাণীর দেহে প্রতিস্থাপন করে সফল হয়েছেন। আগামী পাঁচ বছরে আরও ব্যাপকভাবে বিভিন্ন প্রাণীর দেহে পরীক্ষার পর এটি মানবদেহে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন ওই দলের প্রধান শুভ রায়।

শেকড়ের সন্ধান
শুভ রায়ের জন্ম ১৯৬৯ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকায়। তাঁর বাবা অশোক নাথ রায়ের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির রোসাঙ্গগিরিতে। তাঁর দাদা নগেন দে বোয়ালখালীর স্যার কানুনগোপাড়া আশুতোষ কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। শুভর মা রত্না রায়ের বাড়ি চট্টগ্রাম শহরের আলকরণে।
শুভ রায়রা তিন ভাইবোনই থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। ছোট ভাই জয় রায় পেশায় ভাসকুলার সার্জন, বোন চৈতী রায় অ্যানেসথেটিক।
রত্না রায় জানান, পাঁচ বছর বয়সে ঢাকায় সিদ্ধেশ্বরীর একটি বিদ্যালয়ে নার্সারিতে শুভ রায়কে ভর্তি করানো হয়েছিল। কিন্তু স্বামীর পেশাগত কারণে ১৯৭৪ সালে তাঁদের উগান্ডায় চলে যেতে হয়। সেখানে স্বামী চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। শুভ রায়ের শিক্ষাজীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে উগান্ডা ও আমেরিকায়।
জানা যায়, উগান্ডার জিনজা সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল থেকে সেকেন্ডারি পাস করেছেন শুভ রায়। সেই স্কুলে পড়াতেন তাঁর মা-ও। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান শুভ। আন্ডার গ্র্যাজুয়েশন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের আলিয়ন্স ওহাইওর মাউন্ট ইউনিয়ন কলেজ থেকে।

শুভ কথন
শুভ রায় সম্প্রতি একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কলকাতায় এসেছিলেন। মুঠোফোন ও ই-মেইলে তাঁর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ হয় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে।
কৃত্রিম কিডনি তৈরির ধারণা কীভাবে এল? এমন প্রশ্নের জবাবে শুভ রায় বলেন, ‘আমার বাবা চিকিৎসক, পরিবারের আরও অনেকে চিকিৎসক। আমি কিন্তু চিকিৎসক হতে চাইনি, ভিন্ন কিছু হতে চেয়েছি, তাই প্রকৌশলবিদ্যা অধ্যয়ন করেছি। একজন প্রকৌশলী হিসেবে অধিক কার্যকর ডায়ালাইসিস যন্ত্র তৈরি করতে আগ্রহী ছিলাম। আর তা করতে গিয়ে আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করলাম, কৃত্রিম কিডনি তৈরির সম্ভাবনার দিকটি। গত তিন বছরে সব মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছিলাম এ বিষয়ে, আমি সাফল্যের ছোঁয়া পেয়েছি বলতে পারেন।’ প্রকৌশলী জীবনে উদ্ভাবনের নেশাটা কীভাবে হলো? এর উত্তরে বলেন, ‘আমি তো আগেই বলেছি, চিকিৎসক নয়, ভিন্ন কিছু হতে চেয়েছি।’ তারপর যোগ করেন, তিনি সূক্ষ্ম ওয়্যারলেস সেন্সর উন্নয়নের কাজ করেছেন। ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগীর জন্য এমন চিপস তৈরি করেছেন, যা শরীরে প্রতিস্থাপন করলে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না।

কিডনি তৈরির পূর্বাপর
ড. শুভ রায়ের তৈরি প্রতিস্থাপনযোগ্য কৃত্রিম কিডনির আকার হবে কফির কাপের মতো। এটি রক্ত থেকে বর্জ্য পরিশোধন করবে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও ভিটামিন ডি সংশ্লেষণ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায়ও সাহায্য করবে। ইতিমধ্যে ইঁদুর ও শূকরের দেহে সফলভাবে এই কৃত্রিম কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে প্রাণীর দেহে আরও ব্যাপকভাবে পরীক্ষা চালানো হবে। এরপর মানবদেহে প্রতিস্থাপনের পরীক্ষার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রতিস্থাপন সম্ভব হলে কিডনি রোগীদের জন্য শতাব্দীর আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচিত হবে এটা। কারণ, গুরুতর কিডনি রোগীদের বড় অংশই বেঁচে থাকেন ব্যয়বহুল ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে। কৃত্রিম কিডনি প্রতিস্থাপিত হলে ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হবে না।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার কিডনি তৈরি প্রকল্পের সদস্য ক্রিস্টেন বোল গত ৮ সেপ্টেম্বর ডেইলি মেইলকে বলেন, তাঁরা রক্ত থেকে বর্জ্য পরিশোধনের জন্য খুবই সূক্ষ্ম ফিল্টার তৈরি করবেন।
গত ৪ ডিসেম্বর দি ইকোনমিক টাইমস-এর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘ভারতে গুরুতর কিডনি-সমস্যায় ভুগতে থাকা দেড় লাখ রোগীর মধ্যে মাত্র তিন হাজার ৫০০ জনের শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপন করা যায়। ৬-১০ হাজার ডায়ালাইসিসের ওপর নির্ভর করেন। মানবদেহে শুভ রায়ের তৈরি কিডনি প্রতিস্থাপন করা গেলে ডায়ালাইসিসের প্রয়োজনীয়তা দূর হবে।’ ৩ ডিসেম্বর শুভ রায়ের কৃত্রিম কিডনি তৈরি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে এশিয়ান এজ।
শুভ রায় যখন টপ হানড্রেড ইনোভেটর ২০০৩ অ্যাওয়ার্ড পান, তখন তাঁর স্ত্রী মনিকা ম্যাথুস শাশুড়ির (শুভ রায়ের মা) কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আপনি কি খুশি হয়েছেন, মা? তখন শাশুড়ি রত্না রায় ছেলের বউয়ের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলের কাজ নিয়ে আমি সব সময় খুশি। তবে সবচেয়ে বেশি খুশি হব, যেদিন আমার ছেলে নোবেল পাবে।’
ছেলের এত বড় কীর্তির পর সে আশাটা আরও গভীরভাবে দেখেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে রত্না রায় বলেন, ‘আমি সেই দিনের প্রত্যাশায় আছি, যেদিন বিশ্বের দরবারে আরেকবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বাঙালি জাতি।’

শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ
২০০৩ সালের ঘটনা। অনেক বছর পর মেয়ে নাইয়র এসেছে বাপের বাড়িতে, সুদূর উগান্ডা থেকে। সঙ্গে এসেছে মেয়ের তিন সন্তান—শুভ রায়, জয় রায় ও চৈতী রায়। ভাগনে-ভাগনির মন জোগাতে নানি ও মামাদের চোখে ঘুম নেই। মেয়ে রত্না রায়ের নাইয়র উপলক্ষে ইন্দুভূষণ দত্তের আলকরণের বাড়িটা সদা সরগরম।
বড় ভাগনে প্রায় ঢুঁ মারে মামা চন্দ্রশেখর দত্তের গানের ঘরে। চন্দ্রশেখর শিল্পী, তাঁর ঘরে আছে হারমোনিয়ামসহ নানা বাদ্যযন্ত্র। মামার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত বেশ প্রিয় শুভর। দুই মামির সঙ্গেও গলায় গলায় ভাব তাঁর। ঘোরাঘুরি-ওড়াউড়ি থামছেই না।
শুভ এক দিন মামি কাকলী বিশ্বাস ও তৃপ্তি দের কাছে বায়না ধরলেন, সিনেমা দেখবেন। যেই বলা, সেই কাজ। রিকশায় করে তাঁরা ছুটলেন কাজির দেউড়ীর আলমাস সিনেমা হলে। রাতের শো, ছবির নাম শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ। শাবনূর-রিয়াজ অভিনীত সেই ছবি দেখে খুশিতে আটখানা শুভ রায়। মধ্যরাতে হইচই করে ফিরলেন আলকরণের বাসায়। বাড়িতে ঢোকার সময়ও শুভর মুখে শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ। দুয়ারে তখন দাঁড়ানো ছিলেন মামা চন্দ্রশেখর। ভাগনেকে নিয়ে মামার সরস মন্তব্য, ‘শুভ, তোমাকে শিগগিরই একটা শ্বশুরবাড়ি বানিয়ে দেব।’ মামার কথায় লজ্জা পেয়ে শুভ কথা ঘোরালেন। কিন্তু সত্যি সত্যি এর কিছুদিন পরই বিয়ে হয়ে গেল তাঁর। নিজের পছন্দে মার্কিন নাগরিক মনিকা ম্যাথুসকে বিয়ে করেন শুভ।
শুভর মা রত্না রায় জানান, ‘ছেলে নিজের পছন্দেই বিয়ে করেছে। তবে অনুষ্ঠানটা হয়েছে আমাদের পছন্দে। ১৫ দিনব্যাপী সেই অনুষ্ঠান ছিল জমকালো। বিয়ে হয়েছে বাঙালি রীতিতে। আমাদের এত রীতিনীতি পালনে তার কোনো বিরক্তি ছিল না।’
মামা উৎপল দত্ত বললেন, ‘ছোটবেলায় খুব মেধাবী ছিল শুভ রায়। উগান্ডা থেকে বেড়াতে এলে আমাদের বাড়িতে অনেক দিন থাকত, সঙ্গে বই-খাতা নিয়ে আসত। পড়াশোনায় অসম্ভব মনোযোগ ছিল শুভর। যে যা বলত, তা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনত।’
ভবিষ্যতের এই বিজ্ঞানীর ছায়া কি ছোটবেলায় দেখেছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে শুভ রায়ের বাবা অশোক নাথ রায় বলেন, ‘দেখতাম, শুভ একটা কিছু বারবার গড়ছে, আবার ভাঙছে। নতুন কিছু তৈরির ব্যাপারে তার আগ্রহ দেখে আমি অবাক হতাম, আবার খুব মজাও পেতাম।’
রত্না রায় কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘শুভ যে অনেক দূর যাবে, সেটা আমি জানতাম। কিন্তু সে কী কাজ করছে, সেটা নিয়ে খুব একটা কথা বলত না। সে যে কৃত্রিম কিডনি তৈরি করছে, সে ব্যাপারে আমাদের কিন্তু আগে থেকে কিছুই বলেনি। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে যখন তাঁকে নিয়ে হইচই হলো এশিয়ান এজ, ডেইলি মেইল, টাইমস অব ইন্ডিয়ার মতো পত্রিকাগুলোতে লেখালেখি হলো, তখন তাকে ফোন করলাম। কৃত্রিম কিডনি তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে সে বলল, “মা, এখনো অনেক কিছুই বাকি”।’
জীবনের বড় অংশ বিদেশে কাটলেও শেকড়ের প্রতি, চট্টগ্রামের প্রতি দুর্নিবার টান রয়েছে শুভ রায়ের। মা-বাবা বিদেশে তাঁকে অন্য ভাষার পাশাপাশি বাংলাও শিখিয়েছেন।
দেশের কথা, চট্টগ্রামের কথা বললেন শুভ রায়, ‘ডাল-ভাত আমার খুব পছন্দ। চাটগাঁ গেলে শুঁটকি খাব না, তা তো হয় না! মা ও মামিদের হাতে রান্না করা ইলিশ ও শুঁটকি আমার কাছে পৃথিবীর সেরা খাবার।’
চট্টগ্রাম নিয়ে আর কী স্মৃতি আছে? ‘আমার গ্রাম রোসাঙ্গগিরি গেলে আর ফিরতে ইচ্ছা করে না। ছোটবেলায় কত গেছি। এখন কিন্তু তেমন সময় পাই না। মনে পড়ে, দাদা কানুনগোপাড়া কলেজে শিক্ষকতা করতেন। মা-বাবার সঙ্গে বোয়ালখালী গেলে আমি করলডেঙ্গা পাহাড় চষে বেড়াতাম। কর্ণফুলীতে নৌকায় চড়ে হারিয়ে যেতাম, স্নান করতাম। খুব মনে পড়ে আমার চট্টগ্রামকে।’
Source: Daily Propthom Alo

দারিদ্র্য বিমোচনে পরমাণু কৃষি গবেষণা

দারিদ্র্য বিমোচনে পরমাণু কৃষি গবেষণা

ড. এম. রইসুল হায়দার
বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। একদিকে দেশের খাদ্য চাহিদা বাড়ছে অন্যদিকে প্রতি বছর আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। এ অবস্থায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির উপায় হচ্ছে দুটি : ১. একরপ্রতি ফলন বৃদ্ধি এবং ২. ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এবং অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নত কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। পরমাণু কৃষি গবেষণার প্রয়োজনীয়তা, সুবিধা, সীমাবদ্ধতা, গবেষণার সাফল্য এবং ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল বিষয়ে এ প্রবন্ধে আলোকপাত করা হলো- আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার তথ্যানুযায়ী পরমাণু শক্তি গাছের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনে কার্যকর উপকরণ। যেমন_ ফসলের ফলন, জীবনকাল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, গাছের ধরন বা উচ্চতা কমানো, গাছ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রকৃতি, হেলে পড়া রোধ, খরা ও লবণাক্ত সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি, রোগ ও পোকামাকড় প্রতিরোধী ক্ষমতা সৃষ্টি ইত্যাদি গুণাবলী উন্নয়নে পরমাণু শক্তির বিশেষ সফলতা পাওয়া যায়। এসব গুণাবলী উন্নয়ন করতে ৪-৫ বছর বছর সময় লাগে। অন্যান্য কৃষি গবেষণায় প্রধানত প্রজনন পদ্ধতিতে নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়। এ পদ্ধতিতে ফসলের জাত উদ্ভাবনে প্রায় ৮-১০ বছর সময় লাগে। এ পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত জাতে কিছু কিছু দোষ ত্রুটি থেকে যায়। যেমন_ আমাদের দেশে সর্বপ্রথম উন্নত জাতের বোরো ধান আইআর-৮ চাষ শুরু হয় ষাটের দশকে। এর মাধ্যমেই আমাদের দেশে সবুজ বিপ্লব শুরু হয়। কিন্তু এ জাতের জীবনকাল ১৭০-১৭৫ দিন হওয়ায় ত্রিফসলি জমিতে চাষ করা সমস্যা হয়। বিনা থেকে এভাবে পরমাণু শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ১৯৭৫ সনে ইরাটম-২৪ নামক একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়। এ জাতটি কিছু্টা খাট, জীবনকাল ১৪০-১৪৫ দিন। ফলন মাতৃজাতের (৬.০ টন/হেক্টর প্রতি) সমতুল্য। ফলে সারাদেশে চাষি কর্তৃক এ জাত গৃহীত হয়। এখনো প্রায় ৪% জমিতে এ জাতের চাষ হয়। একইভাবে মিউটেশন পদ্ধতিতে নাইজারশাইল থেকে বিনাশাইল, ব্রাসিকা নেপুস থেকে বিনা সরিষা-৩, ৪, ৫; চিনাবাদামের জাত ঢাকা-১ থেকে বিনা চিনাবাদাম-১, ২ ও ৩। বিদেশ থেকে সংগৃহীত একটি তিল জাত থেকে বিনাতিল-১, বিদেশ থেকে সংগৃহীত একটি মুগ জাত থেকে বিনামুগ-৫ জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জীবনকাল কমেছে এবং ফলনও ভালো হয়েছে। বিনা কর্তৃক উদ্ভাবিত উক্ত জাতগুলো ভালো গুণসম্পন্ন হওয়ায় চাষিদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পক্ষান্তরে বিনাধান-৪, বিনাধান-৫, বিনাধান-৬, বাহার (টমেটো) ইত্যাদি জাত মিউট্যান্ট জাতের সঙ্গে অন্য জাতের প্রজননের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে। এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত, মাঠ পর্যায়ে চাষাবাদ হয় এমন ভালো জাত সংগ্রহ করে তার দোষত্রুটি মিউটেন্ট পদ্ধতিতে তুলনামূলকভাবে সহজে সংশোধন করা যায়, যা কৃষি উৎপাদন ও দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। কৃষি উন্নয়ন, চাষিদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে পরমাণু কৃষি গবেষণা পদ্ধতির প্রয়োগ সহজেই কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বর্তমানে বাংলাদেশ স্বল্পকালীন ধানের জাত ব্রি ধান-২৮ এবং দীর্ঘ জীবনকালবিশিষ্ট জাত ব্রি ধান-২৯ মাঠ পর্যায়ে চাষ হচ্ছে। ব্রি ধান-২৮ এর হেলে পড়ার প্রবণতা আছে। মিউটেশন পদ্ধতিতে এ সমস্যা দূর করে এ জাতের ফলন শতকরা ১৫-২০ ভাগ সহজেই বাড়ানো সম্ভব। একইভাবে ব্রি ধান-২৯ এর ফলন ভালো এবং চাল চিকন, কিন্তু জীবনকাল বেশি হওয়ায় সব জায়গায় এটি চাষ করা যায় না। মিউটেশনের মাধ্যমে এ জাতের জীবনকাল কমানো সম্ভব, যাতে ফলনও ভালো হবে এবং ফসলের নিবিড়তাও বৃদ্ধি পাবে। বরেন্দ্র এলাকায় অন্যান্য জাতের তুলনায় স্বর্ণা জাতের ধান ভালো ফলন দেয়, ওইসব এলাকায় এ জাতের ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হয়। কিন্তু এ জাতের রোগের আক্রমণ বেশি বিধায় ফলন আশানুরূপ হয় না। মিউটেশনের মাধ্যমে এ জাতের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। ফসলের উন্নতজাত উদ্ভাবন ছাড়াও মৃত্তিকা পরীক্ষার মাধ্যমে নিখুঁতভাবে সার সুপারিশমালা, জীবাণু সার উদ্ভাবন এবং অন্যান্য কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পরমাণু শক্তির ব্যবহার খুবই কার্যকর ও সুবিধাজনক।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ।

Wednesday, December 22, 2010

দূষণ ঠেকাবে তিন অণুযোদ্ধা

দূষণ ঠেকাবে তিন অণুযোদ্ধাট্যানারিগুলোতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রচুর ক্রোমিয়াম। প্রক্রিয়া শেষে এর কিছু উচ্ছিষ্ট চলে যাচ্ছে নদীনালায়, আর কিছু হচ্ছে পশুপাখি ও মাছের খাবার। এভাবে মানুষের দেহে ঢুকে যাচ্ছে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম, ঘটাচ্ছে ক্যান্সারসহ অনেক রোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোজাম্মেল হক ও তাঁর গবেষক দল এমন তিনটি অণুজীব শনাক্ত করেছেন যেগুলো ওই বিষাক্ত ক্রোমিয়ামকে বানিয়ে দেবে পুরোপুরি নির্বিষ। আবিষ্কারের গল্পটা শোনাচ্ছেন তৌহিদ এলাহী
ড. মো. মোজাম্মেল হক (ডানে) ও তাঁর সহকারী ড. মো. ইলিয়াস (বামে), ইফতেখার মো. রফিকুল্লাহ রোমান (পেছনে ডানে) ও সফিউল ইসলাম ছবি_মোহাম্মদ আসাদ
দেশে প্রায় ৩০০ ট্যানারি আছে। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর ধারেই শতকরা নব্বই ভাগ চামড়া কারখানা। এগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ২২০ মেট্রিক টন চামড়া প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ৬০০-১০০০ কেজি উচ্ছিষ্ট পড়ছে নদীতে। কিছু কিছু আবার মুরগি ও মাছের খাদ্য এবং সার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় স্বাভাবিকভাবেই বিক্রিয়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয় প্রচুর ক্রোমিয়াম যৌগ, ক্রোম পাউডার, লিকার ইত্যাদি। এখান থেকে কোনোভাবে এই বিষাক্ত ক্রোমিয়াম মানুষের দেহে ঢুকে গেলে বা সংস্পর্শে এলে তৈরি হয় ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ। শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্যদ্রব্য বা পানীয়ের মাধ্যমে মানুষের সংস্পর্শে এলে ত্বকের প্রদাহ, অ্যালার্জি, ক্ষত, অ্যাজমা ঘটায়। নাকের সেপ্টাম পর্দা ছিদ্র করে ফেলতে পারে এই ক্রোমিয়াম। শ্বাসনালি ও পাকস্থলির বিষক্রিয়াও ঘটায়। পাকস্থলি ও অন্ত্রের প্রদাহ, যকৃৎ এবং মূত্রনালির সমস্যা তৈরি করতেও এর জুড়ি নেই।
গবেষণা দলের সহকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ইফতেখার মো. রফিকুল্লাহ রোমান জানান, ক্রোমিয়াম মানবদেহের ক্রোমোজোমের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ক্ষতিকর মিউটেশন বা পরিবর্তন ঘটিয়ে কোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি অর্থাৎ ক্যান্সার তৈরি করে। পাশাপাশি ক্রোমিয়ামযুক্ত চামড়া শিল্পের আবর্জনা জলজ পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে সেখানকার বাস্তুসংস্থানও নষ্ট করে। এর কারণে স্বাভাবিক অণুজীবের জীবনও বিপন্ন হয়। আর আমাদের চামড়া শিল্পের উচ্ছিষ্ট থেকে খাদ্য ও জৈবসার তৈরির প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানভিত্তিক পন্থাও অনুসরণ করা হয় না। ক্রোমিয়ামযুক্ত উচ্ছিষ্ট চামড়ার শতকরা ৫৩ ভাগের সঙ্গে কোনো যন্ত্রের সংস্পর্শ ঘটে না। সেগুলো থেকে খালি হাতেই তৈরি হচ্ছে মুরগি-মাছের খাবার। এর ধারাবাহিকতায় ক্রোমিয়াম ঢুকে যাচ্ছে শাকসবজিতে। পরে বিভিন্ন পর্যায়ে খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মানুষের দেহে ঢুকে বিপর্যয় ঘটাচ্ছে।
আগের এক গবেষণায় দেশের হাঁস-মুরগির খামার ও মাছের খাবারে ২.৪৯ শতাংশ ক্রোমিয়াম উপাদান পাওয়া গেছে। আর চামড়া শিল্প সংলগ্ন খালে ৪.০৬ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম) ঘনমাত্রায় এবং নদীতে ০.৪৪৩ পিপিএম ঘনমাত্রায় ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে।
অধঃক্ষেপণ, আয়ন বিনিময় ছাড়াও ক্রোমিয়াম দূষণ রোধে আরো কয়েকটি পদ্ধতি প্রচলিত আছে। তবে এগুলো সাশ্রয়ী নয়। প্রয়োজন প্রচুর রাসায়নিক বিক্রিয়ক ও জ্বালানি। এ কারণেই দেশে এগুলোর ব্যবহার চোখে পড়ে না। আবার পদ্ধতিগুলো অন্যভাবে পরিবেশের ক্ষতি করে। আর এ কাজে ড. মোজাম্মেল হকের গবেষণাপ্রাপ্ত অণুজীব ব্যবহার হবে সাশ্রয়ী ও শতভাগ পরিবেশবান্ধব।
রোমান জানান, চামড়া শিল্পে ব্যবহৃত ক্রোমিয়াম সাধারণত দু'ভাবে দ্রবণে মিশে থাকে। এর একটি ক্ষতিকর ও অন্যটি নিরীহ। এটিই গবেষণার মূল ভিত্তি। আবিষ্কৃত তিনটি অণুজীব হলো ইশেরিকিয়া, স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস, পেডিয়োকক্কাস পেন্টোসেসিয়াস। এরা ক্রোমিয়াম রিডাকটেজ নামের এক ধরনের এনজাইম বা উৎসেচক তৈরি করে। এই ক্রোমিয়াম রিডাকটেজ এনজাইম ক্ষতিকর ক্রোমিয়ামকে নিরীহ ক্রোমিয়ামে পরিণত করে।
এ গবেষণায় প্রথমে চামড়া শিল্প এলাকা সংলগ্ন খাল ও নদী থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আর উচ্ছিষ্ট চামড়াজাত দ্রব্য থেকে প্রস্তুত খাদ্যের জন্য হাজারীবাগ, নিমতলীর প্রাণী ও মৎস্য খাদ্য তৈরির কারখানাগুলো থেকে নমুনা খাদ্য সংগ্রহ করা হয়। পানির নমুনা থেকে 'লুরিয়া বারটানি আগার' নামের বিশেষ ব্যবস্থায় ইশেরিকিয়া, স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস এবং পেডিওকক্কাস পেন্টোসেসিয়াস ব্যাকটেরিয়া তিনটি শনাক্ত করা হয়। পরে আরেকটি পরীক্ষার মাধ্যমে অণুজীবগুলোর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। আর বিভিন্ন পর্যায়ে রাসায়নিক ও শারীরিক প্রক্রিয়াজাতকরণের পর খাদ্য উপাদানগুলো থেকে অ্যাটমিক অ্যাবজর্বশন স্পেকট্রোফটোমিটার (এএএস) যন্ত্রের সাহায্যে ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। পাশাপাশি এতে ক্ষতিকর ক্রোমিয়ামের পরিমাণ ও ঘনমাত্রাও বের করা হয়। এরপর শনাক্ত করা ব্যাকটেরিয়াগুলো ক্রোমিয়ামযুক্ত নমুনায় প্রয়োগের মাধ্যমে এগুলোর কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। দেখা যায়, অণুজীব নিঃসৃত ক্রোমিয়াম রিডাকটেজ এনজাইমের প্রভাবে বিষাক্ত ক্রোমিয়াম নিরীহ ক্রোমিয়ামে পরিণত হয়েছে। শনাক্তকারী তিনটি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে পেডিয়োকক্কাস পেন্টোসেসিয়াস সর্বোচ্চ কার্যকারিতা প্রদর্শন করেছে।
গবেষণা দলের প্রধান ড. মো. মোজাম্মেল হক জানান, এটি গবেষণার প্রাথমিক ধাপ। এটি শিল্প পর্যায়ে প্রয়োগের আগে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি চামড়া, খাদ্য ও পরিবেশসংশ্লিষ্ট মহলের ভূমিকা রাখতে হবে।
এই গবেষণাকর্ম নিয়ে ইতিমধ্যে দুটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। 'বাংলাদেশ জার্নাল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ' এবং বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস প্রকাশিত তৃতীয় বাংলাদেশ-জাপান জয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সের 'ফুড সেফটি অ্যান্ড হাইজিন' নামের বিজ্ঞান সাময়িকীগুলোতে প্রকাশিত প্রবন্ধ দুটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। ড. মো. মোজাম্মেল হকের এই গবেষণা দলে আরো ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস, শিক্ষার্থী শাহনেওয়াজ বিন মান্নান, বিজয়চন্দ্র দেবনাথ ও সফিউল ইসলাম।

Sunday, December 19, 2010

জলে স্থলে চলাচল উপযোগী গাড়ি

জলে স্থলে চলাচল উপযোগী গাড়ি
কামরুজ্জামান সোহেল, ফরিদপুর


স্বল্প শিক্ষিত দরিদ্র হাবিবুর রহমান ইমরান সম্প্রতি একটি গাড়ি তৈরি করেছেন। তার এ গাড়িটি যেনতেন গাড়ি নয়। একই সঙ্গে এ গাড়িটি যেমনি চলতে পারবে স্থলে তেমনি চলবে পানিতেও। শুধু গাড়ি আবিষ্কারই নয়, তিনি তৈরি করেছেন বিদ্যুৎ ছাড়া হস্তচালিত পাম্প, ডিম ফুটানো মেশিন ও রিমোট কন্ট্রোল বেবি কার। ফরিদপুরের শিবরামপুর এলাকার দরিদ্র শেখ হাসমত আলীর পুত্র হাবিবুর রহমান ইমরানের ইচ্ছার গল্প যেন কল্পনাকেও হার মানায়। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মেনেছে দারিদ্র্য ও শিক্ষা। স্কুলের গণ্ডি না পেরোনো ইমরান বেশকিছু আবিষ্কার করে প্রকৌশলীদেরও যেন হার মানিয়েছে। ৩৫ বছর বয়সী ইমরান ব্যবসা করতেন ফার্নিচারের। ৫ বছর আগে অসুস্থতার কারণে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কাজপাগল ইমরানের যখন সময় কাটতে চাইত না তখন তার মাথায় আজব সব বুদ্ধি খেলতে থাকে। প্রথমে তৈরি করেন ব্যাটারিচালিত বেবি কার। সে সময় আমেরিকার একটি কোম্পানি ব্র্যাকের সহযোগিতায় তার বেবি কার নিতে চায়। প্রাথমিকভাবে ৩০টির অর্ডারও দেয়। কিন্তু টাকার অভাবে গাড়ি বানাতে পারেনি ইমরান। এরপর ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক তৈরি করেন। সেটিও রাস্তায় নামাতে পারেননি পুঁজির অভাবে। এরপর একে একে হস্তচালিত পাম্প ও বিদ্যুৎ ছাড়া ডিম ফুটানো মেশিন আবিষ্কার করেন। এ মেশিন থেকে প্রতিদিন শত শত মুরগির ডিম ফুটানো হচ্ছে। নিজের ছোট্ট বাড়িটিতে গড়ে তুলেছেন মুরগির ফার্ম। ইমরান স্বপ্ন দেখেন একটি গাড়ি নির্মাণের। যে গাড়িটি চলবে রাস্তায় ও পানিতে। যে চিন্তা সেই কাজ। নেমে পড়লেন স্বপ্নের গাড়ি বানানোর চেষ্টায়। ১ বছরের পরিশ্রম ও ২ লাখ ১৮ হাজার টাকা খরচের পর ইমরান গাড়ি বানাতে সক্ষম হয়েছেন। নাম দিয়েছেন বোট অ্যান্ড কার। গাড়িটিতে ১৫ জন যাত্রী বসতে পারে। সামনের দিকটা বিমানের আদলে তৈরি। গাড়িটিতে রয়েছে টিভি-সিডি। শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিন দিয়ে গাড়িটি বানানো হলেও আধুনিক ইঞ্জিন লাগাতে পারলে আরও যাত্রী বহন সম্ভব হবে। পানিতে চলার সময় ঢেউয়ের কারণে তলিয়ে গেলে রিমোর্ট কন্ট্রোলের সাহায্যে ১ মিনিটের মধ্যে শনাক্ত এবং টেনে তোলা যাবে। ইমরানের গাড়িটি আগামী মাসেই রাস্তায় নামবে। গাড়িটিতে স্থাপন করা হয়েছে মাছ ধরার যন্ত্র। পানিতে চলার সময় অটোমেটিকভাবে মাছ তুলে আনতে পারবে। সরকারি কিংবা কোন প্রতিষ্ঠানের সাহায্য পেলে আরও আধুনিক মানের গাড়ি তৈরি করতে সক্ষম হবেন তিনি। দরিদ্র ইমরানের এসব কাজে উৎসাহ দিচ্ছেন বিদ্যুৎ বিভাগের গাড়ি চালক আবুল কালাম মোল্লা। ইমরানের ইচ্ছা দেশের বেকার যুবকদের কাজে লাগানোর মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করা। বিদ্যুৎ ঘাটতির এ দেশে এক মিনিটের বেশি বিদ্যুৎ যাতে না যায় সে জন্য নতুন আবিষ্কারে মনোযোগ দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
Source: Daily Bangladesh-pratidin

Related Links:

Car will drive on both land and water

গস্নাডিওলাস ফুল চাষি আফসার উদ্দিন

গস্নাডিওলাস ফুল চাষি আফসার উদ্দিন

পুষ্পানুরাগীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় গস্নাডিওলাস ফুল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে ঢাকার ধামরাই উপজেলার ফুটনগর বংশী নদীর তীরে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাহারি ফুলের চাষ বাংলাদেশেও লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ ফুল চাষ বদলে দিয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম ফুলচাষি মো. আফসার উদ্দিনের জীবন। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়-য়া আফসার উদ্দিন নিজেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফুলচাষি হিসেবে দাবি করেন। তিনি গত ২০ বছর ধরে ফুল চাষ করে আসছেন। শুরু করেছিলেন মাত্র দু'বিঘা জমিতে। এখন ধামরাইয়ের ফুটনগরে ফুল চাষ করছেন ৬০ বিঘা জমিতে। এলাকাবাসী এখন তাকে 'ফুলরাজ আফসার উদ্দিন' নামে ডাকেন। তার বাগানে এখন কাজ করেন ৪০ জন শ্রমিক। আফসার উদ্দিনের মতে, বছরে তার লাভ হয় ছয় থেকে আট লাখ টাকা। আফসার উদ্দিন নিজেই এ চাষ প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। ঢাকার শাহবাগ, খামার বাড়িসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তার ফুল বিক্রি হয়। নিজ প্রচেষ্টায় ফুল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে ঢাকার মিরপুর ১৮৫ নম্বর নবাববাগে তিনতলা বাড়ি করে স্ত্রী ও তিন সন্তানের সংসারে ভালই আছেন তিনি। আফসার উদ্দিন সাদা ফুলে যেন রঙিন জীবন ফিরে পেয়েছেন।

১৯৮৫ সালের কথা। আফসার উদ্দিন তখন ঠিকাদার হিসেবে মিরপুর চিড়িয়াখানায় খাদ্য সরবরাহের কাজ করতেন। পাশেই বোটানিক্যাল গার্ডেনের ফুলবাগান দেখে তার আগ্রহ জাগত ফুল চাষের। ১৯৯০ সালে মানিকগঞ্জের বারইরচর গ্রামে প্রথমে দু'বিঘা জমিতে গোলাপ ফুলের চাষ শুরু করেন। এরপর ফুল চাষ লাভজনক হওয়ায় ১৯৯৮ সালে প্রায় ১৬ বিঘা জমিতে নানা জাতের ফুলের চাষ করেন। ওই বছরের বন্যায় সব ফুল তলিয়ে গেলে প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। এরপরও থেমে থাকেননি আফসার উদ্দিন। পরবতর্ীতে অল্প পুঁজির মাধ্যমে রফতানি বু্যরো থেকে প্রশিক্ষণ শেষে ধামরাইয়ের ফুটনগর গ্রামে বংশী নদীর তীরে ৫ বিঘা জমি লিজ নিয়ে নতুন করে ফুলের চাষ শুরু করেন। বর্তমানে ধামরাইয়ে ৬০ বিঘা জমিতে গস্নাডিওলাস চাষ করছেন তিনি। প্রতি মাসে বিক্রি করছেন ২ লাখ টাকার ফুল। এরমধ্যে খরচ বাদে ৫০ হাজার টাকা লাভ হয়। এছাড়া সরকারিভাবে ফুল বিক্রির জন্য কোনো মার্কেট এমনকি বৈধ জায়গা না থাকায় ফুল বিক্রিতে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। রাস্তার ওপর অবৈধভাবে ভোরবেলায় ফুল বিক্রি করতে গেলে অনেক সময় পুলিশি ঝামেলায় পড়ে ন্যায্যমূল্য পান না।

দুঃখের সাথে আফসার উদ্দিন জানান, ব্যাপক আকারে ফুলচাষ করে বিদেশে রফতানি করার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু কোনো ফল পাইনি। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হয়ত এ ফুলের চাষ আরো ব্যাপকভাবে করা সম্ভব হত। আফসার উদ্দিন দুঃখের সাথে আরো বলেন, আমাদের কেউ মূল্যায়ন করে না। ফুলের বাগানে বিভিন্ন রোগ-বালাই দেখা দেয়। কিন্তু স্থানীয় কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা কোনো প্রকার সহায়তাও করে না। এ ব্যাপারে ধামরাই উপজেলা কৃষি অফিসার খাইরুল আলম প্রিন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ধামরাইয়ের ফুটনগরে ব্যাপক ফুলের চাষের কথা জানেন না বলে জানান।

মোকলেছুর রহমান, ধামরাই, ঢাকা

Tuesday, December 14, 2010

ছোট রাজ্যের বড় গবেষণা: বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু

ছোট রাজ্যের বড় গবেষণাবাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু
বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুঅ্যান্টিবায়োটিক, জৈব কীটনাশক থেকে শুরু করে এইচআইভি ও ক্যান্সার নিয়ে অনবদ্য সব গবেষণা করেছেন অনুজীববিজ্ঞানী ড. মো. আনোয়ার হোসেন। অনুজীবের মাধ্যমে পানি থেকে আর্সেনিক দূর করার গবেষণাও এগিয়েছে অনেকদূর। অসামান্য এ বিজ্ঞানীর গবেষণার আদ্যপান্ত জানাচ্ছেন তৌহিদ এলাহী ছবি_মোহাম্মদ আসাদ চিকিৎসা, মৎস্য, কৃষি, পশুপালন এসব ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়েটিক ব্যবহারের ফলে দেশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে অ্যান্টিবায়েটিক প্রতিরোধী অনেক জীবাণু। প্রচলিত সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক যেগুলো নির্মূল করতে পারে না। দীর্ঘদিনের গবেষণায় দেশে ক্ষতিকর এই সকল জীবাণুর উপস্থিতি ও প্রতিরোধের উপায় দেখালেন বিজ্ঞানী ড. মো. আনোয়ার হোসেন ও তাঁর সহযোগীরা অ্যান্টিবায়োটিকের বেশির ভাগই জীবদেহে কাজে না লেগে বের হয়ে যায় এবং পয়ঃনিষ্কাশন প্রণালীর মাধ্যমে পরিবেশ ও নদীনালায় ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় জীবদেহে অবস্থিত সব জীবাণুই অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে ধ্বংস হয় না। অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জিনগত পরিবর্তনের ফলে জীবাণুগুলো ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। পরে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিকেও সেগুলো ধ্বংস হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নিহাদ আদনান অমিত জানান, 'ক্ষতিকর অনুজীবরা খুবই চালাক। এরা জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী হয়ে যায়। এদের মধ্যে থাকে ক্ষুদ্রাকৃতির গোলাকার ডিএনএ কণিকা, যার আরেক নাম প্লাজমিড। এরা নিজেদের প্লাজমিডগুলোকে অন্য অনুজীবের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী প্লাজমিড যদি একই প্রক্রিয়ায় নিরীহ অনুজীবের মধ্যেও ঢুকে পড়ে, তবেই তারা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ক্ষমতা পেয়ে যায়।'
আরেক সহকারী গবেষক অভিনু কিবরিয়া ইসলাম জানালেন, 'অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অনুজীবগুলো দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে। আবার একই জীবাণুর মধ্যে অনেক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী প্লাজমিড ঢুকে গেলেই বাধে বিপত্তি। তখন এই ক্ষতিকর অনুজীবগুলোর বিরুদ্ধে উচ্চমাত্রার বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হলেও তারা ধ্বংস হয় না। এদের বলা হয় মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট অনুজীব। এই মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট অনুজীবগুলোই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য জৈব-আতঙ্ক হয়ে দেখা দিতে পারে। দেশে এখন যে হারে নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে এ দেশের পরিবেশ ও নদীনালাগুলো হাজারো ধরনের মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট অনুজীবে ভর্তি হয়ে যাবে।'
কোন পরিবেশ কোন অনুজীবগুলো কী কী ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্যভাণ্ডার নেই। গণবিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক, পিএইচডি গবেষক এবং এ গবেষণা দলের সদস্য শওকত মাহমুদ জানান, তাদের গবেষণালব্ধ উপাত্ত ভাণ্ডার এক অশনিসংকেতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দেশীয় পরিবেশ থেকে সংগৃহীত অনুজীবগুলোতে সিপ্রোফ্লোঙ্াসিন, পেনিসিলিন, অ্যাম্পিসিলিন, ব্যাসিট্রাসিন, স্টেপটোমাইসিন, টেট্রাসাইক্লিন, ইরাইথ্রোমাইসিন, জেন্টামাইসিন, সেফালোঙ্নি, সালফামিথাঙ্ল, নোভোবায়োসিন, অ্যামোঙ্িিসলিন, নাইট্রোফিউরাটয়ন ইত্যাদি বহুল ব্যবহৃত শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে ৪০-১০০ শতাংশ প্রতিরোধ ক্ষমতা পাওয়া গেছে।
গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনা অনুজীবগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং সাভারের বিভিন্ন খামার থেকে। ডায়রিয়া, টাইফয়েডের জীবাণু এমনকি নিরীহ ব্যাকটেরিয়ার মাঝেও দেখা গেছে অনেক বেশি ক্ষমতা। গবেষক রুহুল আমিন জানান, আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সিপ্রোফ্লোঙ্াসিন অ্যান্টিবায়োটিক বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অকার্যকর হয়ে গেছে। প্রতি মিলিমিটারে ০.০১৬ মাইক্রোগ্রাম ঘনমাত্রার সিপ্রোফ্লোঙ্াসিন নির্দিষ্ট পরিমাণে জীবাণু ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যান্টিবায়োটিকটির সর্বোচ্চ দ্রবণীয় ঘনমাত্রা প্রতি মিলিমিটারে ৫০০-৬০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত ব্যবহার করেও জীবাণু মারা যায়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতি লিটার তরল নিষ্কাশনে শুধু সিপ্রোফ্লোঙ্াসিন অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে ১২.৫ মাইক্রোগ্রাম করে। তবে গবেষণায় এও দেখা গেছে ইমিপেনিন, পলিমিঙ্নি নামের দুটি অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণুর বিরুদ্ধে ৯০-১০০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর।
এ গবেষণা প্রাথমিক পর্যায়ের। সূক্ষ্ম ফল জানতে আরো বড় গবেষণা করতে হবে। আরো পুরো দেশের সামগ্রিক চিত্র পেতে এই গবেষণাকর্মকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে তথ্যভাণ্ডার হালনাগাদ রাখার বিকল্প নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের যৌথ সহায়তায় এ গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতা করেছে থার্ডওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বায়োটেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার ও ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন (ইউজিসি)।

আসতে পারে সুপার বাগ! ড. মো. আনোয়ার হোসেন, চেয়ারম্যান, অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের দুরবস্থা খালি চোখেই দেখা যায়। অনেক সময় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই দেশের মানুষ নাজেনে, সাধারণ সর্দি-কাশি-জ্বর হলেও অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে, যেটি আদতে কোনো কাজেই আসে না। আজকাল আমাদের মুদির দোকানেও অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায়। অত্যুৎসাহী ডাক্তারও অনেক সময় বিনা প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়েটিক প্রেসক্রাইব করেন। আবার কেউ কেউ অ্যান্টিবায়োটিক সেবন শুরু করে রোগ ভালো হয়েছে মনে করে মাঝপথেই থেমে যান।
মানুষ হাসপাতালে যায় রোগ সারাতে। কিন্তু বাংলাদেশের হাসপাতালগুলো রোগবিস্তারেও ভূমিকা রাখছে। বর্জ্য রিসাইক্লিং না করে ফেলে দিলে দেহের অব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের সংস্পর্শে তৈরি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু। এমনকি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও নেই উপযুক্ত রিসাইক্লিং সিস্টেম।
উন্নত বিশ্বে এখন অ্যান্টিবায়োটিকের ষষ্ঠ প্রজন্ম চলছে। আমাদের দেশে পাওয়া যায় চতুর্থ প্রজন্ম পর্যন্ত। ষষ্ঠ প্রজন্মের ওষুধগুলো এতই দামি যে বাইরের দেশের অভিজাত শ্রেণী ও সামরিক বাহিনীর লোকজন ছাড়া অন্য কেউ এর নাগাল পান না। আমাদের দেশে এখন প্রথম দিককার অ্যান্টিবায়োটিকগুলো কাজও করে না। অন্যদিকে উন্নত অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর কাঁচামাল কিংবা সরাসরি আমদানিতেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। ডাক্তাররাও তাই অনেক সময় বাধ্য হয়ে অ্যান্টিবায়োটিকের ওভারডোজ ব্যবহারের পরামর্শ দেন। আর এর ফলেই দিনে দিনে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে বিভিন্ন জীবাণু।
যে হারে জীবাণুর মধ্যে বহু-অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জিত হচ্ছে, তাতে খুব শিগগিরই চলে আসতে পারে 'সুপার বাগ'। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে সাধারণ মানুষ, জীবজন্তু ও পরিবেশের জন্য ভাল অনুজীবগুলোর। নষ্ট হবে পরিবেশের ভারসাম্য। দামী ওষুধ কেনার সামর্থ্য যাদের নেই, তাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ। দেশজুড়ে মহামারি লেগে যাওয়াটাও বিচিত্র নয়।
বসে না থেকে এখন যত দ্রুত সম্ভব অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও জীবাণু ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রথমেই নজর দিতে হবে দেশের হাসপাতাল, মুরগীর খামার, গবাদিপশু, মৎস্য খামার ও ওষুধ শিল্পগুলোতে; অ্যান্টিবায়োটিক বর্জ্যের মূল উৎস এগুলোই। ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ছাড়া কোনো বর্জ্যই যাতে খোলা পরিবেশে না আসতে পারে সেদিকে রাখতে হবে কড়া নজর। স্বাস্থ্য ও প্রশাসনিক পর্যায়ে কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যত্রতত্র প্রেসক্রিপশন ছাড়া সাধারণ মানুষের হাতে যেন অ্যান্টিবায়েটিক না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। পয়ঃনিষ্কাশনের বর্জ্যও যাতে যথাযথ পরিশোধন প্রক্রিয়ায় পরিবেশে যায় তা মাথায় রাখতে হবে।
অনেক সময় বিদেশ থেকে নিম্নমানের ও সময়সীমা পার হওয়া অ্যান্টিবায়োটিক আমদানি করা হয়। আবার উন্নত দেশগুলো তাদের ওষুধ পরীক্ষামূলকভাবে অনেক সময় বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলোতে ছেড়ে দেয়। দেশের জনগণের স্বার্থে এসব প্রতিহত করতেই হবে। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, দেশে ব্যবহৃত কোন অ্যান্টিবায়েটিক ড্রাগ কী পরিমাণ ব্যবহৃত হচ্ছে, কোন ক্ষতিকর জীবাণু প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে, কোন অ্যান্টিবায়োটিক এখনো কার্যকর_দেশব্যাপী এসব নিয়ে বড় মাপের গবেষণার মাধ্যমে সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত হাতে রাখতে হবে। একই সঙ্গে ওই তথ্য ভাণ্ডার ডাক্তার ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারকারীদের জন্য ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করাও প্রয়োজন। প্রচলিত কোনো অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে গেলেই তা দ্রুত বাজার থেকে সরিয়ে নিতে হবে। অবশ্য একটি নির্দিষ্ট সময় বিরতি দিয়ে যেগুলো আবার ব্যবহার করা যাবে। অ্যান্টিবায়োটিকের পরিবর্তে প্রোবায়োটিক বা বন্ধু অনুজীবের ব্যবহার বাড়ানোটাও জরুরি। উপরোক্ত ব্যবস্থা অনুযায়ী দ্রুত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়নে একদিকে বাঁচবে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ। অন্যদিকে সাশ্রয় হবে মোটা অংকের বৈদেশিক মুদ্রা

একনজরে ড. মো. আনোয়ার হোসেন প্রফেসর ড. মো. আনোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন এবং অনুপ্রাণ বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি জাপানের মনোবুশো বৃত্তি নিয়ে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টঙ্েিকালজি বিষয়ে পিএইচডি ও জাপানের সান্তোরি বায়ো-অর্গানিক রিসার্চ ল্যাব এবং ইউনিভার্সিটি অব মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টিস্ট্রি অব নিউজার্সি ইউএস থেকে দুটি পোস্ট ডক্টরাল সম্পন্ন করেন। তিনি কোশি বিশ্ববিদ্যালয় জাপানের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তাঁর ৩৪টি গবেষণা প্রবন্ধ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে এবং বেশ কিছু প্রকাশের অপেক্ষায়। ২২টি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন তিনি।
ড. মো. আনোয়ার হোসেন একাধারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিল মেম্বার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মেম্বার, বিসিএসআইআর-এর বোর্ড মেম্বার, ন্যাশনাল টাস্কফোর্স অন ন্যাশনাল বায়োটেকনোলজি ফর বাংলাদেশের এঙ্পার্ট মেম্বার।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজিস্ট আয়োজিত ২২তম ও ২৫তম বাৎসরিক সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেছেন তিনি। তাঁর সভাপতিত্বেই বাংলাদেশ ও জাপানের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৫ম 'ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন মাইক্রোবায়োলজি, ফুড, হাইজিন অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট'।

Source: Dailykalerkantho

Saturday, December 11, 2010

ধানক্ষেতে হাঁস পালন

ধানক্ষেতে হাঁস পালন

দারিদ্র বিমোচনে ইরি ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে ধানক্ষেতে হাঁস পালনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। প্রযুক্তিটি সারাদেশে সমপ্রসারণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকাসহ কয়েকটি দেশে ধানক্ষেতে হাঁস পালন করা হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রযুক্তিটি পরিবেশসম্মত, কৃষকদের জন্য লাভজনক।

সুবিধা:ধান ক্ষেতে পোকা দমনের জন্য পরিবেশ দূষণকারী রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় না; হাঁস পোকা খেয়ে ধান ক্ষেত রক্ষা করে; একই জমি থেকে ধান, হাঁস ও ডিম পাওয়া যায়। কোনো কারণে ধান নষ্ট হলেও হাঁস থেকে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া যায়। ধানক্ষেতে হাঁস চড়ার সময় কচি আগাছা খায় এবং ঠোঁট ও পা দিয়ে বাকি আগাছা নষ্ট করে। ফলে আগাছা দমনের জন্য আলাদা শ্রমের প্রয়োজন হয় না। হাঁসের বিষ্ঠা জমিতে পড়ে জমি উর্বর হয়। এজন্য জমি আলাদাভাবে ইউরিয়া দিতে হয় না। হাঁস ঠোঁট ও পা দিয়ে মাটি নাড়াচাড়া করায় মাটিতে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের অনুপাত ঠিক থাকে এবং বিষাক্ত গ্যাস জমি থেকে দূর হয়। ধান গাছের শিকড়ের দৈর্ঘ্য ও সংখ্যা বেশি হয়। হাঁসকে আলাদাভাবে খাদ্য দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। কারণ ধানক্ষেতের কচি আগাছা ও পোকামাকড়, শামুক, ঝিনুক, ক্ষুদেপানা হাঁসের জন্য পুষ্ঠিকর খাবার।

পালন পদ্ধতি: সাধারণত রোপা আউশ, রোপা আমন ও বোরো ধান ক্ষতে হাঁস পালন করা যায়। প্রতিশতক জমিতে ২টি করে হিসেবে প্রতি বিঘায় (৩০ শতক) ৫০ থেকে ৬০টি এবং হেক্টরে ৩৫০ থেকে ৪০০টি হাঁস পালন করা যায়। ধান ক্ষেতে হাঁসের বাচ্চা ছাড়ার বয়স হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ দিন। বোরোতে ৩০ থেকে ৪০ দিন। ধানের স্বাভাবিক চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। তবে ধানক্ষেতে সব সময় ২ থেকে ৩ ইঞ্চি পানি রাখতে হবে। উপযোগী হাঁসের জাত হচ্ছে- খাঁকি ক্যাম্বেল, জিং ডিং, সাদা পিকিং ও শংকরজাত। ধানের চারা রোপণের ১০ দিন পর ২০ থেকে ৩০ দিন বয়সের হাঁসের বাচ্চা ধান ক্ষেতে ছাড়তে হবে। ধানক্ষেতে হাঁসের খাদ্য কমে গেলে বাড়িতে হাঁসকে খাওয়াতে হবে। ধানক্ষেতে হাঁস ছাড়ার আগে কিছুদিন বাড়ির আশেপাশে চড়িয়ে অভ্যাস করতে হবে। হঠাৎ করে ধান ক্ষেতে হাঁস ছাড়া যাবে না। অভ্যাস হলে এমনিতে ধান ক্ষেতে হাঁস যাবে। হাঁসের ঘর ক্ষেতের পাশে হলে ভাল হয়। ফুল আসা পর্যন্ত ধান ক্ষেতে হাঁস চড়ানো যাবে। এরপর ক্ষেতে হাঁস চড়ালে ধান খেয়ে ফেলবে। হাঁস ছাড়া থেকে ধানে ফুল আসা পর্যন্ত প্রায় চার মাস সময়ে হাঁস বিক্রির উপযোগী হবে। তবে বেশি উপকার পেতে হলে ধান ক্ষেতে ৫০ দিন হাঁস চড়াতে হবে। বাড়িতে পালন করা হাঁসগুলোকে প্রথমে প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে দু'ঘণ্টা করে চার ঘণ্টা ধান ক্ষেতে রাখতে হবে। পরে অভ্যাস হয়ে গেলে সারাদিন ধান ক্ষেতে হাঁস রাখা যাবে। হাওর এলাকার ধান ক্ষেতে হাঁস পালন করতে হলে ধান ক্ষেতের কাছে শুকনো স্থানে হাঁসের ঘর করতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন হাঁস কোনো প্রকার বন্যপ্রাণী দ্বারা আক্রান্ত না হয়।

ধান ক্ষেতে হাঁস পালন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে করা না গেলেও স্বল্প পরিসরে গ্রামীণ মানুষের কিছু পরিমাণে পুষ্টির চাহিদা ও দারিদ্রতা দূরীকরণে সহায়ক হতে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞরা বলেন, হাঁস, মুরগি থেকে বেশি পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে বলে বাণিজ্যিকভাবে পালন করা ব্যয়বহুল। কিন্তু প্রাকৃকিত খাদ্যের উৎস থাকলে তা সম্ভব। ধান ক্ষেতে হাঁস পালন বাণিজ্যিকভাবে সম্ভব না হলেও স্বল্প পরিসরে ৩০ থেকে ৪০টি হাঁস পালন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়।

আব্দুস সালাম সাগর, ছাত্র, বাকৃবি, ময়মনসিংহ

Friday, December 10, 2010

বিমানবন্দরে বিস্ফোরক শনাক্তকরণ যন্ত্র আবিষ্কার : যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী বিজ্ঞানীকে নিয়ে আলোড়ন

বিমানবন্দরে বিস্ফোরক শনাক্তকরণ যন্ত্র আবিষ্কার : যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী বিজ্ঞানীকে নিয়ে আলোড়ন

নিউজ ওয়ার্ল্ড, নিউইয়র্ক থেকে
এক বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর সাম্প্রতিক আবিষ্কার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে চলছে জল্পনাকল্পনা। তাকে নিয়েই ব্যস্ত বিভিন্ন মিডিয়া। এই সময়ের প্রত্যাশিত সর্বশেষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন তিনি। বিজ্ঞানীর নাম ড. আনিসুর রহমান। তিনি বর্তমানে পেনসিলভেনিয়ার হেরিসবার্গের বাসিন্দা। তার বাড়ি পাবনা জেলায়। বিশ্বের বিভিন্ন এয়ারপোর্টসহ নিরাপত্তা এলাকাগুলোতে যখন দেহতল্লাশি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক চলছে, তখন তিনি আবিষ্কার করেছেন একটি বিস্ময়কর প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের শরীরে বিস্ফোরক-জাতীয় কোনো উপাদান থাকলে সেটা এমনিতেই ধরা পড়ে যাবে। এজন্য বর্তমানের এক্সরে মেশিনের প্রয়োজন হবে না।
ড. আনিসুর রহমানের এ প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ এরই মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ আরও বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কিছু নমুনা দিয়েছে ড. আনিসের কাছে। তারা সেগুলো এখন বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। এনবিসি টেলিভিশন ড. আনিসের উদ্ভাবন নিয়ে এরই মধ্যে গুরুত্ব দিয়ে খবর প্রচার করেছে।
এ বিষয়ে ড. আনিসুর রহমান বলেন, বর্তমান সময়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে সারা বিশ্বে বিলিয়ন্স অব ডলার খরচ করা হচ্ছে। মেটালিক কোনো বিস্ফোরক হলে সেটা যে কোনো জায়গাতেই ধরা পড়ে। কিন্তু এখন বিভিন্ন কেমিক্যাল পাউডারসহ রাসায়নিক বিস্ফোরকের ব্যবহার প্রতিদিনই বাড়ছে। গত মাসে ডেল্টা এয়ার লাইন্সে নাইজেরিয়ান এক সন্ত্রাসীর আন্ডারওয়্যারে পাউডারজাতীয় বিস্ফোরক পাওয়া গেছে। অল্পের জন্য ভয়াবহ বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে যান শত শত যাত্রী। তারপর ইউরোপের বিভিন্ন এয়ারপোর্টে বিশেষ করে প্যাকেটের মধ্যে বিস্ফোরক পাউডার পাঠানোর সাম্প্রতিক ঘটনা সবাই জানেন। এই অবস্থায় কী করা যায়, তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণার পর আমরা একটি নতুন মেশিন আবিষ্কার করেছি। এই মেশিনে বিশেষ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের এই যন্ত্রের দাম হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ ডলার। ভবিষ্যতে হয়তো এর দাম আরও কমবে। এই মেশিন একটি টেবিলে বসানো সম্ভব। এর ফলে কেউ রসায়নিক বিস্ফোরক নিয়ে নিরাপত্তা এলাকায় প্রবেশ করতে পারবে না।
মেশিনটির নাম দেয়া হয়েছে স্পেকট্রোমিটার। এর আরও অনেক প্রয়োগ আছে। তিনি বলেন, বেশি বা খুবই অল্প বিস্ফোরক হলেও এর চোখ এড়ানো সম্ভব হবে না। এটা নিয়ে এখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
ড. আনিস বলেন, এরই মধ্যে সৌদি আরব, ভারতসহ যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছে এ প্রযুক্তি পাঠানো হয়েছে। এখন আরও বিভিন্ন দেশ এ নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে রাশিয়া, ইরানসহ যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু তালিকায় নয়, এমন কোনো দেশের কাছে এই প্রযুক্তি বিক্রি করা যাবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ড. আনিসুর রহমানের বাড়ি বাংলাদেশের পাবনায়। দেশে অবস্থানকালে তিনি ছিলেন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া ও ড. শমসের আলীর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে তিনি ছিলেন সায়েন্টিফিক অফিসার।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউসকনসিনে অবস্থিত মার্কেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভের পর পেনসিলভেনিয়ার এপ্লায়েড রিসার্চ ফটোনিক্স কোম্পানির সিইও হিসেবে যোগদান করেন তিনি।
Source: Daily Amardesh

Tuesday, December 7, 2010

ডায়বেটিক রোগীদের জন্য

ডায়বেটিক রোগীদের জন্য

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের বিজ্ঞানীদের সফল গবেষণালব্ধ হারবাল উদ্ভাবন এন্টি-ডায়াবেটিক টি 'ডায়াবিনো'। যা তৈরি হয়েছে জারুল গাছের পাতা থেকে। জারুল গাছের কচি পাতার নির্যাসে রয়েছে কোরোসলিক এসিড যা ডায়াবেটিক রোগে প্রাকৃতিক ইনসুলিন হিসেবে কাজ করে। সেই সাথে প্রচুর পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্ট, বিশেষ করে ভিটামিন-ই রয়েছে হার্ট, কিডনি, লিভার সুরক্ষা সহ সৌন্দর্য রক্ষায় বিশেষ কাজ করে। ডায়াবিনো চুমুকেই তিনটি সমাধান দেয় তাহলো- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে, বাড়তি মেদ কমায় ও তারুণ্য দীর্ঘায়িত করে। আমেরিকা, জাপান, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ায় এই গবেষণা একইভাবে প্রমাণিত। প্রাকৃতিক ইনসুলিন সমৃদ্ধ 'ডায়াবিনো' ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন নির্ভরতা কমায় বিস্ময়করভাবে। ফেম ফার্মাসিউটিক্যালস 'ডায়াবিনো' স্যাচেটস আকারে বাজারজাত করছে। সম্পূর্ণ হারবাল উপাদানে প্রস্তুত তাই সবার জন্য নিরাপদ ও কার্যকর। কেনার জন্য অথবা পরিবেশক হতে যোগাযোগ করা যাবে এই নম্বরগুলোতে: সাইন্সল্যাব শো-রুম, ঢাকা। ডাঃ প্রিন্স ঃ ০১৭১২২৬৬০৯০। ঢাকা হেড অফিস: ৮৮-০২-৮৮১৭৯৫০

বগুড়ার কৃষি যন্ত্রাংশ শিল্পে সম্ভাবনা বিপুল

বগুড়ার কৃষি যন্ত্রাংশ শিল্পে সম্ভাবনা বিপুল
প্রয়োজন সরকারের সুদৃষ্টি


০০ মুন্না রায়হান, বগুড়া থেকে

প্রয়োজনীয় পুঁজি, নির্দিষ্ট প্রসেসিং জোন, দক্ষ শ্রমিক, বিদু্যৎ ও গ্যাসের অভাবে বগুড়ায় যথাযথভাবে বিকশিত হচ্ছে না বিপুল সম্ভাবনাময় কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরী শিল্প। অথচ এখানে তৈরী কৃষি যন্ত্রাংশ দেশের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ পূরণ করছে। শুধু তাই নয় বৈধ ও অবৈধভাবে প্রচুর কৃষি যন্ত্রাংশ ভারত ও নেপালসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে রয়েছে প্রায় ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান।

উদ্যোক্তারা বলেছেন, এই শিল্পের বিকাশের জন্য প্রয়োজন সরকারের সুদৃষ্টি। বেশী কিছু নয়, স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ, নির্দিষ্ট একটি প্রসেসিং জোন ও চাহিদা মতো গ্যাসের ব্যবস্থা করলে রীতিমতো বিপস্নব ঘটবে এই শিল্পে। কারণ এখানে তৈরী এসব যন্ত্রপাতির মান চীন ও জাপানের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। উদ্যোক্তারা আরো জানান, এ শিল্পকে আন্তর্জাতিক পযর্ায়ে নিয়ে যেতে হলে পাম্প টেস্টিং সেন্টার, হিট ট্রিটমেন্ট পস্নান্ট, মডেল ওয়ার্কশপ নির্মাণ করতে হবে।

বগুড়ার বিসিক, গোহাইল রোড, স্টেশন রোড, রেলওয়ে মার্কেট, সান্তাহারসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরীর বিভিন্ন কারখানায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে এসব কারখানা ও ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এসব কারখানায় শ্রমিকরা কয়েক শিফ্টে কাজ করে। প্রতি বছর এই শিল্পে বার্ষিক টার্নওভার এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা বলে ব্যবসায়ীরা জানান।

নিলু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী নূরুল ইসলাম বলেন, এই শিল্পে প্রধান সমস্যা পুঁজি। ব্যাংক থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে পোষায় না। এরপর রয়েছে দক্ষ শ্রমিকের প্রচণ্ড অভাব। কাজ শিখলেই শ্রমিকরা অন্যত্র চলে যায়। তিনি আরো বলেন, আগে শুধু কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরী হতো। কিন্তু এখন অন্যান্য যন্ত্রপাতিও তৈরী করা হচ্ছে। তাই সারা বছরই কাজ লেগেই থাকে। একতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শামীম বলেন, চাহিদা মতো বিদু্যৎ না পাওয়ায় খুব ভোগান্তি হয়। ঠিক সময় মাল ডেলিভারি দেয়া যায় না।

ভাই ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপের মন্টু মিয়া বলেন, ১৫/১৬ বছর আগে ১ লাখ টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম। কিন্তু প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে খুব বেশী অগ্রসর হতে পারিনি।

সংশিস্নষ্টরা জানিয়েছেন, ষাটের দশকে তৎকালীন সরকার কৃষকদের মাঝে বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রাংশ সরবরাহ শুরু করে। এসব যন্ত্রাপতি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হত। ফলে খরচ পড়ত অনেক বেশী। সে কারণে স্থানীয় কারিগররাই প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরী শুরু করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর উদ্যোগটি আ্েরা জোরালো হয়। একইসাথে বগুড়ার পাশর্্ববর্তী জেলাগুলোতেও এখানকার তৈরী কৃষি যন্ত্রাংশের চাহিদা বাড়তে থাকে। এক পযর্ায়ে সারাদেশে বগুড়ার তৈরী কৃষি যন্ত্রাংশ কৃষকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ চীন ও জাপান থেকে যেসব কৃষি যন্ত্রাংশ আমদানি করা হয় সেগুলোর দাম অনেক বেশী পড়ে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে তৈরী কৃষি যন্ত্রাংশের মান তাদের চেয়ে যেমন কোন অংশেই কম নয় তেমনি দামেও অনেক কম।

ভাঙ্গা জাহাজের লোহাসহ পরিত্যক্ত লোহা গলিয়ে এসব যন্ত্রাংশ তৈরী হয়। বগুড়ায় এ ধরনের ফাউন্ড্রি শিল্প রয়েছে প্রায় ৪৫টি। এছাড়া বিভিন্ন ছোট, বড় ও মাঝারি মানের কৃষি ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ও ওয়ার্কসপ রয়েছে ৫০০ থেকে ৬০০টি। এসব কারখানায় তৈরী যন্ত্রাংশের মধ্যে রয়েছে পানির পাম্প, টিউবওয়েল, শ্যালো ইঞ্জিনের লায়নার, পিস্টন , পাওয়ার টিলার, ধান ও ভুট্টা মাড়াই মেশিনসহ সকল কৃষি উপকরণাদি। এছাড়াও পস্নানার, ক্রাংকশ্যাফট্ গ্রান্ডিং, মিলিং, সেপার, বোরিং মেশিন, লেদ মেশিন, ছ' মেশিন ইত্যাদি তৈরী হয়। এসব কারখানা দেখতে মাঝে মাঝে বিদেশীরা আসেন। তারা এসব উন্নতমানের যন্ত্রাংশ দেখে মুগ্ধ হন।

বগুড়ায় এ শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিরাট মার্কেট। শুধু কৃষি যন্ত্রংশ বিক্রির দোকানই রয়েছে এক থেকে দেড় হাজার। দেশের প্রত্যন্ত এলাকার ক্রেতারা এখান থেকে কৃষি যন্ত্রাংশ কিনে নিয়ে যায়। কৃষি ভিত্তিক শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও নানান সমস্যার কারণে তা দ্রুত অগ্রসর হতে পারছে না। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে এখানে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ কৃষি যন্ত্রপাতি বিদেশে রফতানি করে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে ফোরাম অফ এগ্রো মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারিং এন্ড প্রসেসিং জোন, বগুড়ার সভাপতি গোলাম আজম টিকুল ইত্তেফাককে বলেন, বিরাট সম্ভাবনাময় হলেও এই শিল্প অবহেলিত। সারা বগুড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই শিল্প। কিন্তু নির্দিষ্ট একটি জোন না থাকলে কখনোই এই শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। এছাড়া রয়েছে গ্যাসের সমস্যা। শিল্পে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। ফার্নেস অয়েল দিয়ে কারখানা চালালে উৎপাদন খরচ বেশী পড়ে। তিনি আরো বলেন, সরকারতো কৃষিখাতে ভর্তুকি দিচ্ছে। যদি এই শিল্পে এরকম কোন সুবিধা দেয় তাহলে উৎপাদন খরচ কম হবে।

এ প্রসঙ্গে বিসিকের ডিজিএম আলতাফ হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরী শিল্পের বিকাশে আমরা বিভিন্ন কর্মসূচীর আওতায় ঋণ ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তবে এই শিল্পের বিকাশে বড় সমস্যা অবকাঠামো ও জায়গার অভাব। কেননা শিল্প নগরীতে আর কোন পস্নট নেই উদ্যোক্তাদের বরাদ্দ দেয়ার জন্য। তবে বগুড়ার শান্তাহারে সরকারের সাড়ে ১৫ একর খালি জায়গা আছে। সরকারের কাছে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি বিসিককে এই জায়গা বরাদ্দ দিতে।
Source: Daily Ittefaq

Sunday, December 5, 2010

হাওরের বাস্তবতা ও বৃক্ষরোপণ

হাওরের বাস্তবতা ও বৃক্ষরোপণ

ড. নিয়াজ পাশা

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বি.এ.আর.সি.) আয়োজিত বনজ, কাঠ ও ফল গাছ বিষয়ক নীতিনিধর্ারণী এক কর্মশালায় দেশে বন সম্পদ বৃদ্ধি নিয়ে বিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের প্রবন্ধ, নিবন্ধ উপস্থাপন, মতামত ও আলোচনা হচ্ছিল। সবাই উপকূল, লোনা পানি, সুন্দরবন, সমতল আর পাহাড়ি এলাকায় বন বৃদ্ধি নিয়ে অভিজ্ঞতালব্ধ পরামর্শ বর্ণনা করছিলেন। আচমকা আমার প্রশ্নে মাননীয় সভাপতির ঝটপট উত্তর, হাওর ! তো- পানি, কিভাবে বনায়ন সম্ভব ? আমি অতি বিনয়ের সাথে বললাম, স্যার ! সমুদ্রের কড়া পানিতে যদি গাছ জন্মায়, তবে হাওরের মিঠা পানিতে গাছ হবে না কেন ?

হাওরের মিঠা পানিতে গাছ হবে এবং ছিলও প্রচুর। কিন্তু অযাচিতভাবে এ সব গাছ কেটে সাবাড় করা হয়েছে। সারা দেশের বন ধ্বংস উৎসব হতে হাওর কোনভাবেই পিছিয়ে নেই বরং একধাপ এগিয়ে আছে। হাওরে বলতে গেলে কোন গাছই নেই। দিগন্ত বিস্তৃত ফাকা ধু ধু মাঠ খাঁ খাঁ করছে। অথচ একদা এখানে ছিল- আকণ্ঠ নিমগ্ন হিজল, তমাল, ইকরা, নল খাগড়ার বন। হাওরের দ্বীপসম গ্রামগুলোতে বলতে গেলে বৃক্ষ শূন্য, ঘন বসতির ন্যাংটা, শুধু বাড়িঘর, জনারণ্যে নেই কোন বৃক্ষরাজি। হাওর দেশের একটা বিশেষায়িত অনুন্নত, অবহেলিত ও উন্নয়ন কর্মকান্ড হতে বঞ্চিত অঞ্চল। দেশে এখন বৃক্ষরোপণ অভিজান চলছে। গাছ লাগানো হচ্ছে সড়ক-মহাসড়ক, সংযোগ সড়ক ও সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, হাওরে নেই তার কোন ছিটে ফোটা প্রভাব, সারা শব্দ ও উদ্যোগ। হাওরে বৃক্ষ রোপণের জন্য কোন আর্থিক বরাদ্দ আছে কিনা জানা নাই ? কিন্তু এ জানি যে, বৃক্ষ রোপণের কোন তৎপরতা হাওরে নেই। দেশের ছয় ভাগের এক অংশকে এবং প্রায় দুই কোটি লোককে বনায়নের বাহিরে রেখে আর যাই হউক, সুষম উন্নয়ন ও পরিবেশ রক্ষা সম্ভব নয়। দেশের উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনার মূল স্রোত হতে সব সময় বাহিরে রাখা হয় হাওরকে। বিষয়টা পরিকল্পনাবিদ, নীতি নির্ধারক ও উন্নয়ন সহায়ক সংগঠকের দৃষ্টি সীমার বাহিরে অথবা প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাব রয়েছে। বর্ষায় হাওরে দিগন্ত বেষ্টিত পানি আর পানি। এর মধ্যে বনায়ন বা বৃক্ষরোপণ করা সম্ভব? একথা দুই দশক আগে (১৯৮৮) কৃষিবিদ রফিকুল ইসলাম চৌধুরৗ এবং এই লেখক প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে হাওরে পানির মধ্যে বনায়নের দাবী, গুরুত্ব ও প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। তখন এই প্রস্তাবনা ব্যাপক সাড়া জাগিয়ে ছিল। সমুদ্রের কড়া পানির লুনা মাটিতে বৃক্ষ রোপণের যে তোরজোড় আমরা লক্ষ্য করি, তার কিয়দাংশ ব্যবহার করেই এর চেয়ে বেশী পরিমাণ সুফল আমরা পেতে পারি হাওরে। সমুদ্রের পানিতে ভেসে গাছের বীজ অন্যত্র ছড়িয়ে পরে। হাওরেও অনেক গাছের বীজ এভাবে বংশ বিস্তার করে। হাওরের গ্রাম, রাস্তা কাম বাঁধে, কান্দায়, উচুঁ ভূমিতে, সড়কে, শিক্ষাঙ্গণে, অফিস প্রাঙ্গনে, বিলের পাড়ে, নদীর ধারে, গরুর মাঠে-হাটে, ধানের জমির আইলে, মসজিদ মন্দিরে পানি সহিঞ্চু গাছ লাগানো যেতে পারে। বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট নিচু জলমগ্ন ভূমিতে রোপণ উপযোগি ৭৭ প্রকারের গাছ চিহি্নত করেছে যা, অত্যন্ত আশা-ব্যঞ্জক সু-সংবাদ। এর মধ্যে ফলজ গাছও রয়েছে। এ থেকেই হাওরে বনায়নের গুরুত্ব ও উপযোগিতা প্রমাণ হয়।

এন.জি.ও. বিক্ষিপ্তভাবে হাওরে গাছ লাগাচ্ছে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে, পূর্ব অভিজ্ঞতা ও গবেষণা ছাড়াই গাছ লাগালে যা হয়, সে ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। টাকার নয় ছয় হয় বটে কিন্তু সফলতার জন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা, সঠিক গাছ নির্বাচন, সঠিক স্থান, গাছের বয়স ও রোপণের সময় নির্ধারণ। সর্বাগ্রে প্রয়োজন হাওরে রোপণ যোগ্য গাছের জীবনবৃত্তান্ত, বংশ বিস্তারের পদ্ধতি, বীজ/চারা উৎপাদন কৌশল ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণালব্ধ তথ্য । পানির মধ্যে গাছ লাগানোর টনিক উদ্ভাবন করতে হবে।

তাছাড়া কেবল পানি সহিষ্ণু গাছ রোপণই নয়, প্রবল ঢেউয়ের আঘাত সহনীয় গাছের অনুসন্ধান করাও প্রয়োজন। 'ইন্টার ক্রপস'-এর কৃষিবিদ হামিদ ভাই তাঁর প্রতিষ্ঠান কতর্ৃক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত 'জার্ম পস্নাজম' সহ হাজার হাজার নাসর্ারি, মাতৃ গাছ সৃষ্টির সুসংবাদ জানান কিন্তু হাওরের জন্য একটা নার্সারির অস্থিত্বও খুঁেজ পায় না। অথবা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বিজ্ঞানী ড. সালেহ ভাই যখন 'ওয়েট ল্যান্ড মেনেজম্যান্ড (ডবঃ খধহফ গধহধমবসবহঃ)' বিষয়ে শুধু উপকূলীয় জলাভূমি নিয়ে কথা বলেন, সেখানেও হাওর উহ্য থাকে, বাদ পরে যায়। আসলে হাওরের অবস্থা, বাস্তবতা, সমস্যা ও সম্ভাবনা লোক চক্ষুর আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। আমরা নীতি নির্ধারক ও পরিকল্পনাবিদদের কাছে হাওরকে তুলে ধরতে পারি নাই। হাওরের মিঠা জল, জলাশয়, জনগণ এবং এর বৃক্ষ সম্পদকে কেন্দ করে পর্যটন, বিনোদন, মৎস্য এর উৎসে, সম্পদে পরিণত হতে পারে। মিডিয়া শুধু হাতের কাছের সংবাদ বেশী প্রচার করে, দুর্গম হাওরের সংবাদ তাঁরা পায় না, তাই প্রচারও হয় কম। একে উন্মোচন করতে হবে। জানাতে হবে এর সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা। প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে হাওরবাসি উন্নয়ন পরিকল্পনা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। আশার কথা, বি.এ.আর.সি.'র বন বিজ্ঞানী ড. শাহজাহান উক্ত কর্মশালায় হাওরে বনায়নের বিষয়টি সুপারিশমালায় সংযোজনে একমত হয়েছেন।

বিলিয়ন ডলার পাদুকা রপ্তানী শিল্প খুব দূরে নয়

বিলিয়ন ডলার পাদুকা রপ্তানী শিল্প খুব দূরে নয়

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ : বিশেস্নষক

চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর এই পাঁচ মাসে ১১ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের পাদুকা রপ্তানী হয়েছে বাংলাদেশ থেকে সারা দুনিয়ায়। আগের অর্থবছরের এই সময়ের তুলনায় শতকার ৪৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে পাুদকা রপ্তানী আয়ে। এ ধারা চলতে থাকলে অর্থবছর শেষে আয় দাড়াবে প্রায় ৩০ কোটি মার্কিন ডলার যা টাকার অংকে ২১শ কোটি।

এটি কিন্তু স্বপ্ন নয় বরং ঘটতে যাচ্ছে এমন এক সমূহ সম্ভাবনা। ঘটতে পারে বা ঘটতে যাচ্ছে এমন আরো একটি বিশাল সম্ভাবনা বাস-াবায়ন পর্বও শুরু হয়েছে এরমধ্যেই। সেটি হলো শত কোটি ডলার পাদুকা রপ্তানীকারক দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের নাম। এটিও ঘটবে আগামী তিন বছরের মধ্যেই। এটি কোন স্বপ্নচারী বিবৃতি নয় বরং আগাম হিসেব করলে মিলে যায় এমন ব্যাপারই।

২০১৩ সাল নাগাদ শতকোটি বা বিলিয়ন ডলার ফুটওয়্যার রপ্তানী শিল্প হবে বাংলাদেশে এটি হলফ করেই বলা যায় যদি না দেশে এমন কোন রাজনৈত্যিক বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে যাতে দেশি বিদেশি উদ্যোক্তাদের গুটাতে হয় উৎপাদনরত ও নির্মিয়মান কারখানাগুলো ।

চলতি অর্থবছর শেষে না হয় ত্রিশ কোটি ডলার হলোই পাদুকা রপ্তানী- কিন্তু এর পরের আড়াই তিন বছরের বাকি সত্তর কোটি ডলার কোথা থেকে আসবে?

হিসেবটা এখান্ইে।

বর্তমানে একটিমাত্র বৃহৎ রপ্তানীকারক এপেক্স-আডেলকি ফুটওয়্যার ছাড়া বাকি গোটা চলি্লশেক ছোট মাঝারী সু ইন্ড্রাস্টি রপ্তানী বাজারের জন্য পাদ-কা উৎপাদন করছে তাদের অনেকেরই কমবেশি সমপ্রসারন হবে, প্রবৃদ্ধি হবে। কারন বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী পাদুকার ব্যপক চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। আগামী তিন বছরে পাদুকা রপ্তানীতে মূল প্রবৃদ্ধি আসবে নির্মিয়মান কারখানাগুলো থেকেই।

ছ'মাস আগে চট্রগ্রামে নির্মান শুরু হয়েছে ইয়াংওয়ান ফুটওয়্যার কমপ্লেক্স। কোরিয়ান ইয়াংওয়ান কর্পোরেশন বাংলাদেশ এর একক বৃহত্তম রপ্তানীকারক তৈরী পোষাক খাতে। তারা স্পোর্টসওয়্যার ও আউটারওয়্যার উৎপাদন করে। ইয়াংওয়ান এবার বাংলাদেশে নির্মান করছে এশিয়ার বৃহত্তম জুতার কারখানা যেখানে প্রায় ৩০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। কারখানার প্রথম ধাপ আগামী অর্থবছরের শুরতে উৎপাদনে যাবে। জানা গেছে, ২০১৩ সালের মধ্যে তাদের পরিকল্পনামত পুরো উৎপাদন ক্ষমতা কাজ শুরু করবে তাতে তারা ২৫ কোটি ডলার রপ্তানী করবে বাৎসরিক। ইয়াংওয়ান এখন মাঝারী আকারের কারখানায় নাইকি সহ কিছু দামী বান্ড্রের জন্য স্পোর্টস ফুটওয়ার উৎপাদন করে যা থেকে ২০১০ সালে রপ্তানী আয় ৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

তাদের প্রতিষ্টান এর এক-তুতীয়াংশ না করলেও ইয়াংওয়ান মনে করে ২০১৩ সালের মধ্যেই বাংলাদেশে বিলিয়ন ডলার পাদুকা রপ্তানী শিল্প হবে।

ইয়াংওয়ান ছাড়াও বিশ্বের বড়ো মাপের জুতা উৎপাদকেরা এখানে কারখানা গড়তে শুরু করেছেন। চ্রটগ্রামে একটি মাঝারী মাপের কারখানা করছে তাইওয়ানের পাও চেন যারা বিশ্বে এক নম্বর। চিনে পাও চেন এর কারখানাগুলো পাঁচ লাখ শ্রমিক কাজ করে। পর্যাপ্ত জায়গা পেলে পাও চেন আরো বড়ো কারখানা করতো বাংলাদেশেও। তাইওয়ান থেকে জেন-চেন জেন-ফোর্ডসহ আরো কিছু জুতা প্রস-ুতকারক এসেছে বাংলাদেশে, কারখানা বানাচ্ছে তারা। বনবন সু এসছে যারা বানায় হিউগো বস ব্রান্ডের জুতা।

স্থানীয়রাও বসে নেই। ইপিজেড এর বাইরে গোটা দশেক কারখানা নির্মর্িয়মান। এমনই একজন উদ্যোক্তা বাংলাদেশ ফিনিসড লেদার এক্সপোর্টাস এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি টিপু সুলতান। ভদ্রলোক ফেনিতে গড়ে তুলছেন একটি কারখনা। ছমাস পর প্রতিদিন দুহাজার পিস জুতা উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে প্রথম ধাপ চালু করবেন তিনি এরপর আগামী বছর তিনেকে সমপ্রসারন হবে দশ হাজার পিসে।

টিপু বলেন, চিনের শ্রমিক সংকট ও পশ্চিমা আমদানীকারকদের নতুন আমদানীসুত্র খোঁজার কারনে বাংলাদেশের পাদুকা শিল্পের বিশাল সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। তাই অনেকেই সাহস করছেন কারখানা করতে।

নিকট ভবিষ্যতেই বিলিয়ন ডলার পাদুকা রপ্তানী শিল্পটি দেখতে পাচ্ছেন, শীর্ষ ও অভিজ্ঞ রপ্তানীকারক, এপেক্স-আডেলকি এর ব্যাবস্থাপনা পরিচালক, সৈয়দ নাছিম মঞ্জুরও।

প্রতিদিন প্রায় ১৮ হাজার জোড়া পাদুকা তৈরী করে এপেক্স-আডেলকির বাৎসরিক টার্নওভার প্রায় ১০ কোটি ডলার। ফেব্রুয়ারীতে তাদের অংশিদারিত্বে ব্লু ওশান নামে আরেকটি কারখানা চালু হবে।

বর্তমান প্রবৃদ্ধি ও সমপ্রসারিত উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে ২০১৩ সাল নাগাদ নাছিম মঞ্জুরদের প্রতিষ্ঠান ২০ কোটি ডলার সু এক্সপোর্ট টার্নওভারের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকবে এটি হিসব কষলেই মিলে যায়।

নাছিম বললেন, প্রচলিত বাজার জাপান ও জার্মানী ছাড়াও আমেরিকার ক্রেতারা আজকাল বেশ আসছেন বাংলাদেশে।

তবে ইউনির্ভাসিটি অফ পেনসিলভেনিয়ার বিখ্যাত ওয়ারটন বিজনেস স্কুলে পড়ে আসা এই মেধাবী উদ্যোক্তা বলেন, সব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারকে বিদু্যৎ সহায়তা দিতে হবে, অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে দ্রুত। শিল্পের গুড ইমেজ উন্নয়নে হাজারীবাগের ট্যানারী দূষনও বন্ধ করতে হবে দ্রত, বলেন টিপু সলতান ও নাছিম মঞ্জুর দুজনেই।
Source: Daily Ittefaq

Saturday, December 4, 2010

রাঙ্গামাটিতে মাশরুম দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখছে

রাঙ্গামাটিতে মাশরুম দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখছে

মাশরুম পুষ্টি ও ঔষধিগুণে ভরা একটি সবজি। মাশরুম উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোষ্ঠকাঠিন্য ও জণ্ডিসসহ বিভিন্ন রোগের মহৌষধ হিসেবে কাজ করে। মাশরুমকে আগে অনেকে 'ব্যাঙের ছাতা' বলে জানতো। কিন্ত ব্যাঙের ছাতা আর মাশরুম এক জিনিস নয়। মাশরুম তৈরি হয় আধুনিক টিসু্যকালচার পদ্ধতিতে। স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ল্যাবরেটরিতে যে কোনো মাশরুমের একটি থেকে এক টুকরো মাশরুম সংগ্রহ করে, টেস্টটিউবে ভরে টিসু্যকালচারের মাধ্যমে মাশরুমের বীজ উৎপন্ন করা হয়। কাঠের গুঁড়ো, আখের ছোবা, খড় কিংবা ফেলনা কৃষি বর্জ্য দিয়ে মিকচার মেশিনে এর সঙ্গে চুন ও গমের ভুসি মিশিয়ে তৈরি করা হয় বীজ বা স্পন প্যাকেট। এরপর বীজ প্যাকেটগুলোকে জীবাণুমুক্ত করতে অটোক্লেভ মেশিনে ১২০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় প্রায় একঘণ্টা রাখা হয়। ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত বীজ ক্লিনবেঞ্চের মাধ্যমে এই স্পন প্যাকেটে দেয়া হয়।

রাঙ্গামাটিতে বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম চাষ শুরু হয়েছে। মাশরুম চাষ করে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় অনেক উপজাতীয় নারী-পুরুষ স্বাবলম্বী হয়েছে। স্বল্প খরচে মাশরুম চাষ ব্যাপক লাভজনক হওয়ায় মাশরুম চাষ রাঙ্গামাটিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। খাদ্য হিসেবে মাশরুমের উপকারিতা সম্পর্কে সাধারণ লোকজনের মাঝে ধারণা হওয়ায় দিন দিন এর চাহিদাও বাড়ছে। পাহাড়ে বসবাসরত উপজাতি জনগোষ্ঠীদের আগে থেকেই মাশরুম একটি জনপ্রিয় খাদ্য। এ কারণে উপজাতিরা মাশরুম চাষে অধিক আগ্রহী। রাঙ্গামাটি জেলার আসাম বস্তি এলাকা, মনোঘর এলাকা, তবলছড়িসহ অসংখ্য এলাকায় উপজাতি বাঙালিরা বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম চাষ শুরু করেছেন। তবে মাশরুম চাষে উপজাতিরা বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। আগের পাহাড়িরা সবজি হিসেবে পরিবারের জন্য চাষ করলেও স্বল্প খরচে অধিক লাভ হওয়ায় বর্তমানে মাশরুম বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু করেছে। পাহাড়ি অনেক পরিবার জুম চাষের পরিবর্তে ঘরের মধ্যেই মাশরুম চাষ শুরু করেছে। মাশরুম দিয়ে নানা ধরনের নাশতা তৈরি, তরকারি হিসেবে ও বিভিন্নভাবে এটি খাওয়া যায়।

মাশরুম চাষে বেশি পরিশ্রম করা লাগে না। মাশরুম চাষ স্বল্প খরচে অতি দ্রুত অধিক লাভবান হওয়া যায়। একটি স্পন (বীজ) থেকে ২৫০-৩০০ গ্রাম পর্যন্ত মাশরুম উৎপাদন করা সম্ভব। প্রতি কেজি মাশরুম বিক্রি হয় ১২০-১৪০ টাকায়। তাই বাজারে এর চাহিদাও বেশি। দারিদ্র্য বিমোচনে মাশরুম রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে চলছে। মাশরুম বিক্রি করে মাসে তিন থেকে বারো হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। সঁ্যাতসেঁতে পরিবেশে ঘরের বাড়তি স্থানে ওয়েস্টার মাশরুম চাষ করা কঠিন কিছু নয়। স্পন বা বীজ কিনে প্যাকেটের গায়ে ধারালো বেস্নড বা চাকু দিয়ে 'ডি' আকৃতিতে কেটে আদর্্রতা ভেদে ৩-৪ বার পানি দিয়ে পরিচর্যা করলেই মাশরুম পাওয়া সম্ভব। মাশরুম চাষে বড় জায়গার প্রয়োজন হয় না। মাশরুম চাষকে আরো সমপ্রসারণ করে মানুষের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দেয়া গেলে দারিদ্র্য বিমোচনের একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।
মো. শফিকুর রহমান, বনরূপা, রাঙ্গামাটি সদর, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।

Friday, December 3, 2010

মাটির স্পর্শ ছাড়াই পানিতে চাষাবাদের পদ্ধতি উদ্ভাবন

মাটির স্পর্শ ছাড়াই পানিতে চাষাবাদের পদ্ধতি উদ্ভাবন

বশিরম্নল ইসলাম মাটির স্পর্শ ছাড়াই পানির ওপর ফসল উৎপাদনের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। পদ্ধতির নাম হাইড্রোফনিক বা পানিতে চাষাবাদ। এ পদ্ধতিতে সারা বছরই সবজি ও ফল উৎপাদন করা সম্ভব। আমাদের দেশে এ পদ্ধতি নতুন হলেও উন্নত বিশ্বে বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। জনবহুল দেশে যেখানে স্বাভাবিক চাষের জমি কম সেখানে ঘরের ছাদ, পলি টানের, নেট হাউসে হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। জনবহুল দেশে যেখানে স্বাভাবিক চাষের জমি কম সেখানে ঘরের ছাদ, পলি টানেল, নেট হাউসে হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন লাভজনক। অতি লাভজনক ফসলের ৰেত্রে বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদনই শ্রেয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিউিটের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রে হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে সাফল্যজনকভাবে মরিচ, লেটুস পাতা, টমেটো, শসা, ৰীরা এবং স্ট্রবেরি চাষাবাদ হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে প্রাথমিক গবেষণার সাফল্যের পরে এ পদ্ধতি মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া যাবে।
হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে মাটিবিহীন বড় স্টীলের বা পস্নাস্টিকের ট্রেতে পানির মধ্যে গাছের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদানসমূহ পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল উৎপাদন করা হয়।
দুই উপায়ে হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয়। প্রথমটি সঞ্চালন পদ্ধতি, অপরটি সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি।
সঞ্চালন পদ্ধতিতে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদানসমূহ পরিমিত মাত্রায় একটি ট্যাঙ্কে নেয়া হয় এবং সেখান থেকে একটি পাম্পের সাহায্যে পাইপের মাধ্যমে ট্রেতে পুষ্টি দ্রবণ সঞ্চালন করে ফসল উৎপাদন করে ফসল উৎপাদন করা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রথম বছর খরচ একটু বেশি হলেও পরের বছর খরচ একটু কম পড়ে।
সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে সরাসরি ট্রেতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদানসমূহ পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল উৎপাদন করা হয়। এতে পাম্প বা পানি সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সহজেই এ পদ্ধতি অনুসরণ করে পস্নাস্টিকের বালতি, পানির বোতল, মাটির পাতিল ইত্যাদি ব্যবহার করেও বাড়ির ছাদ, বারান্দা এবং খোলা জায়গায় অনেক কম খরচে ফসল উৎপাদন করা যায়।
হাইড্রোফনিক পদ্ধতিতে মাটির স্পর্শ ছাড়াই চারা উৎপাদনের জন্য স্পঞ্জকে নির্ধারিত বর্গাকারে ডটডট করে কেটে খাদ্যোপাদান সংবরিত দ্রবণ ভর্তি ট্রেতে ৫ থেকে ৮ সেন্টিমিটার পানি রেখে প্রতিটি স্পঞ্জের মধ্যে ১টি করে বীজ বপন করতে হয়। চারা গজানোর ১০ থেকে ১২ দিন পর তা স্টীলের ট্রে বা পস্নাস্টিকের বালতিতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদানসমূহ পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে কর্কশীটের ওপর গর্তের মধ্যে স্থানানত্মরিত করতে হয়।
এ পদ্ধতিতে চারা রোপণের পর দ্রবণের পিএইচ (অমস্ন) মাত্রা ৫.৮ থেকে ৬.৫-এর মধ্যে এবং ইসি (ৰার) মাত্রা ১.৫ থেকে ১.৯-এর মধ্যে রাখা দরকার। গাছের বৃদ্ধির পর্যায়ে ওপর থেকে সুতা বা শক্ত রশি ঝুলিয়ে গাছকে সোজা ও খাড়া রাখতে হয় এবং পরিচর্যা সাধারণ গাছের মতোই করতে হবে।
আমাদের দেশের সাধারণ কৃষকরা যেভাবে ফসল চাষ করছে, এখানে শুধু পদ্ধতিগত কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। তবে উৎপাদন এবং গুণগত মানের দিকে অনেক বেশি সফল এ হাইড্রোফনিক পদ্ধতি।
প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিবিধ কারণে ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ। অল্প জায়গায় বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে হাইড্রোফনিক চাষ পদ্ধতি একটি উৎকৃষ্ট কৌশল।
Source: Daily janakantha

কোথায় কী : মার্চেন্ডাইজিংয়ে ভর্তি

কোথায় কী : মার্চেন্ডাইজিংয়ে ভর্তি

অ্যাপারেলস মার্চেন্ডাইজিংয়ে অনার্স, এমবিএ তিন ও ছয় মাসমেয়াদি সার্টিফিকেট এবং এক বছরমেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্সে শেখানো হবে ইন্ট্রোডাকশন টু মার্চেন্ডাইজিং, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, টেক্সটাইল ফাইবার অ্যান্ড ইয়ানং, ওভেন, ফেব্রিক্স, নিটওয়্যার ফেব্রিক্স সোয়েটার ডিজাইন, টেক্সটাইল, ফিনিশিং, প্রিন্টিং অ্যান্ড টেস্টিং, প্যাটার্ন মেকিং, কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট, প্রোডাকশন প্লানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, কমার্শিয়াল প্রসিডিউর, কনজাম্পশন অ্যান্ড গার্মেন্ট কাস্টিং প্রভৃতি। যোগাযোগ : ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজি শ/৩৬ সি, গুলশান লিংক রোড, মধ্যবাড্ডা, ঢাকা। ফোন : ০১৭১৩-১১৬৩১৩, ৮৮৩১৩০৫,

মসলিনের ইতিকথা

মসলিনের ইতিকথা

সৈ য় দ লু ত্ ফু ল হ ক
খ্রিস্টপূর্ব ২০০ বছর আগে গ্রিকরা ভারতীয় কার্পাসের কথা বলেছে। স্ট্যাটিটিয়াস (Statitius) কার্পাস তুলাকে ‘কবোসম’ বলেছেন। জে ফর্বেস রয়েল (J Forbes Rayle, M.D, F.R.S) তাঁর গ্রন্থ 'The Early History of Cotton' গ্রন্থে লিখেছেন। গ্রিকরা ঢাকার মসলিনকে ‘গ্যাঞ্জোটিকা’ নামে উল্লেখ করেছেন। যেহেতু বস্তুটি গঙ্গা উপকূলে তৈরি হতো। বাংলাদেশী বস্ত্র শিল্পীর এই মসলিন শিল্প জগদ্বিখ্যাত। বিখ্যাত গ্রিক পর্যটক প্লিনি থেকে শুরু করে ডা. উরে (Dr. Ure) এবং টেইলর পর্যন্ত বিখ্যাত ব্যক্তিরা মসলিন সম্পর্কে বহু লেখায় ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
প্লিনির সময়ে মসলিনের নাম ছিল ‘কার্পাসিয়াম’, যদিও এই শব্দটি সংস্কৃত ভাষার কার্পাস শব্দের অপভ্রংশ। অতীতকালে ঢাকার আশপাশে ভাওয়াল রাজার অধীনে কাপাসিয়া প্রধান কেন্দ্র ছিল। ‘কার্পাসিয়াম’ শব্দ থেকে ‘কাপাসিয়া’ অঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছে। খ্রিস্ট ধর্মীয় গ্রন্থে (বাইবেল) এই মসলিনের উল্লেখ পাওয়া যায়। (ইজেফিল, ১৪শ অধ্যায় এবং ইলিয়ায় ১০, ১৩ ও তৃতীয় অধ্যায়ে) প্লিনি লিখেছেন, রোমে রাজপ্রাসাদের মেয়েরা মসলিন বস্ত্র পরিধান করিয়া স্বীয় নগ্ন অবয়ব সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করত। (A dress under whose slight veil our women continue to show their shapes to the public.)
ডাক্তার উরে বলেছেন, ‘রোমের স্বর্ণযুগে ঢাকার মসলিন রোমের রাজ মহিলাদের সবচেয়ে প্রিয় এবং বিলাস বসন হিসেবে আদৃত ছিল (cotton manufacturer of Great Britain by Dr. Ure) কবি ইয়েটস লিখেছেন, বঙ্গদেশের কার্পাস খ্রিস্টপূর্ব দুইশত বছর পূর্বে গ্রিক দেশে প্রচলিত ছিল।
জুভিনেলের পুস্তকেও মসলিনের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। প্লিনির লেখাতে পাওয়া যায়, বাংলাদেশের ঢাকা নগরী মসলিনের সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সুপ্রাচীন কাল থেকে ঢাকাই মসলিনের সুখ্যাতি প্রতিষ্ঠিত। চীন, তুরস্ক, সিরিয়া, আরব, ইথিওপিয়া, পারস্য ও স্পেনে এই মসলিনের বাণিজ্য প্রচলিত ছিল। সিল্ক রোড, নৌপথে, মধ্য এশিয়া থেকে ইউরোপ-অবধি এই মসলিনের বাণিজ্য প্রচলিত ছিল। বঙ্গদেশ থেকে আরব বণিকেরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মসলিন রফতানি করেছে। প্রবাদ আছে, তদানীন্তন স্পেনের রানী ইসাবেলার অত্যন্ত প্রিয় ছিল এই মসলিন। বঙ্গদেশের এই মসলিন যেত তাঁর কাছে। তা ছাড়া প্রভেন্স, ইতালি লেংগুইডকে ঢাকার মসলিন প্রেরিত হতো।
মিসরের রাজা এন্টোনিও (ক্লিওপেট্রার নন্দিতপ্রেমিক) তাঁর সৈন্যদের ‘কার্বাসাম’ বস্ত্র উপহার দিয়েছিলেন। ট্রেভারনিয়ার লিখেছেন, মুহাম্মদ আলী বেগ ভারত বর্ষ থেকে ফিরে রাজা চাসেফিকে মূল্যবান প্রস্তরখচিত ডিম্বাকৃতির একটি নারিকেল উপহার দেন। তার মধ্যে ৬০ হাত দীর্ঘ একটি মসলিন কাপড় ছিল। কাপড়টি এতই পাতলা ছিল যে, হাতে রাখলে কোনো কিছু আছে বলে মনে হতো না।
খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষভাগে ‘এরিয়ান’ ঢাকার মসলিনের উল্লেখ করেছেন (Periplus of the Erythrean sea) দুই চীনদেশীয় পর্যটক নবম শতাব্দীতে ভারতবর্ষের বিবরণীতে একটি পুস্তক লিখেছেন (Account of India and China by Two Mohammadan Travellers) নূরজাহানের মাতার এই উপহারে জাহাঙ্গীরের অহমিকায় ছেদ পড়ে যায়। প্রতিদানে জাহাঙ্গীর তাঁর শাশুড়িকে কিছু উপহার দেয়ার প্রস্তাব করেন। শাশুড়ি তেমনি এক পেয়ালা মসলিন দিলেই চলবে বলে জানিয়ে দেন। জাহাঙ্গীর মসলিন সংগ্রহের জন্য ২২০০ অশ্বারোহী সৈন্য বঙ্গদেশের উদ্দেশে প্রেরণ করেন। বঙ্গদেশের উদ্দেশে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে পথিমধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ সৈন্যের প্রাণহানি ঘটে। পানিতে ডুবে, ম্যালেরিয়া, দস্যুর আক্রমণ ইত্যাদি কারণে। কিন্তু ওইসব সৈন্যরা ছোট্ট একটি পেয়ালা পূর্ণ করার মতো মসলিন সংগ্রহ না করে দিল্লি দরবারে ফিরে যায়। এই সামান্য মসলিন দিল্লির সম্রাট শাশুড়িকে উপহার দিয়েছিলেন। শাশুড়ি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন; কিন্তু সম্রাট অপূর্ণ কাপটির বেদনা সারাজীবন বইতে হয়েছে। সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহানের কাছে মসলিন অত্যন্ত প্রিয় ছিল। মোগল সম্রাটরা মসলিনের প্রতি এত ঈর্ষান্বিত ছিলেন যে মসলিনের প্রচার ও বিদেশ পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নূরজাহানের সুরুচির কারণে ভারতের সব নগরীতে মসলিন একটি বিশেষ স্থান দখল করেছিল।
মসলিনের সুতা সাধারণত মেয়েরা তৈরি করত এবং এটি মেয়েদের কাজ হিসেবে গণ্য করা হতো। পুরুষরা সুতা কাটাকে অপমানজনক মনে করত। যেসব সৈন্য বা রাজা যুদ্ধে পরাজিত হতেন, তাদের অপমান করার জন্য সুতা কাটতে দেয়া হতো। বাংলার সুতো কাটার ওপর বৈষ্ণব সঙ্গীত প্রচলিত গানটি ছিল এরূপ—
“(সে হাটে) বিকায় নাতো অন্য সুতা
বিনা তাঁতি নন্দের সুত
সে হাটের প্রধান তাঁতি, প্রজাপতি পশুপতি,
আর যত আছে তাঁতি-তাদের শুধু যাতাযাতি\”
মসলিনে সূক্ষ্ম সুতা কাটার জন্য তরুণী মেয়েদের ব্যবহার করা হতো, কারণ তাদের দৃষ্টিশক্তি ও হাতের সাহায্যে সূক্ষ্মতা অনুভূত হতো। বয়স বাড়লে অনুভূতিগুলো নষ্ট হয়ে যায়। 'India of Ancient and Middle Age' গ্রন্থে মিসেস ম্যানিং লিখেছেন, ঘাসের ওপর বিছানো একখানি সুদীর্ঘ মসলিন একটি গাভী খেয়ে ফেলেছিল। যার জন্য গাভীর মালিক দণ্ডিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক কাফি খাঁ মোগল অন্তঃপুরে মসলিনের কদরের কথা লিখেছেন। বস্ত্র শিল্পের ইতিহাসে মসলিন সর্বশ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণিত হয়েছে। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মাত্র একটি ঘর তাঁতি মসলিন বয়ন করতে পারত, তা পরবর্তী সময়ে বিলীন হয়ে যায়। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে একখানি মসলিন ৬০ পাউন্ডে বিক্রি হতো। তার দৈর্ঘ্য ছিল বিশ গজ, ওজন ছিল সাড়ে সাত আউন্স। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে একখানি মসলিন ৪০০ পাউন্ডে বিক্রি হতো। টপোগ্রাফি অব ঢাকায় ১৬০ হাত লম্বা একখানি মসলিনের ওজন ছিল চার তোলা। এই মসলিন সোনারগাঁয়ে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয়েছিল।
ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা ও মেঘনার মিলনস্থলে ১৯৬০ বর্গমাইল জুড়ে পৃথিবীর সর্বোত্কৃষ্ট মসলিন তৈরি হতো। এর কেন্দ্রস্থল ছিল ‘কাপাসিয়া’। তাছাড়া ঢাকা, মুড়াপাড়া, সোনারগাঁ, ডেমরা, তিতবর্দী, বালিয়াপাড়া, নপাড়া, মৈকুলী, বাহারক, চরপাড়া, বালটেক, নবীগঞ্জ, সাহাপুর ও সামরাই প্রভৃতি স্থানে মসলিন উত্পন্ন হতো। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে মসলিনের অবনতির দিনেও ঢাকায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, সোনারগাঁয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ডেমরায় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, তিতবর্দীতে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মসলিন রফতানি বা বিক্রি হয়েছিল। ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে ২৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার বস্ত্র বিক্রি হয়েছিল। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে ৫০ লাখ টাকার মসলিন বিদেশে রফতানি হয়েছিল।
ইংরেজ শাসনামলে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাপড় প্রস্তুত করে ঢাকার মসলিনের সঙ্গে পাল্লা দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ওয়াটসন সাহেব লিখেছেন 'With all our machines and wonderful Intentions we have neither to been unable to produce a fabric which for fineness or utility can equal the woven air of Dacca.' আমাদের বস্ত্রের নানাবিধ অত্যাশ্চর্য উপায়গুলো থাকা সত্ত্বেও চারুশিল্প হিসেবে মসলিনের ঐন্দ্রজালিক সক্ষমতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারিনি। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সরকার ঢাকার মসলিন উত্পাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করে এবং ব্রিটিশদের তৈরি কাপড় রফতানি শুরু করে। ফলে মসলিন উত্পাদন ক্রমে ক্রমে বিলোপ হতে থাকে। তাছাড়া মসলিন প্রস্তুতকারী তাঁতি ও সুতা তৈরির কারিগরদের ওপর নানা প্রকার নির্যাতন শুরু করা হয়। এমনকি মসলিন তৈরির সূক্ষ্ম কারিগরদের আঙুল কেটে দেয়া হয়।
বঙ্গদেশের গোটা প্রদেশে এই বস্ত্র তৈরি হতো। এর বাণিজ্যের প্রধান স্থান ছিল ঢাকা, সুবর্ণগ্রাম, ডেমরা, তিতবর্দী, জঙ্গলবাড়ি ও বাজিতপুর। প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীর সুসভ্য দেশ থেকে এসব অঞ্চলে বণিকদের আগমন ঘটেছিল।
বর্তমান প্রজন্মের কাছে মসলিন একটি নাম এবং ইতিহাস বিশ্বখ্যাত এই মসলিন আমার ঐতিহ্যের সম্পদ। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এই মসলিন হয়তো আমরা আর তৈরি করতে পারব না। যদিও বর্তমানে কিছু মসলিন তৈরি হচ্ছে, যা আগেকার তুলনায় অত্যন্ত স্থূল। আসুন, সবাই মিলে গৌরবোজ্জ্বল মসলিনের গৌরব ফিরিয়ে আনি।
গ্রন্থসূত্র
১. চীনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
২. বৃহত্ বঙ্গ, ড. দীনেশচন্দ্র সেন
৩. প্রাচীন আরবের ইতিহাস ও বেদুঈন পোশাক, আরব সরকার প্রকাশিত