Wednesday, October 20, 2010

কেম্ব্রিজের অসামান্য গবেষণা সাফল্য

কেম্ব্রিজের অসামান্য গবেষণা সাফল্য

আফতাব হোসেন

গবেষণায় অত্যন্ত নাটকীয় এক অগ্রগতির ফলে এই পৃথিবীর লাখো কোটি মানুষের জীবন বদলে যেতে পারে। কেম্ব্রিজ গবেষণাগারের গবেষণায় প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে, দেহে যে স্বাভাবিক অনাক্রম্যতা শক্তি বা দেহে প্রবিষ্ট জীবাণু বা দুশমনের বিরুদ্ধে যে প্রতিরক্ষা দলটি রয়েছে তা ভাইরাসজনিত সাধারণ ঠাণ্ডা লাগা বা সর্দিজ্বর প্রতিরোধ করতে পারে। এ পরীক্ষায় প্রমাণিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো ঠাণ্ডা বা সর্দিজ্বরের ভাইরাস মানুষের দেহকোষের একান্ত ভেতরের স্তরে পেঁৗছে যাবার পরও দেহের অনাক্রম্যতা ব্যবস্থা তা প্রতিরোধ করতে পারে। বিষয়টি অদ্যাবধি অসম্ভব মনে করা হতো।

ব্রিটিশ পত্রিকা দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এর বিজ্ঞান সম্পাদক স্টিভ কনর বলছেন, ঘন লাল রঙের ভাইরাস দেহে অনুপ্রবেশ করার পর আমাদের দেহের রক্তপ্রবাহে প্রবাহিত হয়ে থাকে। আর সেই রক্তে থাকে অ্যান্টিবডি উৎপাদক অ্যান্টিবডি ( হলুদ বর্ণের)। অ্যান্টিবডি ভাইরাস শনাক্ত করতে পারে।

কেম্ব্রিজ গবেষণাগারের আবিষ্কার নতুন নতুন ভাইরাসবিধ্বংসী ওষুধ তৈরির দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে যা মানুষের দেহকোষের ভাইরাস ধ্বংসের স্বাভাবিক ব্যবস্থাকে আরো অনেক বেশি শক্তিশালী করে তুলতে পারে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, আগামী দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে এই গবেষণালব্ধ ফলের ভিত্তিতে নতুন নতুন ওষুধের প্রথম ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়ে যাবে।

গবেষকরা বলছেন, আরো অনেক ধরনের রোগব্যাধির ভাইরাসের বিরুদ্ধেও এ পদ্ধতিতে প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে। নন-ভাইরাস রোগ বা রোটাভাইরাস সংক্রমণজনিত উদরাময়ও এসব রোগের অন্তভর্ুক্ত থাকতে পারে। রোটাভাইরাস ডায়রিয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হাজার হাজার শিশু প্রাণ হারায়।

তথ্য হলো, ভাইরাস এখনও সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী রোগ। ক্যান্সারে পৃথিবীতে যতো বেশি লোক প্রাণ হারায় তার দ্বিগুণ লোক মারা যায় এই ভাইরাসে। এর মূল কারণ হলো ভাইরাস দেহে সংক্রমণের পর গভীরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। আর তখন দেহের যে অনাক্রম্যতা শক্তি রযেছে তা সেখানে গিয়ে কাজ করতে পারে না। কাজ করতে পারে না এমনকি অনেক শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক অথচ এসব অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণুর বিরুদ্ধে খুবই ভালো কাজ করতে পারে।

কেম্ব্রিজের বিশ্বখ্যাত আণব জীববিদ্যা গবেষণাগারে একটি সমীক্ষাদল কার্যত প্রমাণ করেছেন যে, মানব দেহের অনাক্রম্যতা ক্ষমতা যে একটা সীমা পর্যন্ত কাজ করতে পারে বলে পাঠ্যপুস্তকে যে কথা বলা হয়েছে তা ঠিক নয়। কারণ ভাইরাসধ্বংসকারী অ্যান্টিবডি আসলে ভাইরাস দেহের কোষে প্রবেশ করে তার সাথে ঐ অ্যান্টিভাইরাস অ্যান্টিবডিও ঢুকতে পারে। আর অনুপ্রবেশকারী বিজাতীয় ভাইরাসকেও ধ্বংস করার জন্য দ্রুত সক্রিয় হতে পারে। '' রোগ অনাক্রম্যতা সম্পর্কিত বিজ্ঞানের যে কোনো পাঠ্যবই থেকে জানা যায় যে, একবার কোনো ভাইরাস দেহকোষে ঢুকে যেতে পারলে সব খেলা শেষ তখন আর কিছুই করার থাকে না কেননা কোষটি আক্রান্ত হয়ে যায়। তখন দেহের মাঝে রোগ অনাক্রম্যতার যে স্বাভাবিক ক্ষমতাটি থাকে তা কেবল কোষটিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ভাইরাসজনিত রোগটি নিরাময় করতে পারে না। একথা বলছেন কেম্ব্রিজ গবেষণা টিম প্রধান লিও জেমস।

তবে মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের গবেষণাগারের সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেহের অনাক্রম্যতা ব্যবস্থায় যে অ্যান্টিবডি উৎপাদিত হয় তা হামলাকারী ভাইরাসকে শনাক্ত করে তার বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। আসলে এ প্রক্রিয়ায় অ্যান্টিবডি বহিরাগত ঐ ভাইরাসের ঘাড়ে চড়েই দেহকোষে প্রবেশ করে। আর একবার কোষে ঢুকতে পারলেই দেহকোষে ট্রিম২১ নামে যে স্বাভাবিক প্রোটিন থাকে তা অ্যান্টিবডিকে শনাক্ত করলে ওটা শক্তিশালী ভাইরাস ধ্বংসকারী মেশিন বা যন্ত্রে রূপান্তরিত হয় আর মাত্র ২ ঘণ্টার মধ্যে ঐ ভাইরাসকে সেল বা দেহকোষটিকে ছিনতাই করে সেটিকে তার নিজস্ব প্রোটিনে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা অর্জনের আগেই খতম করে দেয়। '' এটা দেহকোষের জন্য সংক্রমিত হওয়ার পর তা থেকে অব্যাহতি লাভের শেষ সুযোগ নইলে কোষটির ধ্বংস হওয়া ছাড়া গতি থাকে না বলেছেন ডঃ জেমস।

সেলের তথা দেহকোষের ভেতরে যখন ভাইরাসটি ঢুকে যায় তার সাথে অ্যান্টিবডিও আঠার মতো লেগে থাকে - কোনো মতেই অ্যান্টিবডিকে ভাইরাস ঝেড়ে ফেলতে পারে না। আর সেজন্যই অ্যান্টিবডির সাথে যা লেগে থাকে অর্থাৎ ভাইরাসটি লেগে থাকলে তা বিজাতীয় হিসেবে শনাক্ত হবার পর ভেঙে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এ হলো সবচেয়ে বড়ো সুবিধা।

এ যাবৎ ভাবা হতো যে দেহের অনাক্রম্যতা ব্যবস্থায় অ্যান্টিবডি যে কাজই করুক তা করে রক্ত কিংবা অন্য ধরনের সেলরস ইত্যাদিতে থাকা দেহকোষের একান্ত বাইরে। এখন বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন যে দেহকোষের মধ্যে আরো একটি ভেতরের অনাক্রম্যতা স্তর আছে যার ভাইরাসবিধ্বংসী ব্যবস্থাকে আরো অনেক বেশি শক্তিশালী করে তোলা যায়। এখানে একটি অতি চমৎকার বিষয় হলো প্রতিটি সংক্রমণের বেলায় যখনই কোনো ভাইরাস দেহকোষে প্রবেশ করে তখনই অ্যান্টিবড়ির জন্য সুযোগ তৈরি হয় ওটাকে বহিষ্কার করার। আর এটাই হলো দেহের অনাক্রম্যতা শক্তি সম্পর্কে এতোকালের যে ধারণা তার মোৗলিক পার্থক্য। ঠিক এ মুহূর্তে আমরা জানি টি সেল (রক্তের শ্বেতকণিকা) পেশাদার দেহরক্ষাকারী হিসেবে সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং সেরকম কোনো কিছু ধরা পড়লে সেটাকে ধ্বংস করে।

ডঃ জেমস বলছেন, এ ব্যবস্থাটা অনেকটা অতর্কিতে আক্রমণ পরিচালনার মতো। যতোবারই ভাইরাস কোষে প্রবেশ করতে চায় ততোবারই অনাক্রম্যতা ব্যবস্থার সুযোগ থাকে ঐ ভাইরাসকে বের করে দেয়ার। প্রক্রিয়াটি খুবই দ্রুত। আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে, সেলে ভাইরাস ঢোকার ২-১ ঘণ্টার মধ্যেই সেটাকে অকার্যকর করে দেয় অ্যান্টিভাইরাস।

এ সমীক্ষার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের জার্নালে। গবেষণাগারে মানুষের যে দেহকোষ কালচার করে তৈরি করা হয়েছে সেটাকে প্রাণীর দেহে প্রয়োগ করে সংখ্যাবৃদ্ধি করতে হবে যাতে তার প্রথম ক্লিনিক্যাল টেস্টটি মানুষের দেহে অনুষ্ঠিত হতে পারে।

এর এক সম্ভাবনা হলো এই যে, সর্দিঠাণ্ডা ডেকে আনে এমন অনেক জাতের ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রোটিন ট্রিম২১কে নাকের স্প্রে হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। রাইনোভাইরাসের মতো ভাইরাসগুণো সাধারণত নোরাভাইরাস সংক্রমণের কারণ যা থেকে শীতকালে সাধারণত বমির মতো রোটাভাইরাস সংক্রমণ ঘটে। এ থেকে আবার গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস বা পাকস্থলী প্রদাহের সৃষ্টি হয়।

ডঃ জেমস জানান, এভাবে দেহের সকল অ্যান্টিবডিকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে আরো সক্রিয়, আরো শক্তিশালী করে তোলা যায়। তাতে সুবিধে হবে এই যে, এটাকে বহু ভাইরাস সংক্রমণের বেলায়ও ব্যবহার করা সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, আমরা এভাবে যেসব ওষুধ তৈরি করবো সেগুলো নাকের স্প্রে বা ইনহেলার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে, পিল হিসেবে সেবনের দরকার হবে না। আর এ দিয়ে ঠাণ্ডা-সর্দির চমৎকার চিকিৎসা করা যাবে। এটার সুবিধে আগেই বলা হয়েছে, সংক্রমিত ভাইরাস তার নিজের প্রোটিন তৈরি করে পাল্টা লড়ার সুযোগ পাবে না বা বেঁচে থাকতেও পারবে না।

এ গবেষণাগারের আরেক বিজ্ঞানী স্যার গ্রেগ উইন্টার বলেছেন, অ্যান্টিবডিগুলো আসলে দারুণ ক্ষমতাধর আণব সমরযন্ত্র বিশেষ। এখন দেখা যায়, তারা কোষের ভেতরে গিয়েও ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। কাজেই আজকে গবেষণা যে পর্যায়ে উপস্থিত হয়েছে সেটা থেকে শুধু এটাই জানা যায়নি অ্যাটিভাইরাস কেমন করে কোথায় কাজ করে বরং তার চেয়েও আমাদের বড়ো লাভ হয়েছে অনাক্রম্যতা ও সংক্রমণ সম্পর্কে আমরা যে জ্ঞান নিয়েছিলাম তাতে রীতিমতো একটা বিপস্নব এসেছে।

সূত্র ঃ দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট, যুক্তরাজ্য

[ লেখক : সাংবাদিক ]

No comments:

Post a Comment