Thursday, September 20, 2012

মাকসুদুলের নেতৃত্বে ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন: শাবাশ বাংলার বিজ্ঞানীরা

মাকসুদুলের নেতৃত্বে ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন:
শাবাশ বাংলার বিজ্ঞানীরা

- ইফতেখার মাহমুদ | তারিখ: ২০-০৯-২০১২


পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনকে বলা হয়েছিল স্বপ্নযাত্রা। জিন বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে দেশের বিজ্ঞানীরা এবার ওই যাত্রাপথের মধ্যগগনে পৌঁছেছেন। পাটসহ বিশ্বের ৫০০টি উদ্ভিদের অন্যতম শত্রু ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন তাঁরা। অর্থাৎ ছত্রাক কীভাবে ফসলের জৈব উপাদান নষ্ট করে, উৎপাদন কমিয়ে দেয়, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা সেই সূত্র বা রহস্য বের করেছেন। 
ম্যাক্রোফমিনা ফাসিওলিনা নামের ওই ছত্রাকের আক্রমণে দুনিয়াজুড়ে ৫০০টি উদ্ভিদের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ছত্রাকের আক্রমণে শুধু পাটের উৎপাদনই ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে যেতে পারে। ছত্রাক কীভাবে ফসলের ক্ষতি করে তা জানতে বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানী বছরের পর বছর চেষ্টা করে গেলেও এ সম্পর্কে জানতে পারেননি।
মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে বিজ্ঞানীদের দল সেই অজানা রহস্যের সূত্র খুঁজে পেয়েছে। এখন স্বপ্নের পথ বেয়ে মূল গন্তব্যে পৌঁছানোর পালা। অর্থাৎ ছত্রাকের আক্রমণ সহ্য করে টিকে থাকতে পারে এমন জাত উদ্ভাবন করে কৃষকের হাতে পৌঁছে দেওয়া।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সম্পদের অপ্রতুলতা আছে। কিন্তু এ ধরনের গবেষণার ক্ষেত্রে আমরা অর্থ দিতে কার্পণ্য করিনি।’ এই গবেষণার সাফল্যকে কৃষকের দরজায় পৌঁছে দিতে সরকার সম্ভাব্য সব কিছু করবে বলে জানান তিনি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাটবিষয়ক মৌলিক ও ফলিত গবেষণা প্রকল্পের আওতায় মাত্র এক বছরের মাথায় দেশের বিজ্ঞানীরা এই অভাবনীয় সফলতা পেলেন। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে এই প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত একটি গবেষণা কেন্দ্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা এই যুগান্তকারী কাজটি সম্পন্ন করেছেন। গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সফলতার খবরটি জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেন। আর বিশ্বের বিজ্ঞানবিষয়ক অন্যতম প্রভাবশালী সাময়িকী বিএমসি জেনোমিকসও ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচনবিষয়ক গবেষণাটি গতকালই প্রকাশ করেছে।
মাকসুদুল আলম তাঁর সর্বশেষ আবিষ্কার নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে সম্পদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সরকারি অর্থায়ন, ব্যবস্থাপনা ও লোকবল দিয়ে এ ধরনের সুশৃঙ্খল একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা পরিচালনা সারা বিশ্বের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করেই থেমে থাকেনি মাকসুদুলের বিজ্ঞানী দল। এই গবেষণার ফলাফলে যাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিকানা বা পেটেন্ট থাকে তা নিশ্চিত করার পথেও তাঁরা অনেক দূর এগিয়েছেন। পাটের ওপর দুটি ও ছত্রাকের ওপর তিনটি গবেষণার পেটেন্ট (কৃতিস্বত্ব) দাবি করে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে। এই পাঁচটি গবেষণার পেটেন্ট পেতে ওই প্রকল্পের আওতায় তিনজন ব্যারিস্টার কাজ করছেন।
শুধু তা-ই নয়, অল্প পানিতে ও দ্রুত পাটের আঁশ জাগ দেওয়া বা পচানোর মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য গবেষণা শুরু করে দিয়েছেন তাঁরা। তবে এর সুফল কৃষক পর্যায়ে পৌঁছাতে দেশবাসীকে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে বলে এই বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। এই ছত্রাকটি ধান, গম, ভুট্টা, সয়াবিন, তুলা, যবের মতো বিশ্বের প্রধান ফসলগুলোরও অন্যতম শত্রু। 
জীবনরহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে ওই ছত্রাক ফসলের শরীরে প্রবেশ করে কীভাবে তাদের প্রোটিনসহ অন্যান্য জীবনীশক্তি নষ্ট করে, তার রহস্য খুঁজে পাওয়া গেছে। ফলে এই দিক থেকে গবেষণাটিকে বৈশ্বিকভাবেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। বিশ্বের তিনটি ফসল, চারটি জীবাণুসহ মোট ১৯টি জীবের জীবনরহস্য উন্মোচনের নেতৃত্বে ছিলেন এই কৃতী বিজ্ঞানী। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে পেঁপে, মালয়েশিয়ার হয়ে রাবার ও বাংলাদেশের হয়ে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের মধ্য দিয়ে মাকসুদুল শুধু দেশে নয়, বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। 
পাটের জীবনরহস্য উন্মোচনের গবেষণার সফলতার পর মাকসুদুল আলম ২০১০ সালের নভেম্বর থেকে পাটবিষয়ক মৌলিক ও ফলিত গবেষণা প্রকল্পের কাজে হাত দেন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত মেয়াদের ৬৬ কোটি টাকার এ প্রকল্পের প্রধান গবেষক হিসেবে তাঁর জন্য প্রতি মাসে পারিশ্রমিক হিসেবে ১৬ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ পৌনে ছয় কোটি টাকা শুধু মাকসুদুল আলমের পারিশ্রমিক হিসেবে ধরা হয়েছিল। কিন্তু মাকসুদুল সেই টাকা নিতে রাজি হননি। বিনা পারিশ্রমিকে গবেষণার পুরো কাজটি করে দিয়েছেন তিনি।
দেশের জেনোম গবেষণার পথিকৃৎ মাকসুদুল আলম ও তাঁর সঙ্গী বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন দেশের অর্থনীতির ইতিহাসকেই বদলে দিতে পারে। ষাট ও সত্তর দশকেও বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল ব্রাজিল ও মালয়েশিয়ার। উন্নত মানের রাবার চাষ করে মালয়েশিয়া, কফি ও লেবুর আবাদ করে ব্রাজিল তাদের অর্থনীতিকে মজবুত করে। কৃষি খাতের এই উদ্ভাবনের ওপর ভিত্তি করেই এই দুই দেশের অর্থনীতি আজ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। 
গবেষক দলের প্রধান মাকসুদুল আলম এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘একসময় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার বড় অংশ আসত পাট থেকে। পাটের ওপর ভিত্তি করে এ দেশের অর্থনীতির প্রাথমিক বুনিয়াদ তৈরি হয়েছিল। আমাদের পাট এবং পাটের প্রধান শত্রু ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচনের মধ্য দিয়ে আমরা আবারও পাটের সেই স্বর্ণালী দিন ফিরিয়ে আনতে পারব। সেই স্বপ্নের গন্তব্যে পৌঁছাতে আরও কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।’
পাট ও ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচনকারী বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ২০ বছর আগে দেশের বিজ্ঞানীরা সাদা আঁশের পাটের একটি লাইন (জাত তৈরির আগের পর্যায়) উদ্ভাবন করেছিলেন। এই ধবধবে সাদা আঁশযুক্ত পাটের আঁশ ব্যবহার করতে প্রক্রিয়াজাত (ব্লিচিং) করার দরকার হয় না। প্রক্রিয়াজাত ছাড়াই এটি সরাসরি কাপড় বা অন্যান্য সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।
পরিশোধন করতে না হলে পাটের উৎপাদন-ব্যয় হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি পাটের বর্জ্য থেকে পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও থাকে না। এই জাতকে ঘিরে বিজ্ঞানীরা এমনটাই আশা জাগিয়েছিলেন। কিন্তু লাইন থেকে জাত তৈরি করতে গিয়েই লাগল বিপত্তি। ধবধবে সাদা আঁশের ওই পাট দেশবাসীর মনে আশার ঝিলিক দিয়ে আবার হতাশায় ডুবিয়ে দিয়েছিল। ওই পাটের জাতটি বড় হওয়ার আগেই ছত্রাকের আক্রমণে কাণ্ডপচা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। পাটের সাদা আঁশ দিয়ে সরাসরি কাপড় তৈরির সেই স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। 
পাটবিষয়ক মৌলিক ও ফলিত গবেষণা প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ওই সাদা পাটের জাতকে ছত্রাকসহিষ্ণু করার কাজটাই শুরু করতে যাচ্ছেন তাঁরা। ওই জাতের ওপর আক্রমণকারী ছত্রাকটির ব্যবহূত হাতিয়ার ও তা ব্যবহারের কলাকৌশল এর জীবনরহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে জানা গেছে। 
গবেষকেরা জানিয়েছেন, প্রচলিত পদ্ধতির গবেষণা আমাদের অনেক নতুন নতুন ফসলের উচ্চফলনশীল জাত উপহার দিয়েছে। এসব জাতের আশানুরূপ ফলন বাড়ানো আর সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ফসলের জাত উন্নয়নের প্রচলিত পদ্ধতির সক্ষমতার প্রায় পুরোটা ব্যবহার হয়ে গেছে। একমাত্র জেনোম গবেষণার মাধ্যমে নতুন জাত উদ্ভাবন করা যাবে, যার মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বহুগুণ বাড়ানো যাবে। 
বাংলাদেশ আরও কী পাবে: পেটেন্ট পাওয়া গেলে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে বাংলাদেশে উদ্ভাবিত পাটের জাত ও ছত্রাক প্রতিরোধক ফসল চাষ করতে হলে বাংলাদেশকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ দিতে হবে। যেমন মাইক্রোসফট কোম্পানির সফটওয়্যার ব্যবহারকারী বিশ্বের প্রতিটি কম্পিউটার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্ব বাবদ অর্থ দিতে হয়। ভারত ইতিমধ্যে নিমের পেটেন্টের জন্য আবেদন জমা দিয়েছে। পাট ও ছত্রাকের পেটেন্ট দাবি করে বাংলাদেশই প্রথম আবেদন জমা দিয়েছে বলে জানা গেছে। 
মাকসুদুল আলম এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা এত দিন জেনোমবিষয়ক যাবতীয় তথ্য উন্নত বিশ্বের তথ্যভান্ডার থেকে শুধু সংগ্রহই করে গেছে। কিন্তু এখন সে তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ করতে আমরাও অংশ নিলাম। বিশ্ব দেখবে আমরা শুধু তথ্য নিই না, দিতেও পারি।