বাংলা ভাষার নতুন ভ্রমণ
ইউএনএল (ইউনিভার্সাল নেটওয়ার্কিং ল্যাঙ্গুয়েজ) মানবসভ্যতার জন্য একটি অতুলনীয় অর্জন। আট বছর আগেও মানুষ ভাবতে পারেনি যে একটি ডিজিটাল ভাষার মাধ্যমে পৃথিবীর সব ভাষাভাষীর মানুষ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারবে নিজ ভাষার মাধ্যমে। অথচ তা-ই হলো। আপনি যত বড় পণ্ডিতই হোন না কেন, পৃথিবীর ডজন খানেক ভাষা আপনি সারা জীবনে হয়তো আয়ত্ত করতে পারেন। কিন্তু ইউএনএল এমন একটি প্রাযুক্তিক ভাষা, যার মাধ্যমে আপনি অন্য শত শত ভাষার সঙ্গে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করতে পারেন নিজ ভাষার মাধ্যমেই। এ ভাষা অদৃশ্য। তা ধরাছোঁয়ার বাইরে। কম্পিউটারে ইউএনএল প্রোগ্রামে যান এবং আপনার নিজ ভাষায় ভিন্ন ভাষী বন্ধুকে পত্র, প্রবন্ধ, বই—যা ইচ্ছা লিখুন। উপমাস্বরূপ, বন্ধুটি যদি আরবি ভাষাভাষী হন, নিজ ভাষায় লিখুন এবং টিপ দিন আরবি ভাষার বোতামে। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি তা আরবি ভাষায় পেয়ে যাবেন, চীনা হলে চীনা ভাষায় পাবেন। জাপানি হলে জাপানি ভাষায়। আবার ওপার থেকে তিনি যখন তাঁর নিজ ভাষায় উত্তর লিখে বাংলা ভাষার বোতামে চাপ দেবেন, তৎক্ষণাৎ তা আপনি বাংলা ভাষায় পেয়ে যাবেন। অর্থাৎ লেখালেখি, গবেষণা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কূটনৈতিক—যেকোনো যোগাযোগ এখন ইউএনএলের মাধ্যমে করা সম্ভব এবং তাৎক্ষণিকভাবে। এর জন্য বিদেশি ভাষা জানার দরকার নেই।
তবে বাংলা ভাষার জন্য এ সুবিধা এখনো সৃষ্টি করা যায়নি। কারণ, বাংলা ভাষাকে এখনো ইউএনএলের সদস্যভুক্ত করা হয়নি। হিন্দি, উর্দুসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি ভাষা ইউএনএলের সদস্য হয়ে নিজ ভাষার মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সঙ্গে যোগাযোগ করছে; কিন্তু বাংলাদেশ এখনো এর সদস্য হওয়ার জন্য এগিয়ে আসেনি। সদস্য হওয়ার কিছু পূর্বপ্রস্তুতি আছে, যেমন ইউএনএল নির্মিত ছকে বাংলা ভাষার একটি ডিজিটাল অভিধান ও একটি ডিজিটাল শব্দকোষ নির্মাণ করা, যা কিনা এ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান করেনি। ইউএনএল পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সাল নেটওয়ার্কিং ল্যাঙ্গুয়েজ ফাউন্ডেশন, জেনেভা। বিশ্বের প্রতিটি ভাষা যেন ইউএনএলের সুবিধা নিতে পারে এবং প্রত্যেক মানুষ যেন তা অবাধে ব্যবহার করতে পারে, সে জন্য ইউএনএল সবার জন্য বিনা মূল্যে খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক যে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউএনএলের সদস্য হওয়ার জন্য এগিয়ে আসেনি। সদস্য হতে গেলে যে ডিজিটাল শর্ত পূরণ করতে হয়, তা পালন করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।
সুখের কথা, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এ উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্পের কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। ইউএনএলের সদস্য হওয়ার পূর্বশর্তে বাংলা ডিজিটাল শব্দকোষ ও অভিধান নির্মাণে একটি বড় কলাকুশলী দল কাজ শুরু করেছে। প্রকল্পটিকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহায়তা দেওয়ার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, সরকারি সাহায্য পেলে দেড়-দুই বছরের মধ্যে বাংলা ভাষাও ইউএনএলের সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করবে। তখন বাংলা ভাষার মাধ্যমে অন্যান্য ভাষার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে ইউএনএলভুক্ত ভাষার সদস্যসংখ্যা ১৬৫। কিন্তু বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ ভাষা বাংলা এখনো এর সদস্যপদ নিতে পারেনি। অর্থাৎ সদস্যপদ নেওয়ার শর্তাবলি পূরণ করতে পারেনি। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় গ্লানি বলতে হবে। কেননা, যে ভাষার জন্য মানুষ আন্দোলন করেছে, প্রাণ দিয়েছে, যে ভাষা আন্দোলনের সম্মানে একুশে ফেব্রয়ারি বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে, সে ভাষা এখনো ইউএনএলের মাধ্যমে বিশ্বভাষাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেনি, সে গ্লানি রাখার জায়গা কোথায়?
সভাপতি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি
সালাহ্ উদ্দিন
ভাষার প্রধান বাহক মানুষ। আরও কিছু বিষয় আছে, যারা ভাষাকে বয়ে নিয়ে চলে, যেমন বই। ভাষার এই গমনাগমনে ভাষা নিজে পরিবর্তিত হয়, অপরিচিতের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। কিন্তু তার জন্য এক ভাষার মূল বক্তব্যকে অন্য ভাষায় রূপান্তরিত হতে হয়। এই কাজ করে থাকেন কোনো অনুবাদক। রাষ্ট্রীয় কোনো যোগাযোগ থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য বা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অনুবাদকের দয়ার ওপর সবাইকে নির্ভর করতে হয়। এমন যদি হয়, পৃথিবীর অন্তত ১৫০টি ভাষাকে সহজেই অনুবাদ করে ফেলা যাবে বাংলায় এবং এর জন্য অনুবাদককেও কাঠ-খড় পোড়াতে হবে না। বসে থাকতে হবে না দীর্ঘ সময়। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তা করা যাবে। কেবল একটি বোতাম চাপায় দেখা গেল মুহূর্তেই সাহিত্যে ২০১০ সালের নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক মারিয়া বার্গাস য়োসা স্প্যানিশ ভাষায় রচিত বা পর্তুগিজ ভাষায় রচিত আরেক নোবেল বিজয়ী হোসে সারামাগোর উপন্যাস খুব সহজেই রূপান্তরিত হয়ে গেল বাংলায়। এরকম কিছু স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়েই কাজ শুরু করেছিল জাপানের ‘ইউনাইটেড নেশনস ইউনিভার্সিটি’ ১৯৯৬ সালে। এখন বলা যায় ইউএনএল বা ইউনিভার্সাল নেটওয়ার্কিং ল্যাঙ্গুয়েজ প্রযুক্তির আওতায় ১৬৫টি ভাষাকে অন্য যেকোনো ভাষায় রূপান্তরের কাজ করা যাবে চোখের পলকেই। নতুন খবর হচ্ছে বাংলা ভাষাও এখন সংযুক্ত হচ্ছে এই প্রকল্পের সঙ্গে।
প্রসঙ্গ ইউএনএল
ইউএনএল বা ইউনিভার্সাল নেটওয়ার্কিং ল্যাঙ্গুয়েজ এমন একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, সংক্ষেপে যদি বলা হয়: কেবল একটি বোতাম চাপার ব্যবধানে পাল্টে দেবে এক ভাষাকে অন্য ভাষায়। তবে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা পেতে হলে প্রাথমিক শর্ত হলো অনুবাদের সুবিধা পাওয়ার আগে ওই ভাষার সম্পূর্ণ একটি অভিধান ও ব্যাকরণকে ইউনিকোডে ব্যবহারের উপযুক্ত করে তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ এমন একটি নির্দেশাবলি তৈরি করতে হবে, যা যেকোনো ভাষাকে সেই নির্দেশাবলির আওতায় ইপ্সিত ভাষায় রূপান্তরিত করতে পারবে। যে কারণে এই সেবামূলক প্রকল্পে যে প্রতিষ্ঠান তার ভাষার ব্যাকরণ ও অভিধান তৈরি করতে পারবে, তারাই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে। ইউএনের তত্ত্বাবধানে জাপান এই প্রকল্পের কাজ শুরু করে প্রায় ২০০ কম্পিউটার প্রযুক্তিবিদ ও ভাষাবিদের সমন্বয়ে।
এখান আসা যাক বাংলা ভাষার কথায়, অন্য একটি নির্দিষ্ট ভাষাকে বাংলায় রূপান্তর করতে প্রথমে ওই ফরমায়েশটি ইউএনএল প্রযুক্তিতে সরবরাহ করতে হবে। সরবরাহকৃত লেখা অনুবাদের জন্য এই প্রযুক্তি যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন, অর্থাৎ ইউএন, তাঁদের অনুমতি পেতে হবে। তাঁদের অনুমতি পাওয়ার পরই কেবল ভিন ভাষার বইটি আমাদের ভাষায় প্রয়োজনীয় অনুবাদ করা যাবে। শুরু থেকেই জাতিসংঘের আওতায় এই অনুবাদ প্রকল্পের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম বেধে দেওয়া হয়েছে। যেমন, একটি রাষ্ট্র কেবল একটি ভাষাকেই তাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ইউএনএল প্রযুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। আর এই প্রযুক্তিতে সব ভাষা অনুবাদের ক্ষেত্রে ইংরেজি হলো মান ভাষা অর্থাৎ আমি ভাত খাই রুশ ভাষার এই বাক্যটি প্রথমে অনুবাদ হবে ইংরেজিতে তারপর বাংলায়।
বাংলা ভাষার নতুন ভ্রমণ
বর্তমান ইন্টারনেটের দুনিয়ায় সারা বিশ্বই এখন হাতের মুঠোয়, কিন্তু ভাষাগত সমস্যায় অনেক সময় সহজ কাজটিও দুর্বোধ্য ঠেকে। কিন্তু বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ যদি এই ইউএনএল-এর আওতায় চলে আসে তাহলে আর্থিক লেনদেন থেকে শুরু করে কূটনৈতিক যোগাযোগ বা সাংস্কৃতিক যোগাযোগ সব ক্ষেত্রেই ইন্টারনেটের নতুন দুনিয়াকে আরও সহজ ও গতিশীল করে তুলবে।
ভারত হিন্দি ভাষার পাশাপাশি বাংলাকেও এই প্রযুক্তির আওতায় আনতে চেয়েছিল কিন্তু ইউনাইটেড নেশনস ল্যাঙ্গুয়েজ ফাউন্ডেশনের অনুমোদন না পাওয়ায় তা বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ বাংলাকে এই প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অবকাঠামো ও আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে। প্রযুক্তিবিদ ও ভাষাবিদদের সমন্বয়ে এখন একদল গবেষক কাজ করছেন ইউএনএল প্রযুক্তির সঙ্গে কাজ করতে পারে বাংলা ভাষার এমন একটি ব্যাকরণ ও অভিধান তৈরির। এতে সংযুক্ত হবে বাংলা ভাষায় মান ভাষার বাইরেও সাহিত্যে ব্যবহূত ভাষা, আঞ্চলিক ভাষা ও রবীন্দ্র-সাহিত্য। গবেষকেরা মনে করেন রবীন্দ্র-সাহিত্য অভিধান তৈরিতে, ভাষা নির্মাণে একটা বড় ভূমিকা রাখবে। ইতিমধ্যে ইন্টারনেটে রবীন্দ্র-সাহিত্য ইউনিকোডে রূপান্তর করা হয়েছে। এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে যোগ দিয়ে এই কাজে সংশ্লিষ্ট হয়েছে কলকাতার সোসাইটি অব ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ টেকনোলজি রিসার্চ বা এসএনএলটিআর। আশা করা যায়, দেশি-বিদেশী গবেষকদের চেষ্টায় এক বছরের মধ্যেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। অভিধান ও ব্যাকরণ তৈরির পর এই প্রযুক্তি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়ে যাবে বাংলাদেশ। এশিয়াটিক সোসাইটির পরিকল্পনা অনুযায়ী তারপরই শুরু হয়ে যাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অনুবাদ এবং তা বাজারজাত করার কাজ।
ইউএনএলের আবিষ্কার এবং এই প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্তি রাষ্ট্রিক-সামাজিক, গবেষণাসহ নানা ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ উন্মোচন করবে সন্দেহ নেই। বিশ্বের পঞ্চম ভাষা হিসেবে এর ব্যবহার হবে বহুমাত্রিক। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের বাংলাভাষী কোনো মানুষ সহজে অন্য ভাষাকে যেমন নিজের ভাষায় পড়তে পারবে, ঠিক তেমনি অন্য ভাষার মানুষও বাংলা ভাষার রসাস্বাদন করতে পারবে নিজের ভাষায়। এখন শুধু অপেক্ষা।
Source: Daily Prothom alo
তবে বাংলা ভাষার জন্য এ সুবিধা এখনো সৃষ্টি করা যায়নি। কারণ, বাংলা ভাষাকে এখনো ইউএনএলের সদস্যভুক্ত করা হয়নি। হিন্দি, উর্দুসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি ভাষা ইউএনএলের সদস্য হয়ে নিজ ভাষার মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সঙ্গে যোগাযোগ করছে; কিন্তু বাংলাদেশ এখনো এর সদস্য হওয়ার জন্য এগিয়ে আসেনি। সদস্য হওয়ার কিছু পূর্বপ্রস্তুতি আছে, যেমন ইউএনএল নির্মিত ছকে বাংলা ভাষার একটি ডিজিটাল অভিধান ও একটি ডিজিটাল শব্দকোষ নির্মাণ করা, যা কিনা এ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান করেনি। ইউএনএল পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সাল নেটওয়ার্কিং ল্যাঙ্গুয়েজ ফাউন্ডেশন, জেনেভা। বিশ্বের প্রতিটি ভাষা যেন ইউএনএলের সুবিধা নিতে পারে এবং প্রত্যেক মানুষ যেন তা অবাধে ব্যবহার করতে পারে, সে জন্য ইউএনএল সবার জন্য বিনা মূল্যে খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক যে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউএনএলের সদস্য হওয়ার জন্য এগিয়ে আসেনি। সদস্য হতে গেলে যে ডিজিটাল শর্ত পূরণ করতে হয়, তা পালন করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।
সুখের কথা, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এ উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্পের কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। ইউএনএলের সদস্য হওয়ার পূর্বশর্তে বাংলা ডিজিটাল শব্দকোষ ও অভিধান নির্মাণে একটি বড় কলাকুশলী দল কাজ শুরু করেছে। প্রকল্পটিকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহায়তা দেওয়ার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, সরকারি সাহায্য পেলে দেড়-দুই বছরের মধ্যে বাংলা ভাষাও ইউএনএলের সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করবে। তখন বাংলা ভাষার মাধ্যমে অন্যান্য ভাষার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে। বর্তমানে ইউএনএলভুক্ত ভাষার সদস্যসংখ্যা ১৬৫। কিন্তু বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ ভাষা বাংলা এখনো এর সদস্যপদ নিতে পারেনি। অর্থাৎ সদস্যপদ নেওয়ার শর্তাবলি পূরণ করতে পারেনি। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় গ্লানি বলতে হবে। কেননা, যে ভাষার জন্য মানুষ আন্দোলন করেছে, প্রাণ দিয়েছে, যে ভাষা আন্দোলনের সম্মানে একুশে ফেব্রয়ারি বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে, সে ভাষা এখনো ইউএনএলের মাধ্যমে বিশ্বভাষাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেনি, সে গ্লানি রাখার জায়গা কোথায়?
সভাপতি, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি
সালাহ্ উদ্দিন
ভাষার প্রধান বাহক মানুষ। আরও কিছু বিষয় আছে, যারা ভাষাকে বয়ে নিয়ে চলে, যেমন বই। ভাষার এই গমনাগমনে ভাষা নিজে পরিবর্তিত হয়, অপরিচিতের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। কিন্তু তার জন্য এক ভাষার মূল বক্তব্যকে অন্য ভাষায় রূপান্তরিত হতে হয়। এই কাজ করে থাকেন কোনো অনুবাদক। রাষ্ট্রীয় কোনো যোগাযোগ থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য বা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অনুবাদকের দয়ার ওপর সবাইকে নির্ভর করতে হয়। এমন যদি হয়, পৃথিবীর অন্তত ১৫০টি ভাষাকে সহজেই অনুবাদ করে ফেলা যাবে বাংলায় এবং এর জন্য অনুবাদককেও কাঠ-খড় পোড়াতে হবে না। বসে থাকতে হবে না দীর্ঘ সময়। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তা করা যাবে। কেবল একটি বোতাম চাপায় দেখা গেল মুহূর্তেই সাহিত্যে ২০১০ সালের নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক মারিয়া বার্গাস য়োসা স্প্যানিশ ভাষায় রচিত বা পর্তুগিজ ভাষায় রচিত আরেক নোবেল বিজয়ী হোসে সারামাগোর উপন্যাস খুব সহজেই রূপান্তরিত হয়ে গেল বাংলায়। এরকম কিছু স্বপ্ন বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়েই কাজ শুরু করেছিল জাপানের ‘ইউনাইটেড নেশনস ইউনিভার্সিটি’ ১৯৯৬ সালে। এখন বলা যায় ইউএনএল বা ইউনিভার্সাল নেটওয়ার্কিং ল্যাঙ্গুয়েজ প্রযুক্তির আওতায় ১৬৫টি ভাষাকে অন্য যেকোনো ভাষায় রূপান্তরের কাজ করা যাবে চোখের পলকেই। নতুন খবর হচ্ছে বাংলা ভাষাও এখন সংযুক্ত হচ্ছে এই প্রকল্পের সঙ্গে।
প্রসঙ্গ ইউএনএল
ইউএনএল বা ইউনিভার্সাল নেটওয়ার্কিং ল্যাঙ্গুয়েজ এমন একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, সংক্ষেপে যদি বলা হয়: কেবল একটি বোতাম চাপার ব্যবধানে পাল্টে দেবে এক ভাষাকে অন্য ভাষায়। তবে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা পেতে হলে প্রাথমিক শর্ত হলো অনুবাদের সুবিধা পাওয়ার আগে ওই ভাষার সম্পূর্ণ একটি অভিধান ও ব্যাকরণকে ইউনিকোডে ব্যবহারের উপযুক্ত করে তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ এমন একটি নির্দেশাবলি তৈরি করতে হবে, যা যেকোনো ভাষাকে সেই নির্দেশাবলির আওতায় ইপ্সিত ভাষায় রূপান্তরিত করতে পারবে। যে কারণে এই সেবামূলক প্রকল্পে যে প্রতিষ্ঠান তার ভাষার ব্যাকরণ ও অভিধান তৈরি করতে পারবে, তারাই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে। ইউএনের তত্ত্বাবধানে জাপান এই প্রকল্পের কাজ শুরু করে প্রায় ২০০ কম্পিউটার প্রযুক্তিবিদ ও ভাষাবিদের সমন্বয়ে।
এখান আসা যাক বাংলা ভাষার কথায়, অন্য একটি নির্দিষ্ট ভাষাকে বাংলায় রূপান্তর করতে প্রথমে ওই ফরমায়েশটি ইউএনএল প্রযুক্তিতে সরবরাহ করতে হবে। সরবরাহকৃত লেখা অনুবাদের জন্য এই প্রযুক্তি যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন, অর্থাৎ ইউএন, তাঁদের অনুমতি পেতে হবে। তাঁদের অনুমতি পাওয়ার পরই কেবল ভিন ভাষার বইটি আমাদের ভাষায় প্রয়োজনীয় অনুবাদ করা যাবে। শুরু থেকেই জাতিসংঘের আওতায় এই অনুবাদ প্রকল্পের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম বেধে দেওয়া হয়েছে। যেমন, একটি রাষ্ট্র কেবল একটি ভাষাকেই তাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ইউএনএল প্রযুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। আর এই প্রযুক্তিতে সব ভাষা অনুবাদের ক্ষেত্রে ইংরেজি হলো মান ভাষা অর্থাৎ আমি ভাত খাই রুশ ভাষার এই বাক্যটি প্রথমে অনুবাদ হবে ইংরেজিতে তারপর বাংলায়।
বাংলা ভাষার নতুন ভ্রমণ
বর্তমান ইন্টারনেটের দুনিয়ায় সারা বিশ্বই এখন হাতের মুঠোয়, কিন্তু ভাষাগত সমস্যায় অনেক সময় সহজ কাজটিও দুর্বোধ্য ঠেকে। কিন্তু বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ যদি এই ইউএনএল-এর আওতায় চলে আসে তাহলে আর্থিক লেনদেন থেকে শুরু করে কূটনৈতিক যোগাযোগ বা সাংস্কৃতিক যোগাযোগ সব ক্ষেত্রেই ইন্টারনেটের নতুন দুনিয়াকে আরও সহজ ও গতিশীল করে তুলবে।
ভারত হিন্দি ভাষার পাশাপাশি বাংলাকেও এই প্রযুক্তির আওতায় আনতে চেয়েছিল কিন্তু ইউনাইটেড নেশনস ল্যাঙ্গুয়েজ ফাউন্ডেশনের অনুমোদন না পাওয়ায় তা বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ বাংলাকে এই প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অবকাঠামো ও আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে। প্রযুক্তিবিদ ও ভাষাবিদদের সমন্বয়ে এখন একদল গবেষক কাজ করছেন ইউএনএল প্রযুক্তির সঙ্গে কাজ করতে পারে বাংলা ভাষার এমন একটি ব্যাকরণ ও অভিধান তৈরির। এতে সংযুক্ত হবে বাংলা ভাষায় মান ভাষার বাইরেও সাহিত্যে ব্যবহূত ভাষা, আঞ্চলিক ভাষা ও রবীন্দ্র-সাহিত্য। গবেষকেরা মনে করেন রবীন্দ্র-সাহিত্য অভিধান তৈরিতে, ভাষা নির্মাণে একটা বড় ভূমিকা রাখবে। ইতিমধ্যে ইন্টারনেটে রবীন্দ্র-সাহিত্য ইউনিকোডে রূপান্তর করা হয়েছে। এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে যোগ দিয়ে এই কাজে সংশ্লিষ্ট হয়েছে কলকাতার সোসাইটি অব ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ টেকনোলজি রিসার্চ বা এসএনএলটিআর। আশা করা যায়, দেশি-বিদেশী গবেষকদের চেষ্টায় এক বছরের মধ্যেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। অভিধান ও ব্যাকরণ তৈরির পর এই প্রযুক্তি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়ে যাবে বাংলাদেশ। এশিয়াটিক সোসাইটির পরিকল্পনা অনুযায়ী তারপরই শুরু হয়ে যাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অনুবাদ এবং তা বাজারজাত করার কাজ।
ইউএনএলের আবিষ্কার এবং এই প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার অন্তর্ভুক্তি রাষ্ট্রিক-সামাজিক, গবেষণাসহ নানা ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ উন্মোচন করবে সন্দেহ নেই। বিশ্বের পঞ্চম ভাষা হিসেবে এর ব্যবহার হবে বহুমাত্রিক। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের বাংলাভাষী কোনো মানুষ সহজে অন্য ভাষাকে যেমন নিজের ভাষায় পড়তে পারবে, ঠিক তেমনি অন্য ভাষার মানুষও বাংলা ভাষার রসাস্বাদন করতে পারবে নিজের ভাষায়। এখন শুধু অপেক্ষা।
Source: Daily Prothom alo
No comments:
Post a Comment