Saturday, January 22, 2011

বীজ সংরক্ষণে শতবর্ষী চয়েন বানু

বীজ সংরক্ষণে শতবর্ষী চয়েন বানু

ধান বীজসহ বিভিন্ন বীজ সংরক্ষণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণসহ গবেষণা চলছে দীর্ঘদিন। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়াই সনাতন পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ করে আসছেন বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার তালশন গ্রামের চয়েন বানু। মাটির তৈরি কুঠরীতে নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে বছরের পর বছর ধান, গম, যব, কলাইসহ যেকোনো শস্য বীজ সংরক্ষণ করেন চয়েন বানু। তার কাছে থেকে মাটির কুঠরীতে বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি শিখে বর্তমানে উপকৃত হচ্ছেন তালশনসহ আশেপাশের গ্রামের হাজার হাজার কৃষক। চয়েন বানুর মাটির তৈরি এই কুঠরিতে সব ধরনের বীজ ছাড়াও যেকোনো ধরনের খাদ্যদ্রব্যও রাখা যায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত। এলাকার একাধিক কৃষকের কাছে থেকে জানা গেছে, চয়েন বানুর প্রযুক্তিতে তৈরি করা মাটির কুঠরীতে বীজ সংরক্ষণ করলে বীজের গুণগতমান ভাল থাকে। এই পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা বীজে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ সুস্থ চারা পাওয়া যায়।

চয়েন বানু। বয়স ১০২ বছর ছুঁই ছুই করছে। এখনো দিন যাপন করছে সুস্থভাবে। কোনো বড় ধরনের রোগ-বালাই হয়নি কোনোদিন। এই বয়সেও থেমে নেই তার চলার গতি। কখনো বসে থাকেন না। বসে থাকলে নাকি শরীরে ব্যথা হয়। শারিরীক গঠন দেখে অবশ্য বয়সটা অনুমান করা কঠিন। বীজ সংরক্ষণের সুফল কুফলের মত নিজের জীবনের চলার পথে সুফল কুফল সমর্্পকে অত্যন্ত সচেতন তিনি। অলসতা তাকে যেন স্পর্শ করতে পারে না। রাতে খাবারের পরই ঘুম। ভোর রাতে উঠে তাহাজ্জদ নামাজ আদায় এবং কোরান তেলাওয়াত করেন। ঘর ঝাড়- দেয়া, থালা-বাসন মাজা, তরিতরকারি কাটা ইত্যাদি সাংসারিক কাজের পাশাপাশি গাছপালা ও জীবজন্তুর পরিচর্যা করা তার দৈনন্দিন কাজ। ছোটবেলা থেকেই তিনি ঢেঁকিতেই ধান ছাঁটেন। আজো সংসারের পুরো খোরাকির চালের জোগাড় হয় ঢেঁকিতে ছেঁটে। এছাড়া যাঁতায় গম পিষে আটা তৈরি করেন খাবারের জন্য।

চয়েন বানু বীজ সংরক্ষণের নিরপদ ব্যবস্থা মাটির তৈরি এই কুঠরী সম্পর্কে বলেন, মাটির কুঠরী তৈরি করা শিখেছেন তার মায়ের কাছ থেকে। এ কুঠরী তৈরি করতে তেমন কোনো খরচ নেই। প্রয়োজন শুধু পরিশ্রম আর কৌশলের। কুঠরী তৈরির উত্তম সময় হল কার্তিক থেকে অগ্রাহায়ণ মাস পর্যন্ত। প্রথমে কালো দো-অাঁশ মাটি ভিজিয়ে শোধন করে নিতে হয় টুথপেস্টের মত। তারপর সেই মাটির সাথে খড়ের কুচি, ধানের চিটা এবং সামান্য পরিমাণ তুষ মিশিয়ে নিতে হয়। এরপর প্রথমে কুঠরীর তলদেশ তৈরি করতে হয়। তলদেশ তৈরির পর কমপক্ষে ৩ দিন রোদে শুকাতে হয়। পরবর্তীতে কুপের পাটার মত করে ৩ থেকে ৪ দিন পর পর পাটা তৈরি করে একটির পর আর একটি বসাতে হয়। অবশেষে মুখের দিকে সরু করে আনতে হয় এবং মাপ মত ঢাকনা তৈরি করতে হয়। কুঠরী বিভিন্ন আকৃতির বানানো যায়। ছোট, মাঝারী ও বড় চৌকোনা। বীজ সংরক্ষণ ছাড়া ও বড় আকৃতির একটি কুঠরীতে ৩০ থেকে ৪০ মণ চাল রাখা যায়। তিনি জানান, এই পদ্ধতি তৈরি করা কুঠীরতে সাধারণত বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। এ কারণে দীর্ঘদিন বীজ রাখলে বীজের কোনো ক্ষতি হয় না।

আগের দিনে অধিকাংশ মানুষ কাঁচা বাড়ি অর্থাৎ খড়ের ছাউনি দেয়া ঘরেই বেশি বাস করত। ওই সকল খড়ের ঘরে আগুন লাগার সম্ভাবনা থাকত বেশি। সে কারণে তখনকার দিনে মাটির কুঠরীর বেশ কদর ছিল। কারণ ঘড় পুড়ে গেলেও কুঠরীর মধ্যে রাখা জিনিসের কোনো ক্ষতি হত না। চয়েন বানু জোর দিয়ে বলেন, বর্তমানে ধান-চাল রাখার জন্য বিভিন্ন আধুনিক ব্যবস্থা হওয়ায় মাটির কুঠরীর কদর কমে গেলেও বীজ সংরক্ষণের এর বিকল্প নেই বলে আমার মনে হয়।

চয়েন বানু আরো বলেন, শুধুমাত্র কুঠরীতে বীজ রাখলেই ভাল বীজ পাওয়া যায় না। বীজ সংরক্ষণের জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। ভাল বীজ না হলে ভাল ফসল পাওয়া যায় না। প্রথমে পুষ্ট ও দানাদার বীজ বেছে নিতে হয়, খেয়াল রাখতে হয় বীজ যেন ভেজা না হয়। এ কারণে কুঠরীতে রাখার আগে সব ধরনের বীজ ভালভাবে শুকিয়ে নিতে হয়। বীজে যেন পোকা না থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়।

উপজেলার জিনইর গ্রামের কৃষক মেহেদী হাসান জানান, চয়েন বানুর সংরক্ষণ করা ধান বীজ ব্যবহার করে তিনি আশাতীত ফলন পেয়েছেন। তিনি নিজেও চয়েন বানুর তৈরি করা কুঠরীর মত করে কুঠরী তৈরি করে বীজ সংরক্ষণ করছেন। তালশন গ্রামের আরেক কৃষক নুর ইসলাম বলেন, শীত মৌসুমে ইরি-বোরো ধানের বীজ থেকে বেশি ভাগ সময় চারা তৈরি কঠিন হয় কিন্তু চয়েন বানুর কুঠরী পদ্ধতিতে ধান সংরক্ষণ করলে এ সমস্যা থাকে না।

আদমদীঘি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রওশন জামাল বলেন, চয়েন বানু যে পদ্ধতি ব্যবহার করে বীজ সংরক্ষণ করছেন তা সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত। তিনি যে পাত্রে বীজ রাখেন তা বায়ু প্রতিরোধক হওয়ার কারণে তার পাত্রের বীজ নষ্ট হয় না। তার এ পদ্ধতি অনুসরণ করে আশপাশ গ্রামের আরো অনেক কৃষক উপকৃত হচ্ছে। ফলে চয়েন বানুর এ উদ্যোগকে উৎসাহিত করার ব্যাপারে সব ধরনের সহয়তাও দেয়া হবে।

-এস. এম. নাজমুল হক ইমন, বগুড়া
Source: Daily Ittefaq

No comments:

Post a Comment