Tuesday, January 4, 2011

প্রজাপতি সখা

প্রজাপতি সখা
জাবির প্রাঙ্গণে নির্ভয়ে ডানা মেলেছে বাহারি প্রজাপতি ছবি_মোহাম্মদ আসাদ, ড. মনোয়ার হোসেন

প্রজাপতির রঙিন পাখার পেছনে ছুটে শৈশব কেটেছে সবারই। তাই বলে বড় হয়েও দিনরাত প্রজাপতির পেছনে ছোটাছুটি! অবশ্য সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নয়, গবেষণার জন্যই প্রজাপতির পেছনে ছুটে চলছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন। গত বছরের শেষ দিকে তাঁর নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হয়েছিল প্রজাপতির মেলা। প্রজাপতিপ্রেমী এ গবেষকের গল্প শোনাচ্ছেন সমুদ্র সৈকত

'উড়লে আকাশে প্রজাপতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি' এই স্লোগান ছিল সবার মুখে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ঊ ক্যাম্পাসের জহির রায়হান অডিটরিয়ামের সামনে ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে জাল দিয়ে ঘেরা 'প্রজাপতি ঘরে' শতাধিক প্রজাতির শত শত প্রজাপতি দেখেন দর্শনার্থীরা। 'পরিবেশের জন্য প্রজাপতির উপকারিতা তুলে ধরা এবং তা সংরক্ষণে জনগণকে সচেতন করতেই এ মেলা', জানালেন ড. মনোয়ার হোসেন।
১৯৯৬ সালে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ঢোকার পর থেকেই প্রজাপতি নিয়ে মেতে আছেন মনোয়ার হোসেন। চারটি নতুন প্রজাতির প্রজাপতি আবিষ্কার করেছেন তিনি। এত কিছু থাকতে এই চপলমতি পতঙ্গের পেছনে কেন? 'জাপান ও চীনের একদল গবেষক সোলার প্ল্যান্টে প্রজাপতির পাখার উপাদান ব্যবহার করে প্রচলিত সোলার প্যানেলের চেয়ে ১০ গুণ বেশি শক্তিশালী প্যানেল তৈরি করেছেন। তাই প্রজাপতির কাছ থেকে তথ্য নিয়ে দেশে সৌরশক্তির বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।'
'বাটারফ্লাই কালার ভিশন'-এর ওপর প্রি ডক্টোরাল ফেলোশিপ করেছেন ড. মনোয়ার হোসেন। পিএইচডি করেছেন মলিকুলার ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি বিষয়ে। 'বাটারফ্লাই কালার ভিশন' সম্পর্কে বললেন, 'মানুষের কোনো কিছু দেখার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে রং। চোখ দিয়ে দেখার পর মস্তিষ্ক কিভাবে বিশ্লেষণ করে তা আজও অজানা। প্রজাপতির ক্ষেত্রে এ রহস্য অনেকখানি উন্মোচিত হয়েছে। মানুষের চোখ মৌলিক তিনটি রং লাল, সবুজ ও নীল শনাক্ত করতে পারে। অন্যদিকে 'ওমাটিডিয়াম' নামের প্রজাপতির যৌগিক চোখ ধরতে পারে সাতটি রং। তাই প্রজাপতির দৃষ্টি রহস্য পুরোটা ভেদ করতে বিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লেগেছেন। কারণ প্রজাপতির মস্তিষ্কের লেমিনার মনোপোলার অংশের সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্কের বাইপোলার সেলের সাদৃশ্য আছে। প্রজাপতি কিভাবে দেখে তা জানা গেলে সে বিজ্ঞান মানুষের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। তখন তুড়ি মেরে ঠিক করা যাবে চোখের নানান রোগ। জানা যাবে মানুষের রং পছন্দ-অপছন্দের কারণও। আর তা প্রয়োগ করা যাবে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে।' বুঝুন এবার, প্রজাপতি কি কেবল কবিতার বিষয়!
এ সব কারণে প্রজাপতি সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য ড. মনোয়ার তাঁর শিক্ষার্থীদের নিয়ে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়াচ্ছেন বনে-জঙ্গলে। কোন প্রজাতির প্রজাপতি কোন গাছে বাস করে, কোন গাছের পাতা কিংবা কোন ফুলের মধু বেশি খায় তা নিশ্চিত করতে খাটছেন নিরলসভাবে। ড. মনোয়ার জানালেন, 'ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে মাঝে মাঝেই প্রজাপতির পিছু নেই। ডোবা পুকুরের কোমর জলে নেমেও ছবি তুলেছি। বৃষ্টির জলেও ভিজেছে সাধের ক্যামেরাটা। তবে নতুন প্রজাপতির দেখা পাওয়া মাত্রই যেন ভুলে গেছি হাড়ভাঙ্গা খাটুনির কথা।' প্রজাপতির গবেষণার জন্য ফটোগ্রাফি খুবই জরুরি। এতে প্রজাপতির পছন্দের গাছেরও ছবি পাওয়া যায়। প্রজাপতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত গাছগুলো শনাক্ত করতে পারলে তাদের সংরক্ষণের পথটা অনেকটাই সহজ হয়ে আসবে। ওই বিশেষ গাছগুলো বেশি করে লাগিয়ে প্রজাপতির আবাস সুনিশ্চিত করা যাবে।
ফুলের পরাগায়ন ঘটাতে মৌমাছির পরেই প্রজাপতির অবস্থান। আর পরাগায়ন না ঘটলে বীজ, ফল আর উদ্ভিদের অভাবে মারা যাবে সবাই। প্রজাপতির লার্ভা খেয়ে গিরগিটি, পিঁপড়া, মাকড়শাসহ অন্যান্য প্রাণী বেঁচে থাকে। বাস্তুসংস্থান টিকিয়ে রাখতে প্রজাপতির অবদান তাই অসামান্য। অনেক ক্ষতিকর পোকামাকড়ও খায় এ পতঙ্গ।
প্রজাপতির বাণিজ্যও কিন্তু মন্দ নয়। অনেক দেশেই প্রজাপতির বড় বড় খামার আছে। ড. মনোয়ার হোসেন জানালেন, 'বছরে বিশ্বে ২ থেকে ৩ কোটি ডলারের প্রজাপতি বিকিকিনি হয়। তবে এর বেশির ভাগই বিজ্ঞানীদের গবেষণা ও জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য।' তাই দেশে অর্থনীতির পাল্লা ভারী করতে বাণিজ্যিকভাবে প্রজাপতির চাষ করা যেতে পারে বলে মনে করেন এই গবেষক।
প্রজাপতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার জন্য ড. মনোয়ার হোসেন নিজ বিভাগে প্রতিষ্ঠা করেছেন 'অ্যান্টোমলজি ল্যাব'। বেশির ভাগ সময় সেখানেই কাটান। প্রজাপতি নিয়ে গবেষণার জন্য ইনকিউবেটর থেকে শুরু করে শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ, হাই সেন্সেটিভ রেফ্রিজারেটর, সেন্ট্রিফিউজ মেশিন, রিয়ার-ইন কেইজ, ইনসেক্ট সুইপিং নেট, কিলিং জার; সবই আছে সেই গবেষণাগারে। কীটতত্ত্ববিদ ড. মনোয়ার জানালেন, নতুন প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্ত করতে কিংবা উচ্চতর গবেষণার জন্য প্রথমে সুইপিং নেট দিয়ে প্রজাপতিটি সংগ্রহ করতে হয়। এরপর ওটাকে ল্যাবের পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুট জাল দিয়ে ঘেরা বিশেষ ঘরে (রিয়ার-ইন কেইজ) রাখা হয়। সেখানে আগে থেকেই প্রজাপতির পছন্দ অনুযায়ী গাছ রাখতে হয়।
প্রজাপতির গড় আয়ু দুই থেকে পাঁচ সপ্তাহ। তবে দু'একটি প্রজাতি এক বছরও বাঁচে। পরিবেশের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও দিনের দৈর্ঘ্যের ওপর এর আয়ু নির্ভর করে। প্লেন টাইগার প্রজাপতি গড়ে ২৮ দিন বাঁচে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্ত্রী ও পুরুষ প্রজাপতি মিলিত হয়। এরা ডিম পাড়ে গাছের পাতায়। ডিম থেকে লার্ভা বের হতে লাগে এক-দুই দিন। প্রাকৃতিকভাবে না ফুটলে ইনকিউবেটরে ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ডিম ফুটান গবেষকরা। প্রাকৃতিকভাবে ডিম থেকে লার্ভা তৈরির হার ১০ শতাংশ হলেও গবেষণাগারে তা ৩৫ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে। এরপর শুরু হয় প্রজাপতির পিউপা দশা। মনোয়ার হোসেন জানালেন, 'গবেষণার প্রয়োজনে পিউপা অবস্থায় প্রজাপতিকে রেফ্রিজারেটরে মাইনাস ১০ থেকে মাইনাস ১৫ ডিগ্রিতে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।' এরপর ওই পিউপা পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতিতে পরিণত হয়। এভাবে উৎপন্ন প্রজাপতি নিয়ে পরে গবেষকরা বিভিন্ন গবেষণা করে থাকেন। 'ড্রাই প্রিজারভেশন' নামের একটি কৌশলে মৃত প্রজাপতি সংরক্ষণ করেন গবেষকরা। 'বাটারফ্লাই প্রিজারভেশন ক্যাবিনেট'-এ সংরক্ষিত প্রজাপতিগুলো নিয়েই বেশির ভাগ গবেষণা হয়।
প্রজাপতি ছোট পতঙ্গ হলেও এর গবেষণার খরচ প্রচুর। তাই প্রজাপতি নিয়ে উন্নত গবেষণার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা বেসরকারি উদ্যোগের বিকল্প নেই বলে মনে করেন প্রজাপতি অন্তঃপ্রাণ ড. মনোয়ার হোসেন।

দেশে প্রজাপতি নিয়ে প্রথম গবেষণা শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহমুদুল আমিন ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শফিক হায়দার চৌধুরী ২৭ প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্ত করেন। ১৯৮৩-৮৫ সালে চট্টগ্রামের ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক এম এ ওয়াহিদ, বক্শ চৌধুরী ও জে এইচ চৌধুরী দেশের বিভিন্ন বনে-জঙ্গলে আরো ৩৩টি প্রজাতি চিহ্নিত করেন। ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ের ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় গবেষণা চালিয়ে ২১ প্রজাতির সন্ধান পান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম এস আলম ও জি এম উল্লাহ।
এরপর ১৯৯৬ সালে ড. ইসমাইল হোসেন, ড. শফিক হায়দার ও সহযোগী অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন গবেষণা চালিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫১ প্রজাতির প্রজাপতির সন্ধান পান। এর মধ্যে নতুন প্রজাতি ২১টি। ২০০৩ সালে ড. মনোয়ারের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থী এম এ রাজ্জাক গবেষণা করে আরো ৩৯ প্রজাতি চিহ্নিত করেন, যার মধ্যে ৩৬টিই নতুন! ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এ বাশার সারা দেশে ১৬৭ প্রজাতি শনাক্ত করতে সক্ষম হন। সর্বশেষ ২০১০ সালে ড. মনোয়ার হোসেন যে চারটি প্রজাতি শনাক্ত করেন সেগুলো হলো_স্ট্রাইপেড পাইরোট, মাংকি পাজল, ব্লু প্যানসি ও পেইন্টেড লেডি।
Source: Dailykalerkantho

No comments:

Post a Comment