
সাফল্য : মূলধনবিহীন চেতারার হস্তশিল্প
রহিমা আক্তার
রহিমা আক্তার
জগতের যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন তা সম্ভব হয়েছে প্রতিভার কল্যাণে। নারীরা তাদের বুদ্ধি ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে সমাজে তাদের অবস্থান তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ করে তাদের ছোট করে রাখা হচ্ছে। সভ্যতার চরম উত্কর্ষের কালেও নারী তার সাধারণ মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে কোনো সভ্য সমাজে নারীর অবস্থান অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। আজ শুধু গৃহ সংরক্ষণ ও সন্তান পরিচর্যাই নারীদের একমাত্র দায়িত্ব নয়। তারা পুরুষের মতো সৃষ্টিশীল ও উন্নয়নমূলক কাজ করতে সক্ষম। নারীরা তাদের বুদ্ধি আর আত্মবিশ্বাস দিয়ে তৈরি করছে অনেক অভাবনীয় জিনিসপত্র। আজকের এই নারীর দক্ষতার মধ্যে রয়েছে আলাদা এক বৈচিত্র্য।চেতারা বেগম নোয়াখালীর গ্রামের এক গৃহবধূ, সংসার জীবনে প্রবেশের পর থেকেই ছোটখাটো কুটির শিল্পের কাজ করতেন। এতে করে নিজের পারিবারিক জিনিসগুলোর চাহিদা মিটত এবং তার হাতে কিছু নগদ টাকা আসত। তার শিল্পের সঙ্গে ছিল নকশি শীতলপাটি, হাতপাখা (বাঁশের, কাপড়ের)। চার সন্তানের জননী চেতারা বেগম সন্তানদের দায়িত্ব পালনের অবসরে এসব কাজ করতেন। গ্রামের দৃশ্য গাছপালা ও ফুলের নকশা করতেন শীতলপাটি ও হাতপাখার মাঝে। গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে বন্ধ হয়ে যায় তার কুটির শিল্পের কাজ। অবসর সময় তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেত। সময়কে কাজে লাগানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন তিনি। তখনি একদিন টিভির একটা অনুষ্ঠানে শুনতে পান, কাগজকে ভাতের মাড়ের সঙ্গে ভিজিয়ে রাখলে তাতে মণ্ড তৈরি হয়। এই কৌশলটা তিনি আয়ত্ত করেন। প্রথমে ছোট ছোট বাটি-ঝাঁকা তৈরি করেন। ২/১টা জিনিস তৈরি করার পর আগ্রহ বেড়ে যায়। এরপর আস্তে আস্তে তিনি কীভাবে কী তৈরি করা যায় তার কৌশল খুঁজতে থাকেন। আমাদের গৃহের ব্যবহারের উপযোগী কিছু আসবাবপত্র তৈরি করতে চেষ্টা করেন। রান্নাঘরের সবজি ও শুকনো জিনিস রাখার জন্য এই মণ্ড দিয়ে রেক তৈরি করেন। পানির ফিলটার রাখার স্ট্যান্ড তৈরি করেন। ফুলদানি ও বড় বড় ঝাঁকা তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে ভাবেন কীভাবে আরও নতুন নতুন আসবাবপত্র তৈরি করা যায়। একে একে তিনি চেয়ার-টেবিল বানানোর উদ্যোগ নেন এবং সেভাবে ট্রি টেবিল-চেয়ার, টিভির ট্রলি, চাল রাখার বক্স, ট্রাঙ্ক ধরনের বক্স ইত্যাদি তৈরি করেন। বসার জন্য বিভিন্ন আকারের মোড়া বানান। এগুলো শুধু শো-পিস হিসেবে নয়, আমাদের কাঠের তৈরি আসবাবপত্রের মতো ব্যবহারও করা হয়। চেতারা বেগম জানান, গ্রামে গৃহবধূ থাকাকালে কাজের ফাঁকে বাঁশ, বেত ও সুতার কাজ করতে ভালো লাগত। গ্রামের মেয়েদের বিয়ের সময় এগুলোর প্রয়োজন হতো। তখন ওরা এগুলো কিনতে আসত। তখন শিতলপাটি, নামাজের বিছানা, কাপড়ের হাতপাখার খুব কদর ছিল। সর্বপ্রথম ১ জোড়া কাপড়ের নকশা করা হাতপাখা ২০ টাকায় বিক্রি করি। শেষের দিকে এক জোড়া ১২০ টাকাও বিক্রি করেছি। নিখুঁত কাজের ওপর দাম দেয়া হতো। সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় গ্রাম ছেড়ে শহরে আসি। শহরের সাংসারিক কাজ শেষে অবসর সময় কাটানো যায় না। বই পড়া আর টিভি দেখা ছাড়া কোনো কাজ নেই। শহরের বৈদ্যুতিক পাখার জায়গায় হাতপাখার খুব একটা প্রয়োজন হতো না। তারপরও নিজের ব্যবহারের জন্য তৈরি করেছি। একদিন টিভিতে পেপার ও ভাতের মাড়ের সাহায্যে শো-পিস তৈরির কথা শুনি। এরপর এটাকে কাজে লাগাই। প্রথমে ছোট কিছু তৈরি করতে পারাতে আগ্রহ বাড়ে। জিনিসগুলো দেখতে ভালো এবং মজবুত হয়। কীভাবে মণ্ড তৈরি করেন জানতে চাইলে বলেন, ভাতের মাড়ের মাঝে দুই দিন পেপার বা অপ্রয়োজনীয় কাগজগুলো ভিজিয়ে রাখি। দুই দিন পর এগুলোকে চিপে শিলের (পাটার শিল) সাহায্যে থেঁতলে নরম করে আটার মতো করি। এরপর ইচ্ছামত ডিজাইন করি মাটির তৈরি জিনিসগুলোর মতো। মাটির তৈরি জিনিসগুলো ভেঙে যায়, কিন্তু এগুলোকে হাতের সাহায্যে টিপে টিপে শক্ত করে রোদে শুকালে অনেক মজবুত হয়। যত বেশি রোদে দেয়া যায়, এগুলো শুকিয়ে তত হালকা হয়। তবে বড় কিছু তৈরি করতে বেশি কাগজের প্রয়োজন হয় বলে মাঝে মাঝে ভেতরে ছোট ছোট জর্দার কৌটা ব্যবহার করেছি। শুকিয়ে এলে ভাতের মাড়ের সাহায্যে সাদা কাগজ লাগিয়ে তার ওপর বিভিন্ন রং দিয়ে ডিজাইন করে থাকি। এই কাগজের তৈরি আসবাবপত্র আমি দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করছি। চেয়ার-টেবিলে দাঁড়ানো বা বসা যায়, মোড়াগুলো যে কোনো কাজে ব্যবহার করা যায়। এগুলোকে একমাত্র পানি থেকে দূরে রাখতে হয়। আসল কথা হলো, এই কাজে কোনো টাকার প্রয়োজন হয় না। শুধু শারীরিক পরিশ্রম ও ফেলে দেয়া জিনিস দিয়ে এগুলো তৈরি করা সম্ভব। এই শিল্প জনপ্রিয়তা পাবে। নিখুঁত হাতে তৈরি করলে এর মাধ্যমে নতুনত্বের ছোঁয়া আসতে পারে।চেতারা বেগম আরও বলেন, এখনও আমাদের দেশে অনেক নারী-পুরুষ আছেন যারা পুঁজির অভাবে কাজ খুঁজে পান না। তবে ধৈর্য ও নিখুঁত হাতের ব্যবহার করলে কাগজের তৈরি এই শিল্প জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। কাঠ, বেত ও স্টিলের আসবাবপত্রের সঙ্গে এই শিল্প একদিন ভালো একটা জায়গা দখল করবে, এটাই প্রত্যাশা চেতারা বেগমের।
No comments:
Post a Comment