Wednesday, November 3, 2010

ধৈঞ্চার অাঁশ :কৃষি অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা

ধৈঞ্চার অাঁশ :কৃষি অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা

ইঞ্জিনিয়ার মশিউর রহমান স্বপন

ধৈঞ্চার অাঁশ টেক্সটাইল জগতে একটি নতুন ফাইবার। চাষাবাদ থেকে শুরু করে উৎপাদন ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ধৈঞ্চার গুরুত্ব বাংলাদেশের সোনালি অাঁশের প্রায় কাছাকাছি। ধৈঞ্চা অাঁশের বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ, প্রায়োগিক দিকে পাট ও ধৈঞ্চা সমমাত্রিক গুরুত্ব ধারণ করে আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রয়েছে পিছিয়ে। বাংলাদেশে পাট অর্থকরী ফসল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করলেও ধৈঞ্চা অাঁশের ব্যবহার এখন পর্যন্ত প্রায় শূন্যের কোঠায়। ধৈঞ্চার অফুরন্ত সম্ভাবনা আমাদের নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে থাকলেও শুধু ব্যবহারগত দিকটির অজ্ঞতার কারণে এই বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যায়নি। ফলে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে কোটি কোটি টাকার অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে।

পরিবেশবান্ধব অাঁশ হিসেবে নেচারাল ফাইবারের গুরুত্ব বিশ্বে বৃদ্ধি পাচ্ছে। টেক্সটাইলের ভাষায়- টেক্সটাইল বা সুতা তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে যে তন্তু বা অাঁশ ব্যবহূত হয় সেগুলোকে টেক্সটাইল ফাইবার বলে। টেক্সটাইলের দু' ধরনের ফাইবারের মধ্যে পাট, ধৈঞ্চা, তুলা হল নেচারাল টেক্সটাইল ফাইবার। টেক্সটাইল ফাইবারের বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী রয়েছে। পাট ও তুলা সারা বিশ্বে বহুল ব্যবহূত উন্নতমানের ফাইবার। দেশে এখন পর্যন্ত পাটের বিকল্প কোনো ফাইবার পাওয়া যায়নি। এমতাবস্থায় যদি পাটের বিকল্প বা আংশিক বিকল্প হিসেবে ধৈঞ্চার অাঁশকে কাজে লাগানো যায় তবে তা হবে বাংলাদেশ তথা সারা টেক্সটাইল জগতের জন্য আশীর্বাদ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে সহজে ও সব জায়গায় আবাদ করতে পারে ধৈঞ্চা যা পাটের বিকল্প হতে পারে।

ধৈঞ্চার বোটানিক্যাল এনালাইসিস করলে অবাক হতে হয় যে, ধৈঞ্চা গাছের শিকড় থেকে শুরু করে বাঁকল, কাণ্ড, ডাল, পাতা ও বীজ সমস্ত অংশই আমাদের পারিবারিক ও অর্থনৈতিক জীবনে কার্যকরী ব্যবহারিক ও অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে যে, শুধুমাত্র ছাল বা বাঁকলের অংশ থেকে অাঁশ বের করার প্রক্রিয়া বা জাগ দেওয়ার জ্ঞানের অভাবে মূল্যবান অাঁশ প্রাপ্তি থেকে এ ক্ষেত্রটি বঞ্চিত হচ্ছে। গুণেমানে পাটের মত অাঁশ পাওয়া না গেলেও পরিমাণগত ও ব্যবহারগত দিক থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থনৈতিক সুবিধা নেওয়া সম্ভব। পাট ও বস্ত্র ক্ষেত্রের একজন প্রকৌশলী ও ধৈঞ্চা অাঁশের নবীন গবেষক হিসেবে গবেষণালব্ধ ও পরীক্ষণীয় কিছু বিষয় উপস্থাপন করছি:

একক গাছ হিসেবে পাট ও ধৈঞ্চার তুলনামূলক ফলন ও ব্যবহার: ১. ধৈঞ্চা গাছের শেকড়ে ছোট ছোট অংখ্য গুটি হয় তা থেকে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন সার পাওয়া যায়। পাটে কোনো গুটি হয় না। ২. ধৈঞ্চা গাছের কাণ্ড শক্ত ও আকারে বড়, উৎকৃষ্ট মানের জ্বালানি; বেড়া বা খুঁটি হয়; গৃহস্থালী কাজে ব্যবহূত হয়; কৃষিতে ও সবজির মাচান হিসেবে ব্যবহূত হয়। পাটের ক্ষেত্রে কাণ্ড হয় নরম ও আকারে ছোট; উৎকৃষ্ট মানের জ্বালানি হয়; বেড়া হয়; গৃহস্থালী কাজে ব্যবহূত হয়; কৃষি কাজের অনেক ক্ষেত্রে লাগে। ৩. ধৈঞ্চা গাছের বাঁকলে অাঁশ পাওয়া সম্ভব যার বর্তমানে অর্থকরী কোনো মূল্য নেই, জাগ দেওয়া বা পচনের মাধ্যমে অাঁশ পাওয়া যায়, অাঁশের রঙ রূপালি। পাটের ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন বেশি অাঁশ পাওয়া যায়, অর্থকরী মূল্য আছে; জাগ দেওয়া বা পচনের মাধ্যমে অাঁশ পাওয়া যায়; অাঁশের রঙ সোনালি। ৪. ধৈঞ্চা গাছের ডাল পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হয়। ৫. ধৈঞ্চা গাছের পাতায় প্রচুর সবুজ সার পাওয়া যায়, ফলন হেক্টরপ্রতি ১০ থেকে ২০ টন। পাটের ক্ষেত্রে সবুজ সারের পারিমাণ খুবই কম। ৬. ধৈঞ্চা গাছের বীজে প্রচুর আমিষ থাকে ও পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হয়। ফলন হেক্টরপ্রতি ২ টন। পাটের ক্ষেত্রে ফলন অনেক কম।

এ থেকে বোঝা যায় যে, ধৈঞ্চার তুলনায় পাটের ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন বেশি অাঁশ প্রাপ্তি ছাড়া অন্য সব অংশই ধৈঞ্চার অর্থনৈতিক মূল্যমান, প্রায়োগিক সুবিধা বেশি। তবে অাঁশের মানের দিকটির উন্নয়ন ঘটানো গেলে ধৈঞ্চা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং টেক্সটাইল খাত হবে সমৃদ্ধ।

ধৈঞ্চা ও পাট এক প্রকার নেচারাল বাস্ট ফাইবার। পাটের মতই গাছের বাঁকল বা ছালের মধ্যে পচন বা জাগ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় পাওয়া যায়। ধৈঞ্চা শিম বা মটর জাতীয় ফসল। আমাদের দেশে দুই প্রকারের ধৈঞ্চা পাওয়া (ক) স্থানীয় ধৈঞ্চা যার বোটানিক্যাল নাম- ংঁংনবহরধ ধপঁষবধঃধ। এর শিকড়ে রাইজোবিয়াম গুটিকা (বীজানো) থাকে। (খ) আফ্রিকান ধৈঞ্চা যার বোটানিক্যাল নাম- ংঁংনবহরধ ৎড়ংঃৎধঃধ। এর শিকড়ে ও কাণ্ডে রাইজোবিয়াম গুটিকা (বীজাণু) থাকে, যা থেকে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন সার পাওয়া যায়, যা হেক্টরপ্রতি ১৮০ থেকে ২৫০ কেজি ইউরিয়া সারের সমপরিমাণ উপকার পাওয়া।

ভৌত ও রাসায়নিক বিশেস্নষণে ধৈঞ্চা ও পাটের অাঁশের তুলনা:

ধৈঞ্চার যে বৈশিষ্ট্য এবং ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ পাটের তুলনায় উন্নতমানের সেগুলো হল: ফাইবারের দৈর্ঘ্য, আনবিক বিন্যাস, শক্তি দৃঢ়তা অনমনীয়তা, স্থায়ীত্ব পস্নাস্টিসিটি, তাপীয় প্রতিক্রিয়া, ঘর্ষণ প্রতিরোধ ক্ষমতা, উজ্জ্বলতা, পরিছন্নতা, সহজে ধাহ্য ট্রাস কন্টেন্ট, ছত্রাক প্রতিরোধ ক্ষমতা, ময়লা প্রতিরোধ ক্ষমতা ও আলোর প্রতিফলন।

ধৈঞ্চার যে বৈশিষ্ট্য পাটের তুলনায় নিম্নমানের সেগুলো হল: পৃষ্টদেশীয় অবস্থা, মূলায়েম ক্রিম্প, টেনাসিটি, সংশক্তি প্রবণতা, অনমনীয়তা, প্রসারণ ক্ষমতা, অ্যাবজরবেঞ্চি, আর্দ্রতা ধারণ ক্ষমতা, সংকোচন ক্ষমতা, পরিধেয় গুণ, রিজেলিয়েন্সি স্পর্শ অনুভূতি, শোষন ক্ষমতা ও পাকানোর ক্ষমতা।

ধৈঞ্চা অাঁশের যে গুণাবলী আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে সেগুলো হল: অাঁশের দৈর্ঘ্য, অাঁশের ব্যাস, ফাইননেস, অাঁশের শক্তি, টেনাসিটি, ইলাস্টিসিটি, প্রসারণ, সংকোচন, ড্রাপাবিলিটি, হাইগ্রোসকোপিক নেচার, কেমিক্যাল কম্পোজিশন, তড়িৎ ও তাপীয় আচরণ, ডাই-ফাস্টনেস, এসিড ও এ্যালক্যালি উপর প্রতিক্রিয়া ডিগ্রি অব ডিকম্পোজিশন, ইত্যাদি।

যে যে ক্ষেত্রে ধৈঞ্চা অাঁশ ব্যবহূত হতে পারে: ১. যে যে ক্ষেত্রে পাট ব্যবহূত হয় সেখানে পাটের সহায়ক, মিক্সিং বা বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব; ২. দড়ি, কাছি, সুতলি বা ঘরের কাজে; ৩. কৃষি কাজে বা সবজি চাষে; ৪. জিও-ধৈঞ্চা হিসেবে, জিও জুটের বিকল্প হিসেবে ও অন্যান্য গবেষণালব্ধ ক্ষেত্রে।

ধৈঞ্চা অাঁশ বৈশিষ্ট্যে গুণে ও মানে এখন পর্যন্ত পিছিয়ে আছে। যদি ধৈঞ্চা গাছের বাঁকলে অাঁশের পরিমাণ ও মান বৃদ্ধি করা যায় তবে সহজেই এই অাঁশ পাটের মতই অফুরন্ত সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে। তার জন্য প্রয়োজন বর্তমান সময়ের বিষ্ময় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা প্রয়োগ করে পাটের জিনের ডি.এন.এ. ধৈঞ্চায় প্রয়োগ করে আরো ভাল অাঁশের সুফল পাওয়া সম্ভব। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জিনঘঠিত অগ্রগতি সাধিত করেছেন। কাজেই ধৈঞ্চার অাঁশের ক্ষেত্রেও এর উন্নয়ন ঘটবে বলে আশা করি। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, কৃষি ও পাট গবেষণাকেন্দ্রসহ সংশিস্নষ্ট গবেষণা কেন্দ্রগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে দরকার জনগণের সম্পৃক্ততা।

লেখক: পাট ও বস্ত্র প্রকৌশলী, গবেষক ও লেখক, ফরিদপুর

No comments:

Post a Comment