Thursday, October 7, 2010

সোনার বাংলা

সোনার বাংলা

হাসনাত আবদুল হাই

সোনার বাংলা অভিধাটি যে এসেছে সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা গ্রামবাংলার রূপের কথা ভেবেই অথবা বাস্তবে দেখে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। উর্বর মাটি, অনুকূল আবহাওয়া বিশেষ করে সময়োপযোগী বৃষ্টি এবং কৃষকের নিরলস প্রচেষ্টা গ্রামবাংলার অর্থনীতিকে সচল রেখেছে অতীতে। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার না হলেও সনাতন পদ্ধতিতে চাষবাস করেই সোনা ফলানো গিয়েছে মাঠে যার জন্য সোনার বাংলা শুধু কথার কথা হয়ে থাকেনি। কিন্তু শুধু সোনা ফলালেই তো হবে না, তা চাহিদা মেটাতেও প্রতুল হতে হবে। যতদিন জনসংখ্যার বৃদ্ধি ছিল ধীর আর সীমিত তখন সোনার বাংলার ইমেজ নিয়ে সংশয় দেখা দেয়নি। সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি দ্রুত হওয়ার সঙ্গে কৃষিখাতে উৎপাদনের পিছিয়ে থাকার কারণে। দৈব আশীর্বাদের মত তখন জমিতে এসেছিল সবুজ বিপস্নবের কৌশল। উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার আর যন্ত্রচালিত মেশিন দিয়ে পানি সেচ দেয়ার প্রযুক্তি ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে খাদ্যশস্যে স্বয়ম্বরতার দিকে নিয়ে গিয়েছে। খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়েছে কিন্তু এর পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।

খাদ্যশস্যের পাশাপাশি গোল্ডেন ফাইবার বা সোনালী আঁশ বলে খ্যাত পাটেরও চাষ সন্তোষজনক থেকেছে, যার ফলে রফতানি বেড়েছে এবং দেশে পাটজাত পণ্য উৎপাদনের জন্য শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। এক সময় দেখা গেল বছরে তিনবার ধান চাষ এবং পাট চাষের ওপর গুরুত্ব আরোপের ফলে অন্যান্য শস্যের চাষ ব্যাহত হচ্ছে তখন পণ্য উৎপাদন বহুমুখী করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আলু, সরিষা, শাক-সবজি চাষের প্রতি মনোযোগ দেয়ার জন্য উৎসাহ দিয়েছে সরকার।

কৃষিখাতই বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হয়েছিল এবং এখনো আছে, যদিও মোট জাতীয় আয়ে এই খাতের অবদান অন্যান্য খাতের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। ভবিষ্যতেও কৃষিখাতেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান উৎস হয়ে থাকবে একথা বলা যায়। এই খাতের সমস্যা তাই গুরুত্বের সঙ্গে সমাধানের প্রয়োজন। প্রথম যে সমস্যা কৃষকরা মুখোমুখি হয়েছে এবং হচ্ছে তা হলো আধুনিক উপকরণের অপ্রতুল সরবরাহ এবং সহজলভ্যতার অভাব। যেমন সার, সেচের পানি। সরকার-এর জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রাখছে প্রতি বছর, কিন্তু এইসব কৃষকের কাছে বিতরণের যে পদ্ধতি ও ব্যবস্থা তা মধ্যস্বত্বভোগীদের কুক্ষিগত হয়ে সরকারের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করছে। এক সময়ে ছিল ডিসি এইসব উপকরণ সরবরাহের দায়িত্বে, তখন মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ছিল না। যদিও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অদক্ষতার জন্য কৃষকদের ভুক্তভোগী হতে হয়েছে মাঝে-মাঝেই। এ সত্ত্বেও সবুজ বিপস্নবে বিএডিসির ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু ব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থার পরামর্শে ও চাপে বিএডিসির ভূমিকা সংকুচিত করে বেসরকারি খাতকে প্রাধান্য দিতে হয়েছে। এই উদ্যোগ যে পুরোপুরি সফল হয়নি তা মাঝে-মাঝেই সার সংকটের ঘটনা থেকে বোঝা যায়। উন্নত বীজের অপ্রতুলতাও একই কথা বলে। সেচের পানি সরবরাহ অনিয়মিত হয়ে যাওয়ার পেছনে অবশ্য সরকারি খাতেরই ব্যর্থতা প্রধান কারণ। সব মিলিয়ে কৃষক সময়মত এবং প্রয়োজন অনুযায়ী উপকরণ পায়নি এবং এখনো সব সময় পায় না। এর ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায় অথবা উৎপাদন হ্রাস হয়। এরসঙ্গে যুক্ত হয় কৃষকদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করার বিষয়। কৃষিখাতে মধ্যস্বত্বভোগী সব সময়ই ছিল, কেননা তাদের পক্ষে অধিক পরিমাণে শষ্য সরাসরি বাজারে নিয়ে বিক্রি সম্ভব হয় না। যতক্ষণ মধ্যস্বত্বভোগী দালাল-ফড়িয়ার লভ্যাংশের পরিমাণ যুক্তিসঙ্গত থাকে তখন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কিন্তু এই লাভের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হলে কৃষক শুধু যে ন্যায্যমূল্য পায় না, তাই নয়, তার উৎপাদন খরচ মেটানোও কঠিন হয়ে পড়ে। বর্তমানে বিচ্ছিন্নভাবে দালাল-ফড়িয়ার তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিকভাবে শক্তিধর সব সিন্ডিকেট। এরা সনাতন ফড়িয়া দালালদের সঙ্গে যুক্ত করেছে নতুন এক মধ্যস্বত্বভোগীর স্তর। এদের নিয়ন্ত্রণ যেমন নিশ্ছিদ্র এবং কঠোর, মুনাফা লাভের পরিমাণও বেশী। সব মিলে একদিকে উৎপাদনকারী কৃষক তাদের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না, অন্যদিকে ভোক্তারা উচ্চমূল্যে চাল-ডাল থেকে অন্যান্য কৃষিপণ্য কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। সোনার বাংলা গড়ার পেছনে গুরুত্ব রেখেছে যে কৃষিখাত এবং তার বদৌলতে নিশ্চিন্ত থেকেছে জনসাধারণ উভয়েই অনেকদিন থেকে সঙ্কটের আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি করতে না পেরে বিপন্ন হয়েছে পাট চাষীরা। পাটকল বন্ধ হয়ে গিয়েছে একের পর এক। পাটজাত পণ্য হ্রাস পেয়েছে দ্রুতবেগে। প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের এই দুর্গতির ফলে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের কৃষক যারা 'সোনার বাংলা' গড়ার প্রধান কারিগর।

বাংলাদেশের কৃষক সম্প্রদায় অশিক্ষিত, প্রায়ই অর্ধভুক্ত এবং স্বাস্থ্যহীনতার শিকার। আধুনিক অর্থনীতির ফন্দি-ফিকির তারা বোঝে না তাই প্রতারিত এবং বঞ্চিত হয় সহজেই। আর তাদের মধ্যে রয়েছে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার সহজাত প্রবৃত্তি এবং উদ্ভাবনশীলতা। তারা হাফ ছাড়ে না, দমে যায় না। হয় নতুন উপায় বার করে, নয়তো নতুন উপায়ের খোঁজ পেলে তার সদ্ব্যবহার করতে ইতস্তত করে না। সংবাদপত্রে মাঝে-মাঝেই এমন সাফল্যের খবর থাকে যা পড়ে 'সোনার বাংলা' সম্বন্ধে আশাবাদ এবং আস্থা হারায় না। ৪ নভেম্বরের এক ইংরেজী দৈনিকে মফস্বল সংবাদে এমন কয়েকটি সাফল্যের খবর রয়েছে যা বাংলাদেশের কৃষকদের শুধু টিকে থাকা না, উন্নতির পথে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্পের কথা জানিয়েদেন। প্রথম খবরে বলা হয়েছে পাবনায় হাইব্রিড বীজের ব্যবহার করে প্রচুর ধান উৎপাদন হতে যাচ্ছে। এই জেলায় কৃষকরা যাকে বলে 'বাম্পার ক্রপ' তাই পেতে যাচ্ছে। 'সোনা' নামে পরিচিত এই হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করে ধানের চাষ করা হয়েছে ৩১ হাজার হেক্টরেরও বেশী জমিতে। ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছে ৫৬০০০ টনেরও বেশী। প্রতি একরে এই ধানের উৎপাদন ৬৩ থেকে ৭০ মণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর আগে একর প্রতি ধানের উৎপাদন ছিল ৪০ থেকে ৫০ মণ। হাইব্রিড বীজের ব্যবহার নিয়ে পরিবেশবাদীরা দ্বিমত পোষণ করেন। তারা এনিয়ে আন্দোলনও শুরু করেছেন। ফলাফল না দেখে ঢালাওভাবে হাইব্রিড বীজের সমালোচনা অযৌক্তিক। তাদের মনে রাখা উচিৎ ষাটের দশকে যে উচ্চ ফলনশীল ধানের বীজ জনপ্রিয় করে তুলে সবুজ বিপস্নব সম্ভব হয়েছিল সেসবও ছিল হাইব্রিড। যাই হোক হাইব্রিড বীজ ব্যবহার সম্প্রসারিত করার পাশাপাশি এর প্রতিকূল পাশর্্বপ্রতিক্রিয়া নিয়েও গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে যেন এসবের প্রতিকার করা যায়। রোমান্টিক ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে নতুন প্রযুক্তির বিরোধিতা করা আমাদের মত দেশে এক ধরনের বিলাসিতা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্যের চাহিদা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে ওপরে। এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে হলে নতুন প্রযুক্তিই একমাত্র উপায় কেননা জমি বাড়ছে না বরং কমছে। পরিবেশবাদীদের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু তারা বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তাদের সদিচ্ছা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।

একই তারিখের ইংরেজী সংবাদপত্রে (দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ৫ নভেম্বর) মফস্বল সংবাদে বলা হয়েছে সাভারে কৃষকরা ব্যাপকভাবে শীতকালীন পণ্য চাষের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। যেসব শস্য শীত মৌসুমে চাষ করা হবে তার মধ্যে রয়েছে বোরো ধান, ভুট্টা, বাদাম এবং শাক-সবজি। বোরো ধান চাষ নতুন নয় কিন্তু ভুট্টার চাষ অল্প সময়ের মধ্যে কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং এর উৎপাদন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমেরিকা, ইউরোপের মত দেশে ভুট্টা গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহূত হয় না, মানুষের খাদ্য হিসেবেই এর চাহিদা বাড়ছে। এটা খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনের বা বহুমুখীকরণের লক্ষণ যা ছাড়া ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না। পাবনায় প্রায় ২৫০ হেক্টর জমিতে ২০০ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই জেলায় শীত মৌসুমে ১২০০ হেক্টর জমিতে ১৮৫০ মেট্রিক টন বাদাম উৎপাদন করবে বলে জানানো হয়েছে। সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য হলো শীতকালীন শাক-সবজির চাষ। পাবনা জেলায় শীত মৌসুমে ৮০০ হেক্টর জমিতে চাষ করে উৎপাদন করা হবে ১০২০০ মেট্রিক টন শাক-সবজি। নদীর তীরে যে জমিতে বাদাম ও শাক-সবজির চাষ হবে সেখানে সার ও কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করা হবে না। এই সংবাদে উদ্বিগ্ন পরিবেশবাদীরা খুশী হবেন। পাবনার মতো অন্যান্য জেলাতেও শীতকালীন শস্যের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা মনে করা যায় কেননা সেখানকার কৃষকরা একই পরিস্থিতিতে কাজ করছেন এবং তার সঙ্গে জমির ব্যবহার ও চাষ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এরজন্য তাদের উচ্চশিক্ষিত হতে হয়নি এবং পরামর্শকদের দ্বারস্থ হবার প্রয়োজনও দেখা দেয়নি। জীবন যুদ্ধে টিকে থাকা এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার সনাতন ঐতিহ্যই তাদেরকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ কারণেই 'সোনার বাংলা'র ইমেজ কখনোই ব্যর্থ হয়ে যাবে না।

[ লেখক : কথাশিল্পী ও সাবেক সচিব]

No comments:

Post a Comment