ছাগল উত্পাদন বেড়েছে বছরে এক কোটি
আলাউদ্দিন আরিফ
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের (পশুসম্পদ) ছাগল পালন কর্মসূচি ছিল লাভজনক। ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দেশে বছরে ছাগলের উত্পাদন বেড়েছে প্রায় এক কোটি। সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫ শতাধিক ছোট-বড় খামার। কর্মসূচি সংশ্লিষ্টরা বলেন, ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর দেশজুড়ে ব্লাক বেঙ্গল জাতের ছাগল উত্পাদন আশানুরূপ বেড়েছে। বিশেষ করে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, যশোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় বিপুলসংখ্যক খামার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
২০০২ সালের ২৭ এপ্রিল তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকী। ‘দারিদ্র্য বিমোচনে ছাগল উন্নয়ন কর্মসূচি’ নামে ৫ বছরমেয়াদি কর্মসূচির যাত্রা শুরু হয় ২০০৩-০৪ অর্থবছরে। এর ব্যয় ধরা হয় ৫২ কোটি ৭২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। শুরুর বছর প্রকল্পের জন্য ছাড় দেয়া হয় ৮ কোটি টাকা।
বিশ্বে ১৮ প্রজাতির ছাগল থাকলেও ছাগল উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বেছে নেয়া হয় বিশ্বের সর্বোত্কৃষ্ট জাতের ছাগল ‘ব্লাক বেঙ্গল’। এই জাতের ছাগল বাছাই প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এরা কৃষি উপজাত ও প্রাকৃতিকভাবে উত্পাদিত ঘাস লতাপাতা খেয়ে বেঁচে থাকে; অল্প জায়গায় অধিকসংখ্যক ছাগল পালন করা যায়; এই জাতের ছাগল দ্রুত প্রজননক্ষম, ৭ মাস বয়সে গর্ভধারণ করে, বছরে ২ বার বাচ্চা দেয়, একটি ছাগী বছরে ৪ থেকে ৬টি বাচ্চা দেয়; প্রতিকূল পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে এবং দ্রুত বাড়ে; খাদ্য খরচ কম; অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ববাজারে এদের মাংস ও চামড়ার চাহিদা অনেক বেশি এবং অধিক মূল্যবান; চামড়া মোটা, পশম চামড়ার উপরে থাকায় সহজেই পশম ছাড়ানো যায়; এদের মাংসের আঁশ মিহি ও সুস্বাদু, মাংসের ভিতর চর্বি থাকে না, চর্বি থাকে মাংসের বাইরে, চাইলে টেনে মাংস থেকে চর্বি আলাদা করা যায়। তাছাড়া প্রকৃতিগতভাবেই আমাদের দেশে এই জাতের ছাগলের উত্পাদন হয়। স্বাভাবিক উত্পাদনের পাশাপাশি আধুনিক ও লাগসই প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং রোগব্যাধির হাত থেকে রক্ষা করতে এই জাতের ছাগল বেছে নেয়া হয়। কর্মসূচির আওতায় ব্লাক বেঙ্গলের পাশাপাশি যুমনা পারি বা রামছাগলের উত্পাদনও বেড়েছে, কমেছে রোগবালাই।
কর্মসূচি প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, কস্ট অব বেসিক নিড (সিবিএন)-এর ভিত্তিতে বাংলাদেশে মোট জনসংখার ৫৩.২ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। জমির পরিমাণ হিসাবে এই দারিদ্র্য ৫৮ থেকে ৬৮ শতাংশ বেশি। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রায় সবাই ছাগল পালন করে। মানুষকে ছাগল পালনে আরও উত্সাহী করা, ছাগলের রোগবালাই দূর করা, কম জায়গায় অধিকসংখ্যক ছাগল পালন করা, ছাগল পালনের মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণ, বেকারত্ব দূর করা, ছাগলের মাংস ও দুধ উত্পাদন বাড়ানোর মাধ্যমে পুষ্টি সরবরাহ বাড়ানো, ছাগলের মাংস ও চামড়া রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে এই কর্মসূচির যাত্রা শুরু হয়।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, কর্মসূচি শুরুর আগে ২০০১ সালে দেশে ছাগল উত্পাদন হতো ২০ মিলিয়নের কম। ২০০১ পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ছাগল উত্পাদনের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২.৫০ শতাংশ। ওই অবস্থায় ২০০২ সালে দারিদ্র্য বিমোচনে ছাগল উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। কর্মসূচির জন্য ব্যয় ধরা হয় ৫২ কোটি ৭২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এর আওতায় কোনো ঋণ বিতরণ করা হয়নি। ঋণ বিতরণ করা হয়েছে মত্স্য ও পশুপালন প্রকল্পের আওতায়। পরে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মাঠপর্যায়ে জনবল সঙ্কটের কারণে এই ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দেয়া হয়।
কর্মসূচির আওতায় ছাগল পালনের গুরুত্ব সম্পর্কে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণ, চাষীদের সচেতন করা, সঠিক জাত বাছাই করা, খাসি, ছাগী ও বাচ্চার পরিচর্যা, ছাগল রাখা ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া, রোগের প্রতিষেধক সরবরাহ এবং ছাগলের খামার করতে পরামর্শ ও উত্সাহ দেয়া হয়। ছাগল উন্নয়ন কর্মসূচির সাবেক ডেপুটি প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর ডা. মো. আলেক মণ্ডল জানান, কর্মসূচি গ্রহণের পর দেশে ছাগল পালন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ২০০২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশে ছাগলের উত্পাদন গড়ে ৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। ২০০৫ সালে উত্পাদন প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯.২৫ শতাংশ এবং ২০০৬ সালে ছিল ১০.৩৫ শতাংশ। রোগের প্রতিষেধক দেয়া ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্লাক বেঙ্গল ছাড়াও বিটাল, বারবারী, অ্যাংলোনুবিয়ান, যুমনাপারী (রামছাগল) ইত্যাদি প্রজাতির ছাগলের উত্পাদনও অনেক বৃদ্ধি পায়। ২০০৯ সাল নাগাদ ছাগলের উত্পাদন বেড়ে বছরে ৩ কোটি ছাড়িয়ে যায়। এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর দেশে বার্ষিক ছাগল উত্পাদন বেড়েছে প্রায় এক কোটি।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ছাগলের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি মাংস, চামড়া ও দুধ উত্পাদন বেড়েছে। পশু চিকিত্সকদের মতে, ছাগলের দুধ গরুর দুধের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। যেসব এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ছাগল উত্পাদন হয় সেখানে গরুর দুধের সঙ্গে মিশিয়ে ছাগলের দুধও বাজারজাত করা হয়। মিল্কভিটা বা অন্যসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুরুর দুধের সঙ্গে এই দুধ কিনে প্যাকেটজাত করে। এর থেকে গুঁড়োদুধও তৈরি হয়। তাছাড়া অনেক এলাকায় পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে রোজ হিসেবেও বিক্রি হয় ছাগলের দুধ।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও জানান, বর্তমানে অ্যানথ্রাক্সজনিত কারণে গরুর আমদানি ও জবাইয়ের হার কমেছে। ফলে প্রায় মার খেতে বসেছে দেশের চামড়া শিল্প। এ অবস্থায় ছাগল জবাইয়ের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে চামড়ার জোগানও। এর থেকে চামড়া শিল্পের জঙ্গে জড়িতরা কিছুটা হলেও আশার আলো দেখছেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের জুন মাসে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের এই কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ এনে বরখাস্ত করা হয় কয়েকজন কর্মকর্তাকে। তবে বর্তমানে আবারও এ কর্মসূচি হাতে নেয়া হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এরই মধ্যে প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞদের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য ও প্রকল্প প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, শিগগিরই এ ধরনের প্রকল্প আবার চালু করা হতে পারে।
ছাগল উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয় প্রাণিসম্পদ (পশু) অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ডা. সালেহ উদ্দিন মাহমুদের সময়। তিনি আমার দেশকে জানান, এটি কোনো প্রকল্প ছিল না। বরং এটি ছিল ছাগল পালন বাড়াতে ৫২ কোটি ৭২ লাখ টাকার ৫ বছরমেয়াদি একটি কর্মসূচি। প্রতি অর্থবছর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এই কর্মসূচির জন্য ৭-৮ কোটি টাকা করে ছাড় দেয়া হতো। বিএনপি সরকারের ৫ বছরে এই কর্মসূচির জন্য সর্বোচ্চ ৪০ কোটি টাকা ছাড় দেয়া হয়েছিল। কর্মসূচির জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে ৭ বছরে প্রায় ৪৫ কোটি টাকার মতো ছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু ‘ছাগল প্রকল্পের নামে এক হাজার কোটি টাকা লুট; ছাগল প্রকল্পের নামে হাজার কোটি টাকা জলে গেছে, ছাগল প্রকল্পের হাজার কোটি টাকা মেরে দেয়া হয়েছে’ এ ধরনের হাস্যকর ও বিভ্রান্তিকর অনেক বক্তব্য আমাদের মন্ত্রী-এমপিরা দিয়েছেন। এমনকি জাতীয় সংসদেও ভুল তথ্য পরিবেশন করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নাম জড়িয়ে অনেক হাসি তামাশা করা হয়েছে। এসব বিষয় সত্যিই দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন, দারিদ্র্য বিমোচন, জাতীয় আয় বৃদ্ধি ও আমাদের আমিষের চাহিদা পূরণে ছাগল পালন গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখে। এখনও দেশে বিধবা দরিদ্র ও বয়ষ্ক মহিলাদের আয়ের একমাত্র উত্স হিসেবে বিবেচিত হয় ছাগল পালন। প্রচলিত ধ্যান-ধারণার আলোকে যুগ যুগ ধরেই আমাদের দেশে ছাগল পালন হয়ে আসছে। ছাগল পালনের ক্ষেত্রে আধুনিক ও লাগসই প্রযুক্তি প্রয়োগ করে এর উত্পাদন বৃদ্ধি ও রোগবালাই থেকে এদের রক্ষা করার জন্য কিছু কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, জনগুরুত্বপূর্ণ এই কর্মসূচি নিয়ে অনেক হাসি-তামাশা করা হয়েছে এবং এটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
ডা. সালেহ উদ্দিন আরও বলেন, দেশের মানুষ ছাগল উন্নয়ন কর্মসূচির সুফল পেয়েছে। এবার কোরবানির ঈদে ছাগলের যে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নের কারণে সেটি মেটানো সম্ভব হচ্ছে। এখন দেশে ছাগল আমদানি করতে হচ্ছে না বরং রফতানি করা যাচ্ছে। এর থেকেই সহজেই বুঝা যায় কর্মসূচিটি ছিল সফল ও লাভজনক।
বর্তমানে অনেকেরই অভিযোগ, এই কর্মসূচির হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। প্রশ্ন হলো যেখানে মোট বরাদ্দ ৫২ কোটি টাকা, কর্মসূচি চলাকালে প্রতি অর্থবছরে ছাড় করা হতো ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা। ৫ বছরের ওই কর্মসূচিতে (পরবর্তীতে ২ বছর বৃদ্ধি) কীভাবে হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বিষয়টি বোধগম্য নয়। কেউ কেউ বলছেন, বেগম খালেদা জিয়া ওই কর্মসূচির উদ্বোধন করার কারণে রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি হিসেবে এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দেয়া হচ্ছে।
Source: Daily Amardesh
২০০২ সালের ২৭ এপ্রিল তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকী। ‘দারিদ্র্য বিমোচনে ছাগল উন্নয়ন কর্মসূচি’ নামে ৫ বছরমেয়াদি কর্মসূচির যাত্রা শুরু হয় ২০০৩-০৪ অর্থবছরে। এর ব্যয় ধরা হয় ৫২ কোটি ৭২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। শুরুর বছর প্রকল্পের জন্য ছাড় দেয়া হয় ৮ কোটি টাকা।
বিশ্বে ১৮ প্রজাতির ছাগল থাকলেও ছাগল উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য বেছে নেয়া হয় বিশ্বের সর্বোত্কৃষ্ট জাতের ছাগল ‘ব্লাক বেঙ্গল’। এই জাতের ছাগল বাছাই প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এরা কৃষি উপজাত ও প্রাকৃতিকভাবে উত্পাদিত ঘাস লতাপাতা খেয়ে বেঁচে থাকে; অল্প জায়গায় অধিকসংখ্যক ছাগল পালন করা যায়; এই জাতের ছাগল দ্রুত প্রজননক্ষম, ৭ মাস বয়সে গর্ভধারণ করে, বছরে ২ বার বাচ্চা দেয়, একটি ছাগী বছরে ৪ থেকে ৬টি বাচ্চা দেয়; প্রতিকূল পরিবেশেও বেঁচে থাকতে পারে এবং দ্রুত বাড়ে; খাদ্য খরচ কম; অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ববাজারে এদের মাংস ও চামড়ার চাহিদা অনেক বেশি এবং অধিক মূল্যবান; চামড়া মোটা, পশম চামড়ার উপরে থাকায় সহজেই পশম ছাড়ানো যায়; এদের মাংসের আঁশ মিহি ও সুস্বাদু, মাংসের ভিতর চর্বি থাকে না, চর্বি থাকে মাংসের বাইরে, চাইলে টেনে মাংস থেকে চর্বি আলাদা করা যায়। তাছাড়া প্রকৃতিগতভাবেই আমাদের দেশে এই জাতের ছাগলের উত্পাদন হয়। স্বাভাবিক উত্পাদনের পাশাপাশি আধুনিক ও লাগসই প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং রোগব্যাধির হাত থেকে রক্ষা করতে এই জাতের ছাগল বেছে নেয়া হয়। কর্মসূচির আওতায় ব্লাক বেঙ্গলের পাশাপাশি যুমনা পারি বা রামছাগলের উত্পাদনও বেড়েছে, কমেছে রোগবালাই।
কর্মসূচি প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, কস্ট অব বেসিক নিড (সিবিএন)-এর ভিত্তিতে বাংলাদেশে মোট জনসংখার ৫৩.২ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। জমির পরিমাণ হিসাবে এই দারিদ্র্য ৫৮ থেকে ৬৮ শতাংশ বেশি। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রায় সবাই ছাগল পালন করে। মানুষকে ছাগল পালনে আরও উত্সাহী করা, ছাগলের রোগবালাই দূর করা, কম জায়গায় অধিকসংখ্যক ছাগল পালন করা, ছাগল পালনের মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণ, বেকারত্ব দূর করা, ছাগলের মাংস ও দুধ উত্পাদন বাড়ানোর মাধ্যমে পুষ্টি সরবরাহ বাড়ানো, ছাগলের মাংস ও চামড়া রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে এই কর্মসূচির যাত্রা শুরু হয়।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, কর্মসূচি শুরুর আগে ২০০১ সালে দেশে ছাগল উত্পাদন হতো ২০ মিলিয়নের কম। ২০০১ পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ছাগল উত্পাদনের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২.৫০ শতাংশ। ওই অবস্থায় ২০০২ সালে দারিদ্র্য বিমোচনে ছাগল উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। কর্মসূচির জন্য ব্যয় ধরা হয় ৫২ কোটি ৭২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এর আওতায় কোনো ঋণ বিতরণ করা হয়নি। ঋণ বিতরণ করা হয়েছে মত্স্য ও পশুপালন প্রকল্পের আওতায়। পরে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মাঠপর্যায়ে জনবল সঙ্কটের কারণে এই ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দেয়া হয়।
কর্মসূচির আওতায় ছাগল পালনের গুরুত্ব সম্পর্কে মাঠপর্যায়ের কর্মীদের প্রশিক্ষণ, চাষীদের সচেতন করা, সঠিক জাত বাছাই করা, খাসি, ছাগী ও বাচ্চার পরিচর্যা, ছাগল রাখা ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া, রোগের প্রতিষেধক সরবরাহ এবং ছাগলের খামার করতে পরামর্শ ও উত্সাহ দেয়া হয়। ছাগল উন্নয়ন কর্মসূচির সাবেক ডেপুটি প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর ডা. মো. আলেক মণ্ডল জানান, কর্মসূচি গ্রহণের পর দেশে ছাগল পালন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। ২০০২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশে ছাগলের উত্পাদন গড়ে ৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। ২০০৫ সালে উত্পাদন প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯.২৫ শতাংশ এবং ২০০৬ সালে ছিল ১০.৩৫ শতাংশ। রোগের প্রতিষেধক দেয়া ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্লাক বেঙ্গল ছাড়াও বিটাল, বারবারী, অ্যাংলোনুবিয়ান, যুমনাপারী (রামছাগল) ইত্যাদি প্রজাতির ছাগলের উত্পাদনও অনেক বৃদ্ধি পায়। ২০০৯ সাল নাগাদ ছাগলের উত্পাদন বেড়ে বছরে ৩ কোটি ছাড়িয়ে যায়। এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর দেশে বার্ষিক ছাগল উত্পাদন বেড়েছে প্রায় এক কোটি।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ছাগলের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি মাংস, চামড়া ও দুধ উত্পাদন বেড়েছে। পশু চিকিত্সকদের মতে, ছাগলের দুধ গরুর দুধের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। যেসব এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ছাগল উত্পাদন হয় সেখানে গরুর দুধের সঙ্গে মিশিয়ে ছাগলের দুধও বাজারজাত করা হয়। মিল্কভিটা বা অন্যসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুরুর দুধের সঙ্গে এই দুধ কিনে প্যাকেটজাত করে। এর থেকে গুঁড়োদুধও তৈরি হয়। তাছাড়া অনেক এলাকায় পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে রোজ হিসেবেও বিক্রি হয় ছাগলের দুধ।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও জানান, বর্তমানে অ্যানথ্রাক্সজনিত কারণে গরুর আমদানি ও জবাইয়ের হার কমেছে। ফলে প্রায় মার খেতে বসেছে দেশের চামড়া শিল্প। এ অবস্থায় ছাগল জবাইয়ের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে চামড়ার জোগানও। এর থেকে চামড়া শিল্পের জঙ্গে জড়িতরা কিছুটা হলেও আশার আলো দেখছেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের জুন মাসে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের এই কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ এনে বরখাস্ত করা হয় কয়েকজন কর্মকর্তাকে। তবে বর্তমানে আবারও এ কর্মসূচি হাতে নেয়া হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এরই মধ্যে প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞদের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য ও প্রকল্প প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, শিগগিরই এ ধরনের প্রকল্প আবার চালু করা হতে পারে।
ছাগল উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয় প্রাণিসম্পদ (পশু) অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ডা. সালেহ উদ্দিন মাহমুদের সময়। তিনি আমার দেশকে জানান, এটি কোনো প্রকল্প ছিল না। বরং এটি ছিল ছাগল পালন বাড়াতে ৫২ কোটি ৭২ লাখ টাকার ৫ বছরমেয়াদি একটি কর্মসূচি। প্রতি অর্থবছর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এই কর্মসূচির জন্য ৭-৮ কোটি টাকা করে ছাড় দেয়া হতো। বিএনপি সরকারের ৫ বছরে এই কর্মসূচির জন্য সর্বোচ্চ ৪০ কোটি টাকা ছাড় দেয়া হয়েছিল। কর্মসূচির জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে ৭ বছরে প্রায় ৪৫ কোটি টাকার মতো ছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু ‘ছাগল প্রকল্পের নামে এক হাজার কোটি টাকা লুট; ছাগল প্রকল্পের নামে হাজার কোটি টাকা জলে গেছে, ছাগল প্রকল্পের হাজার কোটি টাকা মেরে দেয়া হয়েছে’ এ ধরনের হাস্যকর ও বিভ্রান্তিকর অনেক বক্তব্য আমাদের মন্ত্রী-এমপিরা দিয়েছেন। এমনকি জাতীয় সংসদেও ভুল তথ্য পরিবেশন করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নাম জড়িয়ে অনেক হাসি তামাশা করা হয়েছে। এসব বিষয় সত্যিই দুঃখজনক। তিনি আরও বলেন, দারিদ্র্য বিমোচন, জাতীয় আয় বৃদ্ধি ও আমাদের আমিষের চাহিদা পূরণে ছাগল পালন গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখে। এখনও দেশে বিধবা দরিদ্র ও বয়ষ্ক মহিলাদের আয়ের একমাত্র উত্স হিসেবে বিবেচিত হয় ছাগল পালন। প্রচলিত ধ্যান-ধারণার আলোকে যুগ যুগ ধরেই আমাদের দেশে ছাগল পালন হয়ে আসছে। ছাগল পালনের ক্ষেত্রে আধুনিক ও লাগসই প্রযুক্তি প্রয়োগ করে এর উত্পাদন বৃদ্ধি ও রোগবালাই থেকে এদের রক্ষা করার জন্য কিছু কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, জনগুরুত্বপূর্ণ এই কর্মসূচি নিয়ে অনেক হাসি-তামাশা করা হয়েছে এবং এটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
ডা. সালেহ উদ্দিন আরও বলেন, দেশের মানুষ ছাগল উন্নয়ন কর্মসূচির সুফল পেয়েছে। এবার কোরবানির ঈদে ছাগলের যে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে ওই কর্মসূচি বাস্তবায়নের কারণে সেটি মেটানো সম্ভব হচ্ছে। এখন দেশে ছাগল আমদানি করতে হচ্ছে না বরং রফতানি করা যাচ্ছে। এর থেকেই সহজেই বুঝা যায় কর্মসূচিটি ছিল সফল ও লাভজনক।
বর্তমানে অনেকেরই অভিযোগ, এই কর্মসূচির হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। প্রশ্ন হলো যেখানে মোট বরাদ্দ ৫২ কোটি টাকা, কর্মসূচি চলাকালে প্রতি অর্থবছরে ছাড় করা হতো ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা। ৫ বছরের ওই কর্মসূচিতে (পরবর্তীতে ২ বছর বৃদ্ধি) কীভাবে হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বিষয়টি বোধগম্য নয়। কেউ কেউ বলছেন, বেগম খালেদা জিয়া ওই কর্মসূচির উদ্বোধন করার কারণে রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি হিসেবে এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দেয়া হচ্ছে।
Source: Daily Amardesh
No comments:
Post a Comment