Tuesday, October 19, 2010

চরের মানুষের বন্ধু ভাসমান এক হাসপাতাল



চরের মানুষের বন্ধু ভাসমান এক হাসপাতাল

শাহাবুল শাহীন, গাইবান্ধা

গাইবান্ধার চরাঞ্চলে বিনামূল্যে চিকিত্সাসেবা দিচ্ছে লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ ভাসমান হাসপাতাল। সাত বছরে নয় লাখেরও বেশি মানুষকে অস্ত্রোপচারসহ অন্যান্য চিকিত্সাসেবা দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে সাধারণ চিকিত্সা থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচার, গর্ভবতী ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা, চক্ষু ও দন্ত চিকিত্সা এবং ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে। বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের মাধ্যমেও সেবা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে রয়েছে ডিজিটাল এক্স-রে, ইসিজিসহ সব ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার ব্যবস্থা। ফলে যোগাযোগের সমস্যা ও অর্থাভাবে যাঁরা শহরের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের কাছে যেতে পারেন না, তাঁরা এখন হাতের কাছে আধুনিক চিকিত্সাসেবা পাচ্ছেন। বেসরকারি সংগঠন ফ্রেন্ডশিপ ও ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড যৌথভাবে এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে ইউনিলিভার।
ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল সূত্র জানায়, ফ্রেন্ডশিপ একটি বেসরকারি সংগঠন। ১৯৯৮ সালে এটি গড়ে ওঠে। ফ্রেন্ডশিপ ও ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড যৌথভাবে ১৯৯৮ সালে লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালটি উদ্বোধন করে। ২০০২ সালে গাইবান্ধার চরাঞ্চলে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়। গত সাত বছরে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও জামালপুর জেলার ৩৫টি স্পটে এ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল চিকিত্সাসেবা দেয়। গত ১ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের খাটিয়ামারীর চরে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের জাহাজ নোঙর করে। এখানে আড়াই মাস চিকিত্সাসেবা দেওয়া হবে। এখান থেকে হাসপাতালটি সদর উপজেলার মোল্লারচর ইউনিয়নের সিধাই গ্রামের চরে যাবে। তবে নদীর পানির গভীরতার ওপর স্পট নির্ধারণ নির্ভর করে। এর আগে একই উপজেলার এরেণ্ডাবাড়ী ইউনিয়নের হরিচণ্ডী গ্রামে দুই মাস ১৫ দিন চিকিত্সাসেবা দেওয়া হয়। মোল্লারচর ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘দুর্গম এলাকা হওয়ায় চরাঞ্চলে সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা আসতে চান না। এমনকি চরাঞ্চলে কোনো ওষুধের দোকান পর্যন্ত নেই। ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল চরাঞ্চলের মানুষকে হাতের কাছে চিকিত্সাসেবা পৌঁছে দিয়েছে। হাসপাতালের চিকিত্সা ক্যাম্পে মাইকিং করে রোগী পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। এমনকি এসব কাজে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ফ্রেন্ডশিপের বিভিন্ন সেমিনারে যোগ দিয়ে থাকি।’
ফ্রেন্ডশিপের তথ্যবিষয়ক কর্মকর্তা লোকমান হোসেন বলেন, হাসপাতালে দুজন চিকিত্সক নিয়মিত চিকিত্সাসেবা দিচ্ছেন। এ ছাড়া হাসপাতালে তিনজন নার্স, তিনজন চিকিত্সা সহকারী, তিনজন টেকনিশিয়ান, পাঁচজন সহকারী টেকনিশিয়ান, একজন ড্রাইভার, একজন কুক, একজন জাহাজ ক্লিনার, একজন মাস্টার, একজন মেকানিক, একজন জেনারেটর টেকনিশিয়ান ও ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিত্সক শফিউল আযম জানান, সপ্তাহের সাত দিনই সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বিনামূল্যে রোগীদের চিকিত্সাসেবা দেওয়া হয়। রোগীপ্রতি রেজিস্ট্রেশন ফি মাত্র পাঁচ টাকা। রেজিস্ট্রেশনের জন্য রোগীকে একটি বই দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দফায় চিকিত্সকের সঙ্গে সাক্ষাত্ করার জন্য তিন টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি নেওয়া হয়।
ফজলুপুর ইউপি চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) জালাল উদ্দিন জানান, এসব ইউনিয়ন জেলার মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। উপজেলা ও জেলার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। ফলে মুমূর্ষু রোগীদের হাসপাতালে নিতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয় এলাকার মানুষজনকে। এ জন্য অনেকেই অকালে মারা যান। এ বাস্তবতায় লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল মানুষের ভীষণ উপকারে এসেছে। যাঁরা যোগাযোগ সমস্যা ও অর্থাভাবে শহরে গিয়ে চিকিত্সা নিতে পারেননি, তাঁরা এখন হাতের কাছেই আধুনিক চিকিত্সাসেবা পাচ্ছেন। তিনি বলেন, হাসপাতালটি মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। গ্রামপুলিশ দিয়ে হাসপাতালে কর্মরতদের নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।
নিয়মিত রোগী দেখা ছাড়াও ভাসমান হাসপাতালের আশপাশে প্রতিবছর গড়ে ১০টি চিকিত্সা ক্যাম্পের মাধ্যমে চিকিত্সাসেবা দেওয়া হয়। প্রতিটি ক্যাম্পে সাত দিন থেকে এক মাস পর্যন্ত চিকিত্সাসেবা দেওয়া হয়। হিউমেনিটারিয়ান এইড নামে ফ্রান্সের একটি সংগঠনের আর্থিক সহায়তায় বছরে অন্তত ৬০ জন বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক পর্যায়ক্রমে এসব ক্যাম্পে চিকিত্সাসেবা দেন।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটি গ্রামের কৃষক আকবর মিয়া (৪৫) জানান, আমার ছেলে শাহজালালের (১৭) একটি পা জন্মের পর থেকেই বাঁকা ছিল। তাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হতো। লাইফবয় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের বিদেশি চিকিত্সক দিয়ে অস্ত্রোপচারের পর সে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছে। জামালপুরের মৌলভীরচরের মামুন (১১) একইভাবে অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয়েছে।
শুধু খাটিয়ামারীর চরের মানুষই নয়, পাশের ফুলছড়ি উপজেলার এরেণ্ডাবাড়ী, ফুলছড়ি সদর, ফজলুপুর, গাইবান্ধা সদর উপজেলার মোল্লারচর ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষও চিকিত্সাসেবা পাচ্ছে। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, রংপুর ও লালমনিরহাট থেকেও মানুষ এখানে চিকিত্সা নেয়। এরেণ্ডাবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) আমিনুল ইসলাম বলেন, সাধারণত চরাঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষ অসুস্থ হলে গ্রাম্য কবিরাজ, ঝাড় ফুঁক ও পানিপড়ার ওপর নির্ভর করে থাকে; বিশেষত গর্ভবতী নারীদের বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। সময়মতো তাদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে না পারায় এর আগে চরাঞ্চলের অনেক নারীর অকালে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বর্তমানে লাইফবয় হাসপাতালের কারণে এসব সমস্যা অনেক কমেছে।
হাসপাতাল সূত্র আরও জানায়, চিকিত্সাসেবা কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত নয় লাখ ৩৬ হাজার ২৫৬ জনকে বিনামূল্যে চিকিত্সাসেবা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ চিকিত্সাসেবা নিয়েছে পাঁচ লাখ ৭৩ হাজার ৯৪০ জন, অপারেশন দুই হাজার ৫০৫ জন; বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের মাধ্যমে চিকিত্সাসেবা নিয়েছে ৩৩ হাজার ৪২৭ জন, শল্য চিকিত্সা সুবিধা পেয়েছে পাঁচ হাজার ৫৫৭ জন এবং স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে তিন লাখ ৮২৭ জন চিকিত্সাসেবা নিয়েছে। এ হিসাবে দৈনিক গড়ে ৩৬৬ রোগীকে চিকিত্সাসেবা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে কর্মরত নার্স অঞ্জলী রানী বলেন, এখানে চিকিত্সা নিতে আসা লোকজনকে গুরুত্বসহ সেবা দেওয়া হয়। তাই চরাঞ্চল ছাড়াও বিভিন্ন জেলার মানুষ এ হাসপাতালে আসছে।
মোল্লারচর ইউনিয়নের ব্যাটকামারি গ্রামের দরিদ্র আছিরন বেগম (৭০) জানান, ‘হামরা জীবনে বড় ডাক্তারের কাচে যাবার পাইন্যাই। অসুক হলে ফকির-কবর্যাজের পানি পড়া খাচি। জাহাজের ডাক্তারের কাচে অপরাশোন করি হামার চোক ভালো হচে। গাঁওয়োত জাহাজকোনা না আইলে চোকের অসুক থ্যাকি গ্যালো হয়।’
খাটিয়ামারী গ্রামের পার্শ্ববর্তী কৃষ্ণমণিচর গ্রামের স্কুলশিক্ষক আলম মিয়া বলেন, চরাঞ্চলে অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন; যাঁরা জীবনেও এমবিবিএস ডাক্তারের চিকিত্সা নেননি। তাঁরাও এখানে সেই সুযোগ পাচ্ছেন। দুর্গম চরাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে মানুষকে চিকিত্সাসেবা দেওয়ার উদ্যোগ মহত্। সরকারিভাবেও এটা সম্ভব হয়নি। খাটিয়ামারী গ্রামের মৃত বশির উদ্দিনের স্ত্রী জমিরন বেগম (৭০) নিজের ভাষায় বললেন, ‘হামরা গরিব মানুষ। ম্যাল্যা দিন অসুকোত ভুগচি। ভালো ডাক্তারের কাচে যে যামো, ট্যাকা পামো কোনটে। টাউনোত যাতে হামারগরে ১০০ ট্যাকা নাগে। দুই ব্যালা খাবার পাইন্যা, ট্যাকা জোগাড় করমো ক্যামন করি। বাড়ির কাচে জাহাজ আসি ভালো হচে। বড় ডাক্তারোক দ্যাকেয়া হামারগরে ম্যালা অসুক ভালো হচে।’
ফ্রেন্ডশিপের প্রজেক্ট ম্যানেজার অমল কুমার প্রামাণিক বলেন, হাসপাতালে চোখ অপারেশন, লেন্স স্থাপন, দন্ত, অর্থোপেডিক অপারেশন, প্লাস্টিক সার্জারি, গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যসেবা, শিশু চিকিত্সা, পরিবার পরিকল্পনা ও স্থায়ী বন্ধ্যাকরণ, ঠোঁট কাটা অপারেশন, স্ত্রীরোগের চিকিত্সা, ফিজিওথেরাপি, নাক, কান, গলার চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে। ভাসমান হাসপাতালের চিকিত্সা সুবিধাভোগী ফজলুপুর ইউনিয়নের খাটিয়ামারী গ্রামের বদিউজ্জামানের স্ত্রী হাফিজা খাতুন (৪২) ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল থেকে হাঁপানি রোগের চিকিত্সা নিয়ে সুস্থ হওয়ার কথা জানান।
এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন রকিবুদ্দৌলা বলেন, ‘আমি একাধিকবার ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের কার্যক্রম ঘুরে দেখেছি। তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি চিকিত্সাসেবার পাশাপাশি এ হাসপাতালের চিকিত্সাব্যবস্থা ভালো। ওই সব চরাঞ্চলে পর্যাপ্ত সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী নেই। এ ছাড়া চরাঞ্চলের মানুষ অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে শহরে আসতে পারে না। এ ক্ষেত্রে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল চরাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। তাই জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হয়ে থাকে।’

No comments:

Post a Comment