Tuesday, January 3, 2012

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সম্ভাবনাময় দেশী প্রকল্প

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সম্ভাবনাময় দেশী প্রকল্প
আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক মানের অনেক প্রকল্পের কাজ হয়। গবেষণাধর্মী এসব প্রকল্প যতটা আশাব্যঞ্জকভাবে শুরু হয়, শেষ পর্যন্ত তা আশা ভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর শেষটা বেশিরভাগ সময়ই তিমিরে থেকে যায়। এমন বেশিরভাগ প্রকল্প কাজে লাগানো হয় না, বা কাজে লাগানো যায় না। অবশ্য এর অন্যতম কারণ এগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে তেমন একটা পরিচিতি পায় না। কিছু প্রকল্প আলোর মুখ দেখলেও উদ্যোক্তাদের অভাবে তেমন একটা কাজে লাগানো যায় না। অবশ্য এর মধ্যে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কারণও কিছুটা দায়ী। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন হাজার হাজার প্রকল্প কোনো কাজে আসছে না। আর এর পেছনে যাদের অবদান তারাও সেভাবে পরিচিতি বা স্বীকৃতি পান না। আমাদের দেশে এ ধরনের প্রকল্পের সংখ্যা একেবারে কম নয়। এমন কিছু প্রকল্পের বর্ণনা এই লেখার মাধ্যমে পাঠকের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস পাব। নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটের কিছু মেধাবী শিক্ষার্থীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এসব প্রকল্প।



প্রকল্প-১ : পিপীলিকা সার্চ ইঞ্জিন

পিপীলিকা বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র সার্চ ইঞ্জিন, যা বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই কাজ করতে সক্ষম। এই উন্মুক্ত ওয়েব সার্ভিসটি সারা দেশের সাম্প্রতিক ও ব্যবসায় সংক্রান্ত সংবাদ অনুসন্ধান করতে সহায়তা করে। এটি দেশের প্রধান ২টি বাংলা ও ২টি ইংরেজি পত্রিকার সংবাদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ ও সংরক্ষণ করে। জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিনগুলোর কোনোটিতেই বাংলা ভাষার ওপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। এতে বাংলা সংবাদ বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

পিপীলিকায় বেশ কয়েক ধরনের তথ্য অনুসন্ধানের সুবিধা রয়েছে।

পিপীলিকায় ২টি ভিন্ন ধরনের সার্চ সুবিধা রয়েছে: কর্পোরেট অনুসন্ধান এবং সংবাদ অনুসন্ধান।

সাধারণভাবে কেউ সার্চ করলে সংবাদ অনুসন্ধানের ফল দেখানো হয়। কেউ যদি কর্পোরেট অনুসন্ধান করতে চান, তবে সার্চ বক্সের নিচের কর্পোরেট অনুসন্ধান বক্সে ক্লিক করে নিতে হবে।



কর্পোরেট অনুসন্ধান : পিপীলিকাতে প্রায় ৬০ হাজার প্রতিষ্ঠানের তথ্য রয়েছে। প্রতিটি কোম্পানির নাম, ঠিকানা, ফোন, ফ্যাক্স ইত্যাদি দিয়ে কোনো ব্যবহারকারী সার্চ করে তার কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে পারেন। প্রতিটি কোম্পানির তথ্যাবলী গ্রুপ করে দেখানো হয়। মোট কত সময় লেগেছে, মোট ফল এবং প্রতিটি পাতায় সর্বোচ্চ ১০টি ফল দেখানো হয়। প্রতিটি ফলের ডান পাশে একটি লেখা আসে Related News, কেউ এখানে ক্লিক করে সহজেই ওই ফলটির নাম দিয়ে সংবাদ অনুসন্ধান করতে পারেন। এভাবে যেকেউ কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংবাদ অনুসন্ধান করতে পারেন।

সংবাদ অনুসন্ধান : পিপীলিকার সংবাদ অনুসন্ধান বিভাগটি আবার কয়েকটি ভাগে বিভক্ত : সাধারণ সার্চ, স্থানভিত্তিক সার্চ এবং ক্যাটাগরিভিত্তিক সার্চ।

তবে স্থানভিত্তিক ও ক্যাটাগরিভিত্তিক সার্চ এখন শুধু বাংলার জন্য উন্মুক্ত।

সাধারণ সার্চ : সাধারণ সার্চে যেকোনো শব্দ বা শব্দাবলী দিয়ে সার্চ করলে সেই শব্দের বা শব্দাবলীর ভিত্তিতে সার্চ ফল দেখানো হয়। যদি কেউ ইংরেজিতে সার্চ করেন, তবে কোনো ক্যাটাগরি অনুযায়ী ফল দেয়া হয় না। সংবাদ সার্চের ফলের পাশাপাশি একই শব্দ বা শব্দাবলীর কর্পোরেট সার্চের প্রথম ১০টি ফল পাশে আলাদা স্থানে দেখানো হয়। প্রয়োজনে তার নিচের Search More এই স্থানটিতে ক্লিক করে সে আবার কর্পোরেট অনুসন্ধানে চলে যেতে পারে। উল্লেখ্য, বাংলার জন্য কোনো কর্পোরেট অনুসন্ধানের সুবিধা রাখা হয়নি।

পিপীলিকার বাংলা সার্চের জন্য এর নিজস্ব একটি বাংলা অভিধান ব্যবহার করা হয়েছে। যদি ব্যবহারকারী কোনো শব্দের ভুল বানান দেন, তাহলে পিপীলিকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঠিক বানান খুঁজে নিয়ে সেই নতুন শব্দ দিয়ে অনুসন্ধান চালায়, ফল দেয় এবং সাথে সাথে ব্যবহারকারীকে জানিয়ে দেয় তার কোন শব্দের বানান ভুল ছিল এবং সঠিক কোন শব্দ দিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। ব্যবহারকারী চাইলে পরে সেই ভুল শব্দ দিয়েই আবার অনুসন্ধান চালাতে পারেন। ইংরেজি সার্চের ক্ষেত্রে অভিধানটি ব্যবহার করা হয়নি।

ফলাফলে দেখানো হবে- মোট অনুসন্ধানের সময়, মোট ফলের মাঝে প্রথম কতগুলো ফল দেখানো হলো, প্রতিটি ফলের হেডলাইন বা টাইটেল, প্রতিটি ফল থেকে হাইলাইটেড বা চুম্বক অংশ এবং সংবাদটির মূল সোর্সের ওয়েব লিঙ্ক এবং ক্যাশ করা সংবাদটি।

ব্যবহারকারী মূল ওয়েবলিঙ্ক বা হেডলাইনে ক্লিক করলে সহজেই মূল সংবাদ সোর্সে যেতে পারেন। আবার ক্যাশে ক্লিক করলে তিনি এখানেই একসাথে সংবাদটির হেডলাইন, সোর্স, মূল সংবাদ, তারিখ ও ওয়েবলিঙ্ক দেখতে পারবেন। এজন্য তার মূল সোর্সে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

স্থানভিত্তিক সার্চ : কোনো ব্যবহারকারী যদি সার্চ বক্সে কোনো জেলার নাম ইংরেজিতে লেখার চেষ্টা করেন, তাহলে পিপীলিকা তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাতে ওই স্থানের নাম সাজেশন হিসেবে দেয়ার চেষ্টা করবে। ব্যবহারকারী যদি শুধু স্থানটির নাম দিয়ে অনুসন্ধান করেন, তাহলে পিপীলিকা তার ফল প্রকাশের সাধারণ পদ্ধতিটি পরিবর্তন করে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে ফল প্রকাশ করবে। সে সেই জেলার সাম্প্রতিক সময়ের তথ্যসমূহ বিশ্লেষণ করে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে প্রকাশ করবে, যেমন- অপরাধ, ব্যবসায়, রাজনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পরিবেশ, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, কৃষিতথ্য ইত্যাদি। প্রতিটি ক্যাটাগরিতে দেখানো হবে প্রথম ৫টি ফল এবং মোট ফল সংখ্যা।

কোনো ব্যবহারকারী More স্থানে ক্লিক করে সহজেই ওই জেলার ওই ক্যাটাগরির বাকি ফল দেখতে পারবেন। স্থানভিত্তিক সার্চের সময় অভিধান প্রয়োগ করা হয়নি।

ক্যাটাগরিভিত্তিক সার্চ : পিপীলিকায় বর্তমানে মোট ৯টি ক্যাটাগরি রয়েছে : অপরাধ, ব্যবসায়, রাজনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পরিবেশ, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, কৃষিতথ্য এবং জাতীয় ই-তথ্যকোষ।

জাতীয় ই-তথ্যকোষ ছাড়া বাকি ক্যাটাগরিগুলো বিভিন্ন ধরনের সংবাদ নির্দেশ করে। কোনো ব্যবহারকারী যেকোনো একটি ক্যাটাগরিতে ক্লিক করে তার সার্চ বক্সে দেয়া শব্দ বা শব্দাবলী শুধু ওই ক্যাটাগরির সংবাদসমূহে অনুসন্ধান করতে পারবেন। উল্লেখ্য, সাধারণ সার্চের সময় সব ক্যাটাগরির সংবাদের মাঝে অনুসন্ধান চালানো হতো। এই সার্চের ক্ষেত্রেও সাধারণ সার্চের মতো ফল দেখানো হবে।

জাতীয় ই-তথ্যকোষ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ক্যাটাগরি। এই ক্যাটাগরিতে মূলত জাতীয় ই-তথ্যকোষ/জ্ঞানকোষ (National Infokosh)-এর তথ্যসমূহ সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।

যেহেতু পিপীলিকার বর্তমান সংস্করণটি একটি আলফা সংস্করণ, সেহেতু এতে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমরা মূলত মূল ওয়েবলিঙ্কের ভিত্তিতে ক্যাটাগরি করায় অনেক সময় একই হেডলাইনের সংবাদ অনেকবার, অনেকভাবে আসতে পারে। কিন্তু একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে প্রতিটি সংবাদের ওয়েবলিঙ্ক ভিন্ন ভিন্ন।

এই সার্চ ইঞ্জিনটি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি থিসিসের ফল। উল্লেখ্য, সার্চ ইঞ্জিনটি নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় গত কয়েক বছর ধরে কাজ করে আসছে। পিপীলিকার আগের ভার্সনটি একুশে ফিন্যান্স নামে পরিচিত ছিল। এটিতেও পিপীলিকার গবেষকেরা কাজ করেছিলেন। একুশে ফিন্যান্স Digital Innovation Fair 2010, Sylhet-এ প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল। তবে সেটাতে পিপীলিকার অনেক ফিচার অনুপস্থিত ছিল। বিশেষ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলা অভিধানের প্রয়োগ ও বিভিন্ন ধরনের কাস্টমাইজড সার্চ ফল একমাত্র পিপীলিকাই দিতে পারে। এ ছাড়া পিপীলিকাতে বাংলার তথ্য পার্সিং করার জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়েছে।

এ প্রকল্পের টিমে আছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আহমেদ চিশতী, বুরহান উদ্দিন এবং মো: রুহুল আমিন সজীব।

প্রকল্প-২ : ডিজিটাল ডায়রি

কর্মব্যস্ত জীবনে আমাদের সময় সম্পর্কে সচেতন না হলে নানা ঝামেলায় পড়তে হবে। প্রতিদিনের নানা দরকারি কাজ মনে রাখার ঝামেলা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে একটি ডিজিটাল ডায়রি। মাইক্রোকন্ট্রোলার প্রকল্পের টিমটি এমন একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরি করার চেষ্টা করেছে, যা একই সাথে অ্যালার্ম ঘড়ি এবং ডায়রির কাজ করতে পারে।



বর্তমানে প্রায় সব মোবাইল ফোনসেটে রিমাইন্ডার এবং অ্যালার্ম সুবিধা রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ সাধারণ মানের সেটে এসব সুবিধা গ্রাহকবান্ধব হয় না। তাই এ থেকে আমরা তেমন একটা উপকৃত হই না। সে জন্য প্রয়োজনীয় কাজের কথা মনে করিয়ে দেয়া, এর সুবিধা গ্রাহকবান্ধব উপায়ে এবং সাশ্রয়ী মূল্যে এনে দিতে এই প্রকল্প দলটি মাইক্রোকন্ট্রোলারনির্ভর একটি ডিজিটাল ডায়রি তৈরি করেছে।

এই ডিজিটাল ডায়রিতে ব্যবহারকারী খুব সহজে নির্দিষ্ট সময়ে একটি কাজের বিবরণ অথবা কোনো প্রয়োজনীয় কথা সেট করে দিতে পারবেন এবং ওই সময় চলে এলে এই ডিভাইসটি ডিসপ্লেতে সেভ করে রাখা মেসেজটি দেখাবে এবং একটি অ্যালার্ম দেবে।

এই প্রকল্পে মাইক্রোকন্ট্রোলার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ATMEGA16 এবং ডিসপ্লে হিসেবে ব্যবহার হয়েছে 420 alphanumeric LCD HD44780। এতে যা যা ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে আছে : Atmega16, 420 alphanumeric LCD display, Push Button, IC 74LS32, Buzzer, Voltage Regulator, Capacitors, Resistance and Potentiometer এবং Heat sink.

এছাড়া সফটওয়্যার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে : এভিআর স্টুডিও, পনিপ্রগ এবং প্রোটিয়াস।

পরবর্তী সময়ে এতে দিন, মাস ও বছর হিসেবেও অ্যাপয়েন্টমেন্টের তালিকা এবং সহজে খুঁজে তা বের করার সুবিধা সংযোজন করা হবে। ডিজিটাল ডায়রিতে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যোগ করা হবে পাসওয়ার্ড প্রটেকশনের সুবিধা, যা ব্যবহারকারীকে প্রাইভেট ডাটা নিরাপদে রাখার নিশ্চয়তা দেবে। সহজে প্রতিদিনের সব কাজের তালিকা আকারে দেখার সুবিধা থাকবে।

এই প্রকল্পে বর্তমানে মেমরি হিসেবে মাইক্রোকন্ট্রোলারের Bcig ব্যবহার করা হয়েছে, যা খুব বেশি বড় নয়। তাই পরবর্তী সময়ে তা মেমরি কার্ড দিয়ে বদলে দেয়া হবে।

এ প্রকল্পের সদস্য হিসেবে যারা কাজ করছেন, তাদের মধ্যে আছেন মুহিব খান, মো: কাইসার-বিন-সাইয়েদ, মো: আসিফ, রাইসুল ইসলাম রাসেল এবং জয়ন্ত বিশ্বাস। এরা সবাই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

প্রকল্প-৩ : মঙ্গলদ্বীপ

বাঙালি তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের আবিষ্কার মানবকল্যাণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার করা হলে সেটি অসাধারণ সৌন্দর্য ধারণ করে। এরকম অসাধারণ সৌন্দর্য ধারণকারী কাজ করেছেন সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তরুণ তথ্যপ্রযুক্তিবিদেরা। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য নানা সুবিধা দিয়ে এমন একটি সফটওয়্যার এরা তৈরি করেছেন। এ সফটওয়্যারটির নাম মঙ্গলদীপ। মঙ্গলদীপ এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের মঙ্গলের জন্য কাজ করা তরুণ তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের কথা তুলে ধরা হয়েছে এখানে। এতে তথ্য সহায়তা দিয়েছেন সুমন তালুকদার।

জীবনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত অনেকটা উপভোগ্য। কিন্তু এদেশের প্রতিবন্ধী মানুষ তাদের অধিকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। ফলে জীবনের উপভোগ্য সময়গুলোতে তাদের অংশ নেয়া থাকে সীমিত। এর কারণ, বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে প্রায় সবখানে প্রতিবন্ধী মানুষগুলো অপ্রতিবন্ধী মানুষের চরম অবহেলার শিকার হয়। তাই প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে ছাত্রসমাজের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি। উন্নত দেশগুলোর মতোই এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের এই পেছনে ফেলা জনগোষ্ঠীকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে যথাযথ অধিকার ও সুযোগ দেয়ার।

যেখানে অনেক সমাজে প্রতিবন্ধীদের সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, প্রতিবন্ধীদের সমাজের বাইরের অংশ হিসেবে কল্পনা করা হয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হতে হয়, সেখানে প্রতিবন্ধীদেরই একটি অংশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের মঙ্গল কামনায় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন তরুণ বিজ্ঞানী তৈরি করেছেন ‘মঙ্গলদীপ’। এর ফলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা খুব সহজেই উচ্চশিক্ষার পথের সব বাধা পেরিয়ে সাফল্যের সোনালি সূর্যের কাছাকাছি পৌঁছতে পারবে। কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ওই তিন তরুণ বিজ্ঞানী হলেন আলমগীর কবির, সাজেদুর রহমান খান তপু ও রুবি পাল। তাদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ছিলেন ওই বিভাগেরই দুই শিক্ষক আনিকা মাহমুদ ও রুহুল আমীন সজীব।

তিন তরুণ বিজ্ঞানী জানান, যখন তাদের গবেষণা করার সুযোগ এলো তখন তারা গতানুগতিক ধারার বাইরে কিছু করতে চেয়েছিলেন, যা সামান্যতম হলেও কারও উপকারে আসবে। তারা সিদ্ধান্ত নেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করার, যারা অন্য সবার মতো সহজেই কমপিউটার ব্যবহার করতে পারবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বেছে নেয়ার কারণ হিসেবে তারা বলেন- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যেমন ঘৃণার চোখে দেখা হয়, তেমনি একজন স্বাভাবিক মানুষ সমাজে যেসব অধিকার ভোগ করেন, তা থেকেও বঞ্চিত করা হয় তাদের। শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের আলাদা নজরে দেখা হয়। মনে করা হয়, এরা শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত পাত্র নয়। কখনো তারা শিক্ষিত হবে না বা তাদের শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব নয়। সমাজের এ ভ্রান্ত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের মঙ্গলে ‘মঙ্গলদীপ’-এর যাত্রা শুরুর চিন্তা করেন ওই তিন তরুণ বিজ্ঞানী।



দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করার বিষয়টি এরা প্রথমে এদের তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষিকা আনিকা মাহমুদকে জানান। আনিকা মাহমুদ তাদের বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর বিভাগে কিছু ছাত্র আছে যারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং ওই শিক্ষার্থীরা কমপিউটার নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। তারপর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে তরুণ তিন বিজ্ঞানী তাদের তত্ত্বাবধায়ক আনিকা মাহমুদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর বিভাগে যান। কথা বলেন ওই বিভাগের শিক্ষক ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কিছু ছাত্রের সাথে। এরা কথা বলেন ভাস্কর ভট্টাচার্য নামের এক শিক্ষকের সাথে, যিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও কমপিউটার ব্যবহারে পারদর্শী। তাকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের একজন অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত বলা হয়। ওই বিভাগের যে সফটওয়্যার (RR) ব্যবহার করা হয় তা ইংরেজি ভাষায়। মায়ের ভাষায় কথা বলতে যেমন ভালো লাগে, শুনতেও তেমন। তাই এরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য খুব সহজে ব্যবহারযোগ্য বাংলা ভাষায় বলে শোনাবে এমন সফটওয়্যার তৈরির সিদ্ধান্ত নেন, যা তাদের কমপিউটার ব্যবহার অনেক সহজ করবে বলে জানান আলমগীর কবির, সাজেদুর রহমান খান তপু ও রুবি পাল।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কষ্ট লাঘবের পথে এগিয়ে যাওয়া শুরু করেন তারা। আর তাদের এ পথের রাসত্মা দেখাতে হাজির হন শাবির কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক রুহুল আমীন সজীব। তার উৎসাহেই দ্রুতগতিতে এগিয়ে যান তারা। ওই তিন তরুণ জানান, সজীব স্যারের প্রেরণাতেই তারা কিছু একটা করতে সমর্থ হয়েছেন। এ সফটওয়্যারটিতে ব্যবহার করা হয়েছে সি শার্প ল্যাঙ্গুয়েজ। এছাড়া আই ফিল্টার, এমএস অফিস অবজেক্ট লাইব্রেরি ইত্যাদি প্যাকেজ এবং মেইলের জন্য এসএমটিপি ও পপ প্রটোকল ব্যবহার করা হয়েছে।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সাহায্যকারী এ সফটওয়্যারের নাম দেয়া হয়েছে মঙ্গলদীপ। এ সফটওয়্যারটি ব্যবহার করার মাধ্যমে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা সহজেই সাধারণ মানুষের মতো কমপিউটার ব্যবহার করতে পারবে এবং কমপিউটারের দৈনন্দিন কাজ করতে পারবে। এমনকি ইন্টারনেটের মাধ্যমে খুব সহজেই মেইল পড়া ও পাঠাতে পারবে। মঙ্গলদীপ ব্যবহার করে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী খুব সহজেই ওয়ার্ড সম্পাদনা, গান শোনা, ই-বুক পড়া, মেইল পাঠাতে ও গ্রহণ করতে, সফটওয়্যার ইনস্টল-আনইনস্টল করাসহ মোটামুটি দরকারি প্রায় সব কাজ করতে পারবে।

আলমগীর কবির, সাজেদুর রহমান খান তপু ও রুবি পাল জানান, একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী যেকোনো প্রোগ্রামই চালু করুক না কেন, এ সফটওয়্যার সহজ, বোধগম্য ভাষায় প্রতিটি কমান্ড, অক্ষর, শব্দ পড়ে শোনাবে, যা একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সহজেই বোঝে সে এখন কী কাজ করছে কিংবা পরবর্তী নির্দেশনাইবা কি? এটি প্রচলিত অন্যান্য যেকোনো সফটওয়্যারের চেয়ে অনেক কম ধাপ। এক কথায় শর্টকাট কী ব্যবহার করার মাধ্যমে ওয়ার্ড সম্পাদনা, গান শোনা, মেইল সেন্ড ও রিসিভসহ দরকারি প্রোগ্রামগুলো চালু ও পরিচালনায় সাহায্য করে। ভবিষ্যতে এ সফটওয়্যারের পরিসর বাড়ানোসহ কিভাবে এর ব্যবহার আরো সহজ করা যায়- এ ভাবনাই এখন এই তিন শিক্ষার্থীর।

এ সফটওয়্যারের দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করেছেন রুহুল আমীন সজীব। এ বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়ে। প্রতিবন্ধীদের একটি অংশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সুবিধার্থেই এ সফটওয়্যারটি ডেভেলপ করা হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে পড়াশোনা কমপিউটারভিত্তিক। ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন পিডিএফ ফাইল ডাউনলোড করে পড়ে থাকে শিক্ষার্থীরা। এ সফটওয়্যারের ফলে পিডিএফ ফাইল পড়ে পড়ে শোনানো হয়। রুহুল আমীন সজীব এ সফটওয়্যারের সবচেয়ে মজার বিষয়টির কথা বলতে গিয়ে বলেন, এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা বিশ্বের মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে খুব সহজেই।

প্রকল্প-৪ : দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের অক্ষর শনাক্তকরণ

এ প্রকল্পে কাজ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কানিজ ফাতেমা মাধবী, মারিয়া জামান, নায়লা বুশরা এবং ফারজানা বিনতে ইউসুফ।



দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা অক্ষর চেনার জন্য ব্রেইলি বর্ণমালা ব্যবহার করে থাকেন, যেখানে মাত্র ৬টি ডট দিয়ে ২৬টি বর্ণমালা এবং ১০টি অঙ্ক বা সংখ্যাকে প্রকাশ করা সম্ভব। ডটের অবস্থান স্পর্শের মাধ্যমে অনুভব করে পড়া এবং লেখার জন্য দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের মাঝে ব্রেইলি বর্ণমালা খুবই জনপ্রিয়। ডটগুলো প্রতি সারিতে ২টি করে মোট ৩টি সারিতে পাশাপাশি বসানো থাকে।

ডটগুলোর বিভিন্ন বিন্যাসের মাধ্যমে যেভাবে বর্ণমালা এবং সংখ্যা প্রকাশ করা হয়, তা নিচে দেয়া হলো :

আলোচ্য প্রকল্পটিতে ৬টি বাটনের কম্বিনেশন বা বিন্যাস ব্যবহার করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য একটি কীবোর্ড তৈরি করা হয়েছে। এই কীবোর্ডের আউটপুট সিরিয়াল কমিউনিকেশনের মাধ্যমে কমপিউটারে ডিসপ্লে করা হয়েছে। এছাড়া টাইপ করতে ভুল করলে তাকে একটি সঙ্কেত শোনানোর মাধ্যমে সতর্ক করা এবং কোনো সঠিক বর্ণ টাইপ করলে সেটিও শোনানো হয়েছে। এতে সে বুঝতে পারে তার কাঙ্ক্ষিত বর্ণটিই লেখা হয়েছে।

আমাদের দেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বেশিরভাগই অক্ষরজ্ঞান থেকে বঞ্চিত। বিশ্বজুড়ে ব্রেইলি পদ্ধতি বহুল প্রচলিত হলেও আমাদের দেশে এই পদ্ধতি ব্যবহারের খুব বেশি সুযোগ এখনও তৈরি হয়নি। এ প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা মনে করেন এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে এর মাধ্যমে ব্রেইলি পদ্ধতিতে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে একটি বড় সুবিধা সৃষ্টির পাশাপাশি উৎসাহ তৈরি হবে। তাছাড়া এটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কমপিউটার ও মোবাইল ব্যবহারের সুবিধা দেবে, যা বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য জরুরি। দেশের সুবিধাবঞ্চিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সহায়তা দেয়া ও দেশের আইটি ক্ষেত্রে অবদান রাখার ইচ্ছে থেকেই এই প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়।

এই প্রকল্পটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে কমপিউটার শেখার সুযোগ তৈরি করবে এবং এর মাধ্যমে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা কর্মস্থলে স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন কাজ করার যোগ্যতা অর্জন করবে ও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ পাবে।

এতে যেসব হার্ডওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে আছে : ATmega16L মাইক্রোকন্ট্রোলার, MAX232 IC, ক্যাপাসিটর, রেজিস্টর, ডায়োড, পুশ বাটন, নাইন ওয়ে আরএস২৩২ কানেক্টর, ৫ ভোল্ট বিদ্যুৎ সরবরাহ, কমপিউটার এবং তার।

এতে ব্যবহার করা সফটওয়্যারগুলো হচ্ছে : আইডিই : এভিআর স্টুডিও৪, সাপোর্ট : এভিআর লাইব্রেরি, কম্পাইলার : উইনেভর এবং প্রোগ্রাম সফটওয়্যার : পনিপ্রগ ২০০০।

একই সাথে অন্ধ এবং নিরক্ষর মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দান করার জন্য এই ডিভাইসটি বিশেষ উপযোগী। এর মাধ্যমে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পক্ষে কমপিউটারে লেখা টাইপ করা সম্ভব এবং টাইপ করা শব্দটি শোনা সম্ভব। এ ছাড়া ভুল অক্ষর টাইপে ব্যবহারকারী একটি সতর্ক সঙ্কেত শুনতে পাবেন, যা তাদের বিশেষ অক্ষর পদ্ধতি তথা ব্রেইলি বর্ণমালা শিখতে সাহায্য করবে।

বিভিন্ন ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইসে আলোচ্য ডিভাইসের ব্যবহার অন্ধদের অক্ষর চেনায় ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও অক্ষর চেনার পাশাপাশি শব্দ চেনার উপযোগী করে একে আরো উন্নত করা সম্ভব। এটি ব্যবহার করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ কীবোর্ড এবং মোবাইলও তৈরি করা সম্ভব।

আলোচ্য প্রকল্পের ডিভাইসটির মাধ্যমে অক্ষরের উচ্চারণ শোনানো গেলেও এটিকে এখনো শব্দ উচ্চারণের উপযোগী করে তোলা হয়নি।

এটি তৈরিতে আনুমানিক খরচ হয়েছে ১০০০ টাকা। বাণিজ্যিকভাবে এই ডিভাইসটি তৈরি করা সম্ভব। সম্ভাব্য খরচ ১৫০০-২০০০ টাকা।

এর স্ক্রিনশট হচ্ছে সার্কিট কনফিগারেশন, হাইপারটার্মিনালে অক্ষর ডিসপ্লে এবং হাইপারটার্মিনালে অক্ষর ডিসপ্লে।

প্রকল্প-৫ : ফ্যানের স্বয়ংক্রিয় গতি নিয়ন্ত্রণ

এ প্রকল্পটিতে যারা আবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে আছেন : আদিল নওশাদ, শাকিল আহমেদ, মো: লুৎফর রহমান মিলু, আশেকুল ইসলাম তৌহিদ, সুবির সাহা এবং আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

প্রকল্পটির লক্ষ্য ছিল ঘরের তাপমাত্রার সাথে সাথে বৈদ্যুতিক পাখার গতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। কাজটি করার জন্য প্রথমেই আমাদের জানা দরকার ঘরের প্রকৃত তাপমাত্রা কত। এজন্য এ প্রকল্পে একটি টেম্পারেচার সেন্সর (LM35, range 2-150) আইসি ব্যবহার করা হয়েছে। এই আইসি (LM35) প্রতি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সাথে ১০ মিলিভোল্টের একটি অ্যানালগ ডিসি ভোল্টেজ দেয়। অর্থাৎ ঘরের তাপমাত্রা যদি ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হয়, তাহলে আমরা LM35-এর কাছে ২৫x১০ = ২৫০ মিলিভোল্ট আউটপুট পাই। LM35-এর কাছ থেকে পাওয়া এনালগ ভোল্টেজকে মাইক্রোকন্ট্রোলারের অ্যানালগ টু ডিজিটাল কনভার্টার এডিসি দিয়ে ডিজিটাল ডাটায় কনভার্ট করা হয়। এতে দুটি সেভেন সেগমেন্ট ডিসপ্লেতে ০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ৯৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত দেখানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

দ্বিতীয় কাজটি হলো একটি ফ্যানের গতি নিয়ন্ত্রণ। এজন্য একটি স্টেপার মোটর ব্যবহার করা হয়েছে। ধরে নেয়া হয়েছে, ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কম তাপমাত্রায় ফ্যান বন্ধ রাখা যেতে পারে। তাপমাত্রা ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি হলে ফ্যান সবচেয়ে আস্তে ঘুরবে। তাপমাত্রা ২৫ থেকে ২৭ ডিগ্রির মাঝে থাকলে ফ্যানের রেগুলেশন একধাপ বাড়বে। এভাবে ক্রমে তাপমাত্রা বাড়বে এবং সেই সাথে ফ্যানের গতি বাড়তে থাকবে। ধরে নেয়া হয়েছে তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রির বেশি হচ্ছে সবচেয়ে গরম আবহাওয়া। তাই তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি অতিক্রম করলে ফ্যান সর্বোচ্চ গতিতে ঘুরবে। একটি আলাদা সুইচ আছে মোটরের জন্য। এটি দিয়ে ইচ্ছে করলে মোটর বন্ধ করে রাখা যাবে।

বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কিছু ভালো উপায় বের করা এ প্রকল্পের একটি লক্ষ্য।

এই রেগুলেটর সাধারণ রেগুলেটরের তুলনায় দামে খুব বেশি হবে না। অন্য আরো সাধারণ রেগুলেটরের মতো ইচ্ছেমতো মোটরের গতি বাড়ানো-কমানো যাবে।

এতে যেসব প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে আছে : মাইক্রোকন্ট্রোলার এটিমেগা৩২, টেম্পারেচার সেন্সর (এলএম৩৫), আইসি (৪৫১১), সেভেন-সেগমেন্ট ডিসপ্লে এবং ইউএলএন২০০৩ (স্টেপার মোটর ড্রাইভার)।

এতে ব্যবহার করা সফটওয়্যারগুলো হচ্ছে : প্রোটিয়াস সিমুলেটর, এভিআর স্টুডিও এবং পনিপ্রগ কোনো রেগুলেটর ছাড়াই ফ্যানের গতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে-কমবে তাপমাত্রা ওঠা-নামার সাথে সাথে। অনেক সময় দেখা যায় রাতের শুরুতে খুব বেশি গরম লাগে। আবার শেষ রাতের দিকে বেশ ঠান্ডা পড়ে। আমরা ফ্যান ফুল স্পিডে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু শেষ রাতে ঘুমে থাকা অবস্থায় ফ্যান বন্ধ করার উপায় থাকে না। সে ক্ষেত্রে এই স্বয়ংক্রিয় রেগুলেটর বেশ কাজে আসতে পারে।

যদি এমন কিছু করা যেত, যাতে করে ঘরে কোনো মানুষ কক্ষে থাকলেই ফ্যান ঘুরবে, অন্যথায় ফ্যান স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে, তাহলে সেটা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে অনেক বড় অবদান রাখতে পারত। এই প্রকল্পটি নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা মোশন ডিটেক্টর দিয়ে কাজটা করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। তদের আশা, তারা এতে সফল হতে পারবেন।

সাধারণ রেগুলেটরের তুলনায় এর আকার সামান্য বড় হবে। যেহেতু মাইক্রোকন্ট্রোলার ডিসি ৫ ভোল্টে কাজ করে সেজন্য অ্যাডাপ্টার সার্কিট অতিরিক্ত লাগবে। টেম্পারেচার সেন্সর বেশ ভালোমানের না হলে ভুল তাপমাত্রা আসতে পারে। ৩০০ টাকার মধ্যেই এটা বানানো সম্ভব।

প্রকল্পে কর্মকর্তাদের ভবিষৎ পরিকল্পনা হলো এয়ারকন্ডিশনারের রেগুলেশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা। ঘরে কোনো মানুষ না থাকলে ঘরের বাতি, ফ্যান, এয়ারকন্ডিশনার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। ঘরে কেউ এলে ঘরের বাতি, ফ্যান, এয়ারকন্ডিশনার স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবার চালু হয়ে যাবে।

প্রকল্প-৬ : পথ অনুসরণকারী গাড়ি

ইংরেজিতে এর নাম দেয়া যায় ‘লাইন ফলোয়ার কার’। এ প্রকল্পের জন্য প্রেরণার উৎস কী? এ প্রকল্পের পেছনে যারা কাজ করছেন, তাদের একজনের বক্তব্য হচ্ছে- ‘ছোটবেলা থেকে একটি স্বপ্ন ছিল রোবট বানানোর। কিন্তু কখনই চেষ্টা করা হয়নি। তাই এবার যখন আমাদের প্রকল্পের প্রস্তাব দিতে বলা হলো, তখন আমরা সবাই একটি রোবট বানানোর ব্যাপারে একমত হলাম। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের বিভিন্ন প্রকল্প ও পরীক্ষা থাকার কারণে আমাদের সময় ছিল খুবই সীমিত। তাই সঠিক সময়ের মাঝে শেষ করতে পারব কি না, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম না। রোবট জগতের জনপ্রিয় একটি চরিত্র হলো পথ অনুসরণকারী বাহন, যে সম্পূর্ণ নিজের বুদ্ধিমত্তায় চলাচল করতে পারবে। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে এক সেক্টর থেকে আরেক সেক্টরে মালামাল পরিবহনে এটি ব্যবহার করা হয়। এ কারণেই আমরা এটি বানানোর জন্য আগ্রহী হলাম।’

এই রোবটটি হলো একটি গাড়ি। গাড়িটি একটি কালো রাস্তা অনুসরণ করতে পারে। এ গাড়িতে একটি লাইট সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি আলোর তীব্রতা অনুসারে বিভিন্ন মান দান করে। এই মান থেকে গাড়িটি ঠিক করে নেয় তার চলার পথ। গাড়িটি সম্পূর্ণ নিজের বুদ্ধিমত্তায় চলাচল করবে।

কলকারখানার অভ্যন্তরীণ মালামাল পরিবহনে এর ব্যবহার যথেষ্ট লাভজনক ও সুবিধাজনক। ইতালির ম্যারেনারোতে অবস্থিত জগদ্বিখ্যাত ফেরারি (Ferrari) কোম্পানির গাড়ি তৈরির কারখানাতে ‘লাইন ফলোয়ার কার’ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন গার্মেন্টসে ‘লাইন ফলোয়ার কার’ ব্যবহার করার সুযোগ আছে, যা সামগ্রিক ব্যয় কমিয়ে আনবে। এছাড়া বিভিন্ন সাফারি পার্ক ও অন্যান্য বিনোদনমূলক পার্কে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এর বুদ্ধিমত্তা আরো বাড়িয়ে রাস্তায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে চালকের অসাবধানতার জন্য দুর্ঘটনা কমবে। ব্যয়বহুল মুভিং ওয়াকওয়ে বা চলন্ত পথ, LFC-র সস্তা এবং বাণিজ্যিক বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে।

এই রোবটে বেশকিছু হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে। এর হার্ডওয়্যারগুলোর মধ্যে আছে : আলোকনির্ভর রোধ (Light Dependent Resistance-LDR), আলো নিঃসরক ডায়োড (LED) এলএম৩৩৯ কম্পারেটর, রেজিস্ট্যান্স, ATMega8 মাইক্রোকন্ট্রোলার, ফিক্সড ভোল্টেজ রিলে, ডিসি মোটর, ব্যাটারি ৩.৭ ভোল্ট, ব্যাটারি ৫ ভোল্ট, ব্যাটারি ১২ ভোল্ট।

আর এতে যে সফটওয়্যার ব্যবহার হয়েছে তা হচ্ছে : Atmel এভিআর স্টুডিও এবং পনিপ্রগ।

এই বর্তমানে শুধু একটি কালো রাস্তা অনুসরণ করতে পারে। প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের পরিকল্পনা হচ্ছে এটিকে এমন সক্ষমতা দেয়া, যাতে এটি সামনে বাধা পেলে ভেঁপু বাজাবে ও বাধা অতিক্রম করার জন্য রাস্তা থেকে বের হবে এবং আবার রাস্তা অনুসন্ধান করবে। এতে করে এটি হবে পরিপূর্ণ আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন।

এই রোবট গাড়িতে এখনো ব্রেক সংযোজন করা হয়নি। গাড়ির চাকা একটি নির্দিষ্ট সীমায় ঘুরতে পারে বলে রাস্তার বাঁক অনেক বেশি হলে গাড়ি এখনো সেই বাঁক বুঝতে পারে না। এছাড়া এতে যেহেতু সাধারণ ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়েছে, সেজন্য ব্যাটারির ক্ষয় একটি বড় সমস্যা। ব্যাটারি ক্ষয় হয়ে গাড়ির গতি এবং চাকার ঘূর্ণনের ওপর প্রভাব ফেলে। তবে অতি শিগগিরই এসব সমস্যার বাস্তব ও সফল সমাধান করার ব্যাপারে আশাবাদী।

এ বিষয়ে প্রকল্প টিমের সদস্যদের পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাবে এরা নির্মাণ সময়ে অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট করেছেন। ফলে তাদের প্রাথমিক নির্মাণ খরচ স্বাভাবিকের একটু বেশি ছিল। তাদের প্রায় ৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। তবে তাদের বিশ্বাস ৩ হাজার টাকার মধ্যে কাজটি করা সম্ভব।

এ প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের ধারণা- এই প্রকল্পটির নানাবিধ প্রয়োগ হওয়া সম্ভব। যেমন- কোনো শিল্পকারখানার একটি বিভাগ থেকে অন্য একটি বিভাগে প্রায়ই মালামাল পরিবহনের প্রয়োজন পড়ে। এই মালামাল পরিবহন করার জন্য এ ধরনের স্বয়ংক্রিয় গাড়ি ব্যবহার করা সম্ভব।

প্রজেক্ট যাদের মাধ্যমে সম্পাদিত হচ্ছে তারা সবাই বুয়েটের ছাত্র। এদের মধ্যে আছেন : মো: মাহফুজুল ইসলাম, আমিনুর রশীদ আসিফ, রিয়াজ মোর্শেদ মাসুদ, আরাফাত রহমান, নগীব মেশকাত, মো: আফিবুজ্জামান অনিক, আশুতোষ দত্ত, এফ.এ. রেজাউর রহমান চৌধুরী, কাজী তাসনিফ ইসলাম এবং মো: নাজমুল হাসান।

প্রকল্প-৭ : পার্কিং এরিয়া কন্ট্রোল

এ প্রকল্পে বুয়েটের যেসব ছাত্র কাজ করেছেন তাদের মধ্যে আছেন : নওরিন সুলতানা, ইশিতা জামান, মামুনুর রশিদ, শাগুফতা মেহনাজ, আশিকুর রহমান আজিম এবং রাফায়েত আলী।



পার্কিং এরিয়ায় প্রবেশ ও প্রস্থান নির্ণয় করার জন্য দুটি সেন্সর রাখা হয়েছে। এ দুটি সেন্সর একত্রে প্রবেশ/বাহির নির্ণয় করতে পারে। পার্কিং এরিয়ায় কত গাড়ি আছে, তা সবসময় একটি ডিসপ্লেতে দেখানো হয়। এছাড়া বর্তমান গাড়ির সংখ্যা পরিবর্তন হলে সে তথ্য নিয়ন্ত্রণকক্ষের কমপিউটারে পাঠানো হয়। নিয়ন্ত্রণকক্ষের অপারেটর চাইলে পার্কিং এরিয়ায় সর্বোচ্চ কত গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। একটি স্টেপার মোটরচালিত গেটের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কোনো একটি গাড়ির ‘প্রবেশ’ নিয়ন্ত্রকের নির্ধারণ করে দেয়া সর্বোচ্চ মানের সীমার মধ্যে হলে এই গেটটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাবে এবং গাড়িটি প্রবেশ করার পর বন্ধ হয়ে যাবে। কোনো একটি গাড়ি এরিয়া থেকে বের হতে চাইলেও এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলবে এবং এরপর বন্ধ হবে। এ প্রকল্পের লক্ষ্য পার্কিং এলাকা নিয়ন্ত্রণের কাজটি স্বয়ংক্রিয় করা।

শুধু পার্কিং এরিয়ার ক্ষেত্রেই নয়, বরং আরো অনেক ক্ষেত্রে এ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ব্যবহার করা যায়। যেমন- শিল্পক্ষেত্রে স্টোরেজে অথবা প্যাকেটজাত করার ক্ষেত্রে প্রোডাক্টের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, যেকোনো ক্ষেত্রে কোনো কিছুর প্রবেশ কিংবা বেরিয়ে যাওয়ার সতর্কসঙ্কেত তথ্য হিসেবে কমপিউটারে পাঠানো ইত্যাদি।

এতে ব্যবহার করা হার্ডওয়্যারগুলো হচ্ছে : সেন্সর, স্টেপার মোটর, মাইক্রোকন্ট্রোলার এটিমেগা ১৬, ৭ সেগমেন্ট ডিসপ্লে, ইউএলএন ২০০৩ আইসি, ৭৪৪৭ আইসি, ম্যাক্স ২৩২ আইসি, এএস ২৩২ কানেক্টর (৯ পিন) ইত্যাদি। আর সফটওয়্যারগুলোর মধ্যে আছে : এভিআর স্টুডিও ৪-হাইপারটার্মিনাল।

এটির উন্নয়ন সাধন করলে হাইপারটার্মিনালের পরিবর্তে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে কমপিউটারে তথ্য দেয়া-নেয়া করতে পারবে। অপারেটর চাইলে ইচ্ছেমতো গেট নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

বর্তমানে একই সাথে প্রবেশ ও বাইর হওয়ার কাজটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি। ধরে নেয়া হয়েছে একই সময়ে শুধু একটি গাড়ি প্রবেশ বা প্রস্থান করবে। তবে চাইলে উভয় দিক থেকে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

সম্পূর্ণভাবে কাজটি শেষ করতে ব্যয় হয়েছে ২০০০ টাকার কাছাকাছি। বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করার জন্য প্রয়োজন উচ্চশক্তিসম্পন্ন সেন্সর ও মোটর। প্রধানত এগুলোর মূল্যের ওপরই নির্ভর করবে বাণিজ্যিকভাবে প্রস্ত্ততের মোট ব্যয়।

প্রকল্প-৮ : সিকিউরড প্রোডাক্ট কাউন্টার

বিভিন্ন কোম্পানিতে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর গণনা ও পণ্যের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী স্বয়ংক্রিয় আধুনিক প্রযুক্তি হলো এই সিকিউরড প্রোডাক্ট কাউন্টার। এর সাহায্যে উৎপাদিত পণ্যের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা (যেমন- চুরি ঠেকানো, অবৈধ হস্তক্ষেপ রোধ ও সঠিক গণনা) সম্ভব। কোম্পানির উর্ধতন কর্মকর্তার জন্য বিশেষ পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করার ব্যবস্থা রয়েছে। উর্ধতন কর্মকর্তা চাইলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর তার অনুপস্থিতিতে প্রোডাক্ট কাউন্টার চালু করে দিতে পারেন। সিস্টেমটি অফ করে নির্দিষ্ট সময় পর অন করতে হয়। এমন ঘটনার পরিপূর্ণ সমাধান এ প্রযুক্তিতে আছে। তাছাড়া এখানে রয়েছে অ্যালার্মিং সিস্টেম, যা যেকোনো অবৈধ হস্তক্ষেপকে প্রতিরোধ করবে। এই প্রযুক্তিতে পণ্য গণনা করা হয় স্পর্শ ছাড়া সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে। কোম্পানির উর্ধতন কর্মকর্তা চাইলে একজন কর্মচারী দিয়ে অ্যালার্মিং সিস্টেম কন্ট্রোল করতে পারবেন। নতুনভাবে গণনা করার জন্য পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন অবস্থায় কোম্পানির উর্ধতন কর্মকর্তা অ্যাকাউন্টার রিসেট করতে পারবেন। এই প্রযুক্তির সীমারেখা এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। ভবিষ্যতে আরও সুবিধা বাড়ানোর জন্য দূরবর্তী জায়গা থেকে সিস্টেমটি মেসেজের মাধ্যমে কন্ট্রোল করার ব্যবস্থা করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। উর্ধতন কর্মকর্তা চাইলে দূর থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সিস্টেমটি চালু রাখতে পারবেন। এতে সময় ও কষ্ট দুটিই লাঘব করা যাবে। আবার যে ব্যক্তি অবৈধভাবে পণ্যে হস্তক্ষেপ করবে, তাকে শনাক্ত করার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হবে। উৎপাদিত পণ্যের হার দেখানোর ব্যবস্থা করা হবে। একাধিক কর্মকর্তা যেন লগইন করতে পারেন সেই ব্যবস্থা রাখা হবে। উর্ধতন কর্মকর্তা চাইলে পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করতে পারবেন। কমপিউটারের সাথে ইন্টারফেসিংয়ের মাধ্যমে পণ্য সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য কমপিউটারে রাখা যাবে। এতে পণ্য সম্পর্কিত পরিসংখ্যান বের করা যাবে, যা বিভিন্ন অফিসের কাজে ব্যবহার করা যাবে।



সিমেন্ট কারখানায় উৎপাদিত সিমেন্টের বস্তা গণনা, পেপসি, ডিউ, কোকাকোলা ইত্যাদি বিভিন্ন পানীয় কোম্পানির উৎপাদিত পানীয় বোতল গণনা, কসমেটিক্স কোম্পানির উৎপাদিত সাবান, তেল, পাউডার ইত্যাদি গণনা, বিমানবন্দরে ব্যাগ গণনা এর মাধ্যমে সম্ভব। এছাড়া আরও বিভিন্ন কাজে এই প্রকল্প ব্যবহার করা যাবে।

এতে ব্যবহার করা হার্ডওয়্যারের মধ্যে আছে: মাইক্রোকন্ট্রোলার (এটিমেগা ৮), আইআর সার্কিট, লেড, মোটর ড্রাইভার আইসি (এল২৯৮), ডিকোডার (৭৪৪৭), সুইচ, কনভাইর বেল্ট, অ্যালার্ম স্পিকার, সেভেন সেগমেন্ট ডিসপ্লে, কেপাসিটর, ভোল্টেজ রেগুলেটর (৭৮০৫), রেজিস্ট্যান্স ও ডিসি মোটর।

এই প্রকল্প তৈরিতে খরচ হয়েছে ৩ হাজার টাকা। বাণিজ্যিক উৎপাদনে এর জন্য খরচ পড়বে ১০ হাজার টাকা।

এই প্রকল্প টিমে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের মধ্যে আছেন : মো: আসিফ হুসাইন, মো: নওশাদ আলম, মো: মুশফিকুর রহমান, মো: আহসান অনিক এবং অভিজয় চাকমা।

প্রকল্প-৯ : স্বয়ংক্রিয় রুম লাইট নিয়ন্ত্রণ

এ প্রকল্প টিমে যারা আছেন তারা হলেন : মাহবুবা নিম্মি, সুরাইয়া তাইরিন, নাযিফা কারিমা, অর্পিতা রায়, রুমানা আক্তার এবং কামরুন নাহার লিজা। এরা সবাই বুয়েটের ছাত্র।



স্বয়ংক্রিয়ভাবে রুমের বাতি জ্বালানো-নেভানোর মাধ্যমে বিদ্যুতের অপচয় রোধ, রুমে আসা লোকসংখ্যা গণনা, সেই সাথে স্বয়ংক্রিয় স্বাগত-বার্তা দেয়া। রুমের দরজায় লাগানো থাকবে একটি সেন্সর, যা রুমে কেউ ঢুকলে বা বের হলে সেন্স করবে। রুমে কেউ প্রবেশ করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতি জ্বলবে। সবাই চলে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা নিভে যাবে। এ প্রকল্প তৈরিতে ব্যবহার হয়েছে মাইক্রোকন্ট্রোলার (এটিমেগা ১৬), সেভেন সেগমেন্ট ডিসপ্লে, আইআর সেন্সর, ডিকোডার ইত্যাদি হার্ডওয়্যার। সহায়ক সফটওয়্যার হিসেবে ব্যবহার হয়েছে এভিআর স্টুডিও।

এর মাধ্যমে রুমের বাতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অডিটোরিয়াম, শপিং মল, সেমিনার রুম, শ্রেণীকক্ষে উপস্থিত লোকসংখ্যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানা যাবে এবং উপস্থিত লোকের উদ্দেশে যেকোনো ঘোষণা বা তথ্য ডিসপ্লেতে দেখানো যাবে।

এছাড়া এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফ্যান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এবং কোনো রুমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা অ্যালার্ম সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কোনো রুম সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্যাদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রুমের বাইরে প্রদর্শন করা সম্ভব।

এই প্রকল্প তৈরিতে মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ হাজার টাকা।

প্রকল্প-১০ : নিরাপদ ই-ভোটিং

একটি ভালো নির্বাচন ব্যবস্থা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম পূর্বশর্ত। নির্বাচন ব্যবস্থা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হলে ভোটার ও প্রার্থী উভয়ই ভোটের ফল মেনে নিতে পারেন সন্তুষ্টচিত্তে। কিন্তু বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা খুব স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমই দেখতে পাই। বরং নির্বাচনের ফলকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশসহ অন্যান্য দেশে নৈরাজ্য, সহিংসতা এমনকি খুনের ঘটনা পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়নি। এর ফলে নির্বাচনে দুর্নীতির আশঙ্কা সব সময়ই ছিল এবং তা রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভিন্ন সময় নির্বাচনের ফল না মানতে প্রভাবিত করেছে।







সম্প্রতি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন তথা ইভিএম চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা উচিত কি না, তা এখন দেশজুড়ে একটি আলোচনার বিষয়বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এ নিয়ে চরম মতপার্থক্য বিরাজ করছে। সাধারণ লোকজনও এ নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন, যদিও বেশিরভাগ লোকের এই প্রযুক্তির বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই। আলোচ্য প্রকল্পে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে আরও নিরাপদ এবং যুগোপযোগী একটি ইলেকট্রনিক পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টা করা হয়েছে।

একটি ভালো ভোটিং পদ্ধতি- সেটা ইলেকট্রনিক, মেকানিক্যাল কিংবা প্রচলিত ব্যালট পেপার ব্যবহার যা-ই হোক না কেন, কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রত্যেক ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, ভোটারের নিরাপত্তা বিধান করা, ভোটার কোন প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছেন তা কোনোভাবেই প্রকাশ না পাওয়া, ভোট দেয়া ও গণনায় কোনোরকম কারচুপির সুযোগ না থাকা এবং সর্বোপরি ভোটের ফল দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া। একটি আদর্শ ভোটিং ব্যবস্থা অবশ্যই শিক্ষা, বয়স, শারীরিক সক্ষমতা নির্বিশেষে সব ভোটারের কাছে বোধগম্য হবে। ভোট গ্রহণের পদ্ধতি এবং সময়সীমা এমন হওয়া উচিত, যাতে নির্দিষ্ট ভোটাররা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভোটদান করতে পারেন। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর এবং সংস্কৃতির মানুষকে এসব সুবিধা নিশ্চিত করা বেশ কঠিন। এক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যালট পদ্ধতির চেয়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং বেশ কার্যকর এবং ফলপ্রসূ পদ্ধতি হিসেবে পরিগণিত হতে পারে, যদি অন্যান্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। অবশ্য প্রচলিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের কিছু নিরাপত্তাজনিত দুর্বলতাও পরিলক্ষিত হয়, যা নির্বাচনের ফলকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে।

ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি সুষ্ঠু ভোট গ্রহণের পূর্বশর্তগুলো ভালোভাবেই পূরণ করতে পারে প্রচলিত ব্যালট পেপার পদ্ধতির চেয়ে। ই-ভোটিং বলতে ভোট গ্রহণ এবং ভোট গণনার ইলেকট্রনিক পদ্ধতিকে বোঝায়। প্রচলিত ই-ভোটিং পদ্ধতির স্বচ্ছতা এবং নিরাপত্তা নিয়ে একটু বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। বর্তমানে প্রচলিত ইভিএমের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার পরিবর্তন করার মাধ্যমে কারচুপি করা যায়। হার্ডওয়্যার পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে আসল ডিসপ্লের পরিবর্তে নকল ডিসপ্লে ব্যবহার এবং তথ্য সংরক্ষণকারী মেমরি চিপসে ক্লিপ ব্যবহার। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে এবং ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়াতে ইভিএমের নিরাপত্তা বাড়ানো নিয়ে গবেষণা হয়েছে। তার আলোকে এই পূর্ণ নিরাপদ আধুনিক ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি ডিজাইন করা হয়েছে বলে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের দাবি।

ই-ভোটিংয়ের আওতায় ভোটার ইভিএম ব্যবহার করে ভোট দেবেন। দক্ষিণ এশিয়াতে ভারত প্রথম ইভিএমের ব্যবহার শুরু করে এবং পর্যায়ক্রমে তা পাশের দেশগুলো চালু করে। সম্প্রতি একদল বিশেষজ্ঞ এ ধরনের ইভিএমের কিছু নিরাপত্তা-ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন। বর্তমানে নির্বাচনের আগে বিভিন্ন প্রার্থীর এবং প্রতীকের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা স্থাপন করা হয়। ইভিএম মেশিনে কিছু বোতাম থাকে, যা নির্বাচনের প্রতিযোগী প্রার্থীর নাম ও প্রতীকের পাশে বসানো হয়। সবকিছু যাচাই শেষ হওয়ার পর ভোটার এই মেশিনে তার পছন্দসই প্রার্থীর পাশের বোতাম টিপে ভোট দিয়ে থাকেন। তৎক্ষণাৎ ভোট দেয়া হয়ে যায়, কিন্তু ভোটার তার কাঙ্ক্ষিত প্রার্থীকে ভোট দিতে পারলেন কি না কিংবা তার ভোট গণনা হলো কি না, তার কোনো প্রমাণ এখানে থাকে না।

স্বচ্ছ ও নিরাপদ ভোট গ্রহণের জন্য একটি আধুনিক ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে আলোচ্য প্রকল্পে, যাতে প্রচলিত ই-ভোটিংয়ের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপত্তামূলক বৈশিষ্ট্য সন্নিবেশিত হয়েছে। তিন নম্বর চিত্রে এ প্রকল্পের প্রস্তাবিত পদ্ধতির একটি সরল কাঠামো প্রকাশ পেয়েছে। এই ব্যবস্থায় বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটি করে সার্ভার থাকবে, যা সরাসরি ঢাকায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে যুক্ত হবে। একটি জেলার সব ভোটকেন্দ্র জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সাথে ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত হবে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে ডাটাবেজে রাখা হবে যেন উপযুক্ত ও প্রাপ্তবয়স্ক কোনো ভোটার তালিকা থেকে বাদ না পড়েন। যখন একজন ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাবেন, তখন তিনি সেই কেন্দ্রে ভোটদানের যোগ্য কি না, তা যাচাই করা হবে ভোটার পরিচয়পত্র নম্বর এবং আঙুলের ছাপ যাচাইয়ের মাধ্যমে। কোনো ভোটারের একবার এসব মিলে যাওয়ার পর এই তথ্যগুলোতে আর নির্বাচনের দিন প্রবেশ করানো যাবে না। এই পদ্ধতিতে একজন আরেকজনের ভোট দিতে পারবেন না, বা একজন দুইবার ভোট দিতে পারবেন না। যাচাইয়ের পর সব তথ্য মিলে গেলে ভোটার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এই ভোট সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সার্ভার এবং ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে হালনাগাদ হয়ে যাবে। ভোট গ্রহণ শেষে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সার্ভার সেই জেলার প্রত্যেক কেন্দ্র, আসন এবং প্রার্থীর সমন্বয়ে ফল প্রকাশ করবে, যা সাথে সাথে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়েও পাওয়া যাবে। যদি কোনো এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ না থাকে, তাহলে সেখানে ভোটার যাচাই করার প্রক্রিয়া বর্তমানে প্রচলিত নিয়মেই হবে। তার নাম ভোটার তালিকার সাথে মিলিয়ে দেখা হবে এবং ভোট নেয়ার পর হাতে অমোচনীয় কালি লাগিয়ে দেয়া হবে। নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষ হলে ইভিএমগুলো সংগ্রহ করা হবে এবং ভোট প্রতিস্থাপনযোগ্য মেমরির মাধ্যমে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সার্ভারে স্থানান্তর করা হবে। ফল পূর্বে উল্লিখিত নিয়মেই প্রকাশিত হবে।

এই পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া দুই ধাপে সম্পন্ন হবে। প্রথমত- ভোটার একজন প্রার্থী পছন্দ করবেন, যা তিনি প্রচলিত ইভিএমে করে থাকেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ ভোট দেয়ার পরিবর্তে তিনি ইভিএমে একটি বোতাম টিপে তার পছন্দসই প্রার্থী নির্বাচন করবেন, তারপর আরেকটি বোতাম টিপে তাকে ভোট দেয়া নিশ্চিত করবেন। দ্বিতীয়ত- বোতাম টেপার পর একটি ব্যালট স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছাপা হবে এবং তা নিরাপদ ও স্বচ্ছ পথে একটি সুরক্ষিত ও স্বচ্ছ বাক্সে জমা হবে। একই সাথে ইভিএম একটি রসিদ ছাপবে। সেখানে ভোটারের জন্য তালিকা নম্বর দেয়া থাকবে। ভোটার সেই রসিদটি নিজের কাছে সংরক্ষণ করবেন। এভাবে ভোট ইলেকট্রনিক ও ব্যালট দুই মাধ্যমেই সংরক্ষিত হবে। যদি নির্বাচনে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ ওঠে, তাহলে এই ব্যালটগুলো গণনা করা হবে। যেহেতু ভোট ইলেকট্রনিক এবং ব্যালট দুই মাধ্যমেই সংরক্ষিত হবে, তাই দুর্নীতির কোনো সুযোগ থাকবে না। জেলা প্রশাসকের সার্ভার কক্ষে একটি বড় মনিটর থাকবে। যেখানে প্রত্যেক কেন্দ্রের সংগৃহীত ভোটের সংখ্যা প্রদর্শন করা হবে এবং যখনই কোনো কেন্দ্রে কোনো ভোট দেয়া হবে, সাথে সাথে তা হালনাগাদ করা হবে। প্রত্যেক প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট সেখানে কোন কেন্দ্রে কত ভোট গৃহীত হচ্ছে, তা দেখতে পারবেন এবং তারা যেকোনো ধরনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দুর্নীতির চেষ্টাও ধরতে পারবেন খুব সহজে।

নিচের চিত্রে প্রস্তাবিত ই-ভোটিং পদ্ধতিতে কিভাবে ভোট গ্রহণ ও গণনা করা হবে তা দেখানো হয়েছে।

প্রার্থী ১ – ‘XX’ ভোট
প্রার্থী ২ – ‘XX’ ভোট
ভোটকেন্দ্র ১ – ‘XX’ ভোট
ভোটকেন্দ্র ২ – ‘XX’ ভোট

পূর্বে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলে :

০১. কোনো ভোটার একবারের বেশি ভোট দিতে পারবেন না।

০২. ভোটের ব্যালট পেপার কপি সংরক্ষিত থাকবে, তাই কোনো ইলেকট্রনিক বিপর্যয় ঘটলে ভোট গ্রহণ বাতিল হবে না।

০৩. এমনকি যদি ইভিএম ভোটকেন্দ্র থেকে সরিয়ে ফেলা হয়, তা নির্বাচনের ফলের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ ফল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সার্ভারেও সংরক্ষিত থাকবে।

০৪. কেউ সার্ভার থেকে কোনো ভোট কমাতে/বাড়াতে পারবেন না, যেহেতু সেটি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাসহ সংরক্ষিত থাকবে।

০৫. একই সময়ে একাধিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থাকায় কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন ভোট সংখ্যার গরমিল করতে পারবেন না।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ভোট গ্রহণের প্রতিটি ধাপে কাজ করা ব্যক্তিদের অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ, সৎ, বিশ্বস্ত ও কর্মঠ হতে হবে, যাতে এই ই-ভোটিং পদ্ধতি সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।

ভোট গ্রহণ শেষে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সার্ভার কোন প্রার্থী কোন ভোটকেন্দ্রে কত ভোট পেয়েছেন তা প্রকাশ করবে। এটা প্রমাণিত, প্রচলিত ব্যালট পেপার পদ্ধতির চেয়ে ই-ভোটিং পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ ও গণনা করতে অনেক কম সময় লাগবে। প্রস্তাবিত পদ্ধতিকে আরো দ্রুততর করা যাবে যদি একটি ভোটকেন্দ্রে বেশিসংখ্যক ইভিএম সংযুক্ত করা হয়।

ইন্টারনেটের মতো বিশাল টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসারের সাথে সাথে আমাদের জীবনের মান ও পদ্ধতিতে এক ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের একটি হচ্ছে কোনো সরকারের কর্মপরিকল্পনা ভালোভাবে বাস্তবায়নের জন্য ই-সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। ই-ভোটিং পদ্ধতির আধুনিকায়ন ই-সরকার ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার অন্যতম পূর্বশর্ত। প্রস্তাবিত পূর্ণ নিরাপত্তামূলক ই-ভোটিং পদ্ধতি সহজ, নিরাপদ, আধুনিক, স্বচ্ছ ও দক্ষ এবং এটা ইলেকট্রনিক, তথ্য ও টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে ডিজাইন করা হয়েছে। এটা বলা নিরাপদ যে, যদি প্রস্তাবিত ই-ভোটিং পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয় তাহলে একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যা সব রাজনৈতিক দল, দেশের মানুষ ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক পরিকল্পনার নিরবছিন্নতা নিশ্চিত করবে, যা বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার জন্য খুবই প্রয়োজন। তাই বলা যায়, এই ই-ভোটিং পদ্ধতি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে একটি ছোট পদক্ষেপ, কিন্তু শান্তিপূর্ণ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার পথে এক বিশাল নবযাত্রা।

এখন প্রশ্ন হলো, ই-ভোটিংয়ে তো আমাদের যেতে হবে। কিন্তু কোন সময় এবং কী পটভূমির প্রেক্ষিতে? আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কী প্রস্তাবিত পূর্ণ নিরাপত্তামূলক ই-ভোটিং পদ্ধতি প্রবর্তন করা সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে এই প্রযুক্তি নিয়ে কিছু গবেষণা ও অনুসন্ধান করতে হবে প্রকল্পের মাধ্যমে। এই প্রকল্পগুলো হতে পারে : ০১. পদ্ধতি উন্নয়ন, ০২. ছোট পরিসরের নির্বাচনে তা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার, ০৩. সেখানে সফল হলে বড়ো পরিসরের নির্বাচনে ব্যবহার। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় ২-৩ লাখ ইভিএম লাগবে, যা সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে দেশেই তৈরি হবে। তাছাড়া ছোট পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করে কোনো ত্রুটি পাওয়া গেলে, তা দূর করার জন্য কিছু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দরকার হবে। সর্বোপরি এসবের জন্য একটি আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যা ২০১৪-এর নির্বাচনের আগে সম্ভব নয়। যদি এই প্রযুক্তি ব্যবহারে তাড়াহুড়া করা হয়, তাহলে তা কোনোভাবেই পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না। তাই এই প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের অভিমত, ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রস্তাবিত ই-ভোটিং পদ্ধতি শতকরা ৫-১০ ভাগ ব্যবহার করা হোক। আর ২০১৯-এর নির্বাচন থেকে তা পুরোপুরি ব্যবহার করাই যুক্তিসঙ্গত হবে। ততদিনে আমাদের দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর এই প্রযুক্তি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা গড়ে উঠবে এবং তারা নির্বাচনের ফল মেনে নিতেও সক্ষম হবেন কোনো ধরনের কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন ছাড়াই।

এ প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন : ড. এম আবদুল আউয়াল, অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। ড. সাজ্জাদ হোসেন, সহকারী অধ্যাপক। আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, ছাত্র, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও কমপিউটার সায়েন্স অনুষদ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। ড. আশরাফুল আমীন, সহকারী অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ারিং ও কমপিউটার সায়েন্স অনুষদ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

শেষ কথা

আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক ধরনের প্রকল্পের কাজ হয়, যা আমাদের দেশীয় প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিতে পারে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশীয় শিল্পের চাহিদার সাথে আমাদের দেশীয় শিক্ষার মিল তেমন একটা নেই। অথচ এই মিল বা ধারাবাহিকতা থাকাটা খুব জরুরি। এই মিল না থাকার কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন সদ্য পাস করে বের হওয়া উচ্চশিক্ষিতরা। এরা যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাজে লাগছেন না আর দেশীয় শিল্প তাদের কাজে লাগাতে পারছে না। তবে দেশীয় প্রকল্পগুলো যদি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেত, তাহলে এই সমস্যা থাকত না। সেই সাথে শিল্প বা ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দূরত্ব কমে যেত। এসব প্রকল্প যে আন্তর্জাতিক মানের, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এখন সরকারসহ দেশের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এই প্রকল্পগুলো কাজে লাগানোর জন্য এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই এসব প্রকল্পের শ্রমে নিয়োজিত শিক্ষক ও ছাত্রদের পরিশ্রম সফল হবে। সেই সাথে প্রযুক্তিগত দিক থেকে দেশকেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

কজ ওয়েব

ফিডব্যাক : webtonmoy@yahoo.com, mortuzacsepm@yahoo.com
Source: Monthly Computer Jagat

No comments:

Post a Comment